হজ্জ: বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্বের মিলন মেলা

আল্লাহ তাআলা কোরআন শরীফে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবাগৃহে যাতায়াতের জন্য (দৈহিক ও আর্থিকভাবে) সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর হজ্জ করা ফরদ্ব। (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)।

আবূ উমামাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অনিবার্য প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী শাসক অথবা কঠিন রোগ যদি ( হজ্জে সামর্থ্যবান ) কোনো ব্যক্তিকে হজ্জ পালনে বিরত না রাখে, তবে সে যদি হজ্জ পালন না করে মারা যায়, সে যেন ইহুদি ও নাসারার মতোই মৃত্যুবরণ করে। (দারেমি:১৮২৬)

Professor Phillip K. Hitti says: For centuries the ritual of Hajj has continued to serve as the major unifying influence in Islam and the most effective common bond among the diverse believers.

প্রফেসর পি,কে হিট্রি বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে হজ্জের বিধান ইসলামের প্রধান ঐক্য সংস্থাপক শক্তি ও বিভিন্ন দেশীয় মুমিনদের মধ্যে অত্যন্ত কার্যকর সূত্র হিসাবে কাজ করে আসছে।

জাযিরাতুল আরবের মুবারক মক্কা নগরীতে প্রতি বছর জিলহজ্জ মাসে ভাষা-বর্ণ, আরব-অনারব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই এক কাতারে, একই রঙের কাপড় পরে সমস্বরে উচ্চারণ করেন, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকালাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকালাক। 

অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি,আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই।

হজ্জ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছা বা সংকল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশ পালনার্থে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত তারিখে, নির্দিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত করার সংকল্প করাকে হজ্জ বলা হয়। হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। এটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতগুলোর মধ্যে অনন্য। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবানদের ওপর জীবনে একবার হজ্জ করা ফরদ্ব।
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলা, বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন ও ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের বিশ্ব সম্মেলন অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। একমাত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাই পৃথিবীর দিক-দিগন্ত থেকে ছুটে আসে বায়তুল্লার দিকে।
হজ্জ যেমন আমাদের Universal brotherhood (বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব) এর শিক্ষা দেয় ঠিক তেমনি ত্যাগ, সমতা, ক্ষমা, পাপের প্রতি ঘৃনা সহ অসংখ্য কল্যাণ কাজের প্রশিক্ষণ দান করে । 

ত্যাগের প্রশিক্ষণ : হজ্জ আল্লাহ প্রেমিক প্রতিটি বিশ্বাসী মানুষকে ত্যাগের প্রশিক্ষন দান করে! আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস্ সাল্লাম, ইসমাইল আলাইহিস্ সালাম ও হাজেরা আলাইহিস্ সালামা এর ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম, কোরবানি, আত্মসমর্পণ ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুমহান ঐতিহ্য প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়কে ত্যাগের পথে অনুপ্রাণিত করে।

সমতার শিক্ষা : বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অন্যতম একটি অন্তরায় হলো (inequality) অসমতা, হজ্জের মাধ্যমে অসমতা দুর হয় এবং সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাদশাহ-ফকির, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো ও নানা দেশের নানা ভাষী মানুষ ইহরাম অবস্থায় সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাদা কাপড় পরে একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করার এ অনুষ্ঠান মহব্বত ও অভিন্নতার শিক্ষা দান করে। 

ক্ষমার শিক্ষা : বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অন্যতম আরেকটি অন্তরায় হলো নির্দয়তা বা একে অপরকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে না দেখা! বায়তুল্লার জিয়ারত, আরাফা, মিনা, মুজদালিফা ইত্যাদি পবিত্র স্থান জিয়ারতের মাধ্যমে হজব্রত পালনকারী আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও তাওবা করার সুযোগ লাভ করে। পবিত্র সব স্থানগুলোতে দোয়া কবুল করে আল্লাহ তাআলা বিশ্বাসীদেরকে শুধু ক্ষমাই করেননা বরং তাদের অন্তরে সহানুভূতির বীজ বপন করে ক্ষমার শিক্ষা দান করে তাদের চিন্তা চেতনাকে উন্নত করেন । 

পাপের প্রতি ঘৃণা : একজন বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে যতক্ষণ পর্যন্ত পাপের প্রতি ঘৃনা সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার অপর ভাইকে মহব্বতেন বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবেনা! ঈমানদার ব্যক্তিকে বিশ্বাস করতেই হবে, 
মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু”। (৯:৭১)। হজব্রত পালনের মাধ্যমে হাজিদের মধ্যে পাপ থেকে বিরত থাকা মুমিনদের প্রতি মহব্বত বৃদ্ধি পায় এবং পাপের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। কারণ সে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করে পাপমুক্ত হয়। আর জামরায় কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে নিজের মধ্যকার শয়তানের প্রতি ধিক্কার জানায়। সব শেষে আল্লাহর ঘরের তাওয়াফের মাধ্যমে পাপ থেকে মুক্ত থাকার অঙ্গীকার করে আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় নেয়। সুতরাং পাপহীনতার প্রতি মহব্বত এবং পাপের প্রতি ঘৃনা বিশ্বাসীদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে । 

হজ্জব্রত পালনের মাধ্যমে হজ্বকারীর মনের সংকীর্ণতা দূর হয়ে যায়। পৃথিবীর সাদা কালো, জীর্ণশীর্ণ বিচিত্র ভাষা ও বিচিত্র বর্ণের লোকদের বিশ্বজনীন জাতীয়তা কা’বা কেন্দ্রিক সভ্যতা ও তাওহীদ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একত্রিত করে, সম্প্রীতির, মৈত্রীর সৌভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও সুমহান শিক্ষা প্রদান করে। ইহা সাম্যের এক অপূর্ব দৃশ্য। সমাজ ও বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের এক বাস্তব নমুনা। বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার এক অপ্রতিম প্রক্রিয়া ।  

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *