রামাদ্বান ও ঈদ নিয