রমজান গরিব-দুঃখীর সহযোগিতার মাস

পবিত্র মাহে রমজান ক্ষুধার্তদের জঠর জ¦ালা উপলব্ধির মাস, গরীব দুঃখীর দুঃখ মোচনে এগিয়ে আসার মাস। এ রমজান নবী পাকের নির্ধারিত রোজার ফিতরা আদায়ের মাস, যাকাত সহ নানা ধরণের দান সদকার মাস, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের উপযুক্ত মাস মাহে রমজান।
মাহে রমজান আমাদেরকে এ রকম যতগুলো সৎকাজের ডাক দিয়ে যায়, তার মধ্যে গরীব দুঃখীর সহযোগিতা করা একটি অন্যতম ডাক। আমাদের উচিৎ রমজানের এ ডাকে সাড়া দিয়ে গরীব দুঃখীর সাহায্যে হাত এ মাসে আরো বাড়িয়ে দেয়া। বেশি করে দান, সদকা ও যাকাত- ফিতরা আদায় করে তাদের অভাব মোচনে এগিয়ে আসা। ইসলামের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ আমাদেরকে সে শিক্ষাই দিয়েছেন।
বুখারী শরীফের ১৯০২ নং হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন “মানুষের মধ্যে কল্যাণের পথে সবচেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন নবী করীম স.। আর রমজান আসলে তার দানের মাত্রা আরো বেড়ে যেত যখন জিব্রাইল আ সাক্ষাত করতেন। জিব্রাইল আ. রমজানের প্রতি রাতেই তাঁর সাক্ষাত করতেন, এ সময় তার দানের উদাহরণ প্রবাহিত বায়ুর ন্যায়।” সুবহানাল্লাহ। বাতাস যেমন সকল কিছুকে ছুঁয়ে যায়, তেমনি নবী স. এর রমজান মাসের দান সকলের উপর দিয়ে নির্বিশেষে বয়ে যেত। মূলত: নবী করীম স. সব সময়ই দান করতেন। মুসলেম শরীফের ৬১৫৮ নং হাদীসে বর্ণিত হয়েছে “প্রিয় নবীজীর কাছে এমন কোন সুয়াল করা হয়নি যাতে তিনি ‘না’ শব্দটি বলেছেন।” অথচ আমরা অহরহ ভিখারী-সুয়ালকারীকে ‘না বা নেই’ বলে ফিরিয়ে দেই। প্রিয় নবী স. কখনও কাউকে ফিরাতেন না। মুসলিম শরীফের ৬১৬০ নং হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে- নবী করীম স. এর কাছে যে যা সুয়াল করতো তিনি তাকে তা-ই দিয়ে দিতেন। একবার এক লোক এসে তাঁর কাছে একটি বকরী প্রার্থনা করল। প্রিয় নবী স. তাকে একটি বকরী দিয়ে দিলেন। এতে সে লোকটি তার কওমের নিকট ফিরে গিয়ে বলল হে আমার কওম, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো, কারণ ইসলামের নবী মুহাম্মাদ এমনভাবে দান করেন যে, সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়া বা দারিদ্র্যের ভয় তিনি করেন না। সুবহানাল্লাহ। নবী স. এর দানের কারণেই অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে ভিড় জমিয়েছে।
এ রমজানে একটি নফল দান অন্য মাসের একটি ফরজ দানের সমতুল্য। একটি ফরজ দান ৭০ থেকে ৭০০ গুণ কিংবা তারও বেশী ফজীলত সম্পন্ন। রোজা রেখে আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে ক্ষুধার্তদের খাবার দিব, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দেব, সকল অভাবীর একান্ত আপন হয়ে পাশে দাঁড়াব, এটাই রমজানের অন্যতম শিক্ষা।
আর সাহায্যের বেলা গরীব দুঃখীর তাকওয়া বা ইমান যাচাই করে দান করতে বলা হয়নি কোথাও। মুসলিম শরীফের ২৪০৯ নং হাদীসের বক্তব্যটি আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে তোলে। “নবী স. ইরশাদ করেন- এক ব্যক্তি রাতের গোপনে তার সদকা নিয়ে বের হল। অতপর যাকে দিল সে মহিলাটি ছিল একটি যেনাকারিণী মহিলা। সকালে লোকেরা ঠাট্টাচ্ছলে বলাবলি করতে লাগল, আজ রাতে এক লোক তার সদকা এক যেনাকারিণীর হাতে দান করেছে। এসব ঠাট্টা শুনে সে বলে উঠল
হে আল্লাহ, তোমার প্রসংশা যে, আমার সদকা যেনাকারিণীর হাতেও পৌঁছেছে। এর পরের রাতে সে আবার একটি সদকা করল। পরের সকালে আবার লোকেরা বলাবলি করতে লাগল- আজকে এক লোক তার সদকা দিয়েছে এক ধনী লোকের হতে। সে আবার বলে উঠল, হে আল্লাহ তোমার প্রসংশা যে, ধনী লোকও আমার সদকা পেয়েছে। অনুরূপ পরের রাতে সে এক চোরের হাতে দান করলে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর সে একই ভাবে আল্লাহ প্রসংশা করে তৃপ্তি লাভ করতে থাকে যে, তার দান চোরের হাতেও পৌঁছেছে। অতপর তাকে স্বপ্নে দেখানো হয় যে, হে দানকারী ব্যক্তি, নিয়তের একনিষ্ঠতার কারণে তোমার সদকা কবুল হয়ে গেছে। এমনকি যেনাকারিণীর পেটে হালাল খাবার পড়ার কারণে সে সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। যেনা করা চিরতরে পরিত্যাগ করেছে। অনুরূপ চোর পরিত্যাগ করেছে চুরি। আর ধনী ব্যক্তি, সে নিজে দান করার শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সুবহানাল্লাহ

অপরদিকে কাউকে কিছু দিলে এ দানে পক্ষান্তরে লাভ হবে আমাদেরই। এর দ্বারা আমাদেরই গুনাহ মাফ হবে। অগণিত সাওয়াব আমলনামায় জমা হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা একথা বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেমন সুরা বাকারার ২৬১ নং আয়াতে মুমিনের দানকে তুলনা করেছেন- একটি শস্য দানার সাথে। যা থেকে একটি চারা গাছ গজিয়ে ওঠে। পরে তার গোড়া থেকে মোট ৭টি গাছ গজিয়ে ওঠে। প্রত্যেকটিতে ১০০ করে ধান বা শস্য হলে মোট ৭০০ শস্য পাওয়া যায়। আবার একই সুরার ২৬৫ নং আয়াতে দানকে তুলনা করেছেন উঁচু টিলায় অবস্থিত বাগানের সাথে। যেখানে বৃষ্টিপাতের কারণে ফল দ্বিগুণ পরিমাণে পৌঁছে। অনুরূপ দানের কারণে মুমিনের নেক আমলের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
ইসলাম সমাজের ভারসাম্য বিধানকারী একটি সফল ব্যবস্থার নাম। এখানে দানকারীকে বলা হয়েছে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে আসলেও সুয়ালকারীকে কিছু দাও। ফিরিয়ে দিও না। আবার ভিখারীকে বলা হয়েছে- অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাক।
বুখারী শরীফের ১৪৭২ নং হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী স. এক সাহাবীকে একবার, দুইবার, তিনবার পর্যন্ত দিলেন। অতপর বললেন হে হাকীম, এসব মাল হচ্ছে সবুজ ও মিষ্টি, অর্থাৎ লোভনীয় বস্তু। যে অভাবে পড়ে কিছু গ্রহণ করে, আল্লাহ তাতে বরকত দিবেন। আর যে বিনা প্রয়োজনে সুয়াল করবে, তাতে বরকত দিবেন না। তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির মত, যে খায় কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না। তখন হাকীম ইবনু হিযাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন সেই মহান সত্তার কসম, দুনিয়া ছেড়ে বিদায় হওয়া পর্যন্ত আর কোন দিন কারো কাছে আমি কোন কিছু চাইব না। হযরত উমর রা. বলেন – হে লোকসকল, আমি সাক্ষী আছি যে, হাকীম ইবনু হিযাম মৃত্যু পর্যন্ত আর কারো কাছে কিছু সুয়াল করেনি।
অপরদিকে অকাতরে দানের জন্যে এবং দান না করার ক্ষেত্রে এমন কঠোর হুশিয়ারি আছে যে, গা শিউরে উঠে। দালায়েলুন্নবুয়্যাতের ৬ষ্ঠ খ- ৩০০ পৃষ্ঠায় (শামেলা) উল্লেখ আছে ‘নবীর স্ত্রী উম্মে সালামা রা. কে একটু গোশত হাদিয়া দেয়া হয়েছিল। পরে ক্ষুধা নিয়ে নবী স. ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলেন কোন খাবার আছে কিনা। তখন উম্মে সালামা বললেন হ্যাঁ একটু গোশত আছে। এই বলে গিয়ে দেখলেন সেখানে এক টুকরা পাথর হয়ে আছে। ঠিক গোশতের পরিমাণেই। সবকিছু শুনে নবী স. বললেন কোন ভিক্ষুক এসেছিল কিনা, যাকে তোমরা ফিরিয়ে দিয়েছ। উম্মে সালামা বললেন- হ্যাঁ, একজন ভিক্ষুক খাবার চেয়েছিল। তাকে না দিয়ে গোশতটুকু আপনার জন্য রেখে দিয়েছি। তখন প্রিয় নবী স. বললেন, ক্ষুধার্তকে খাবার না দেয়ার কারণে আল্লাহ রাগ করে গোশত টুকরোকে পাথরে পরিণত করে দিয়েছেন।
আমাদের ভাবা দরকার যে, ক্ষুধার্তকে না দিয়ে খাবারটুকু স্বয়ং নবীর জন্যে রেখে দিলে- তাও যদি পাথর হয়ে যায়, তাহলে আমরা ক্ষুধার্তকে না দিয়ে কার জন্যে জমা রাখছি? এরকম শত শত হাদীসে শত ঘটনা এবং শত শত আয়াতে দানের বর্ণনা আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন। যা এই স্বল্প পরিসরে গুছিয়ে বর্ণনা সম্ভব নয়। তাই সংক্ষেপ কথা হল আসুন রমজানের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা গরীর দুঃখীর সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

আমরা রোজাদার হই

আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রামাদ্বান। রহমত, মাগফিরাত, আর নাজাতের স্রোতদ্বারা বয়ে যাবে এ মাসে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *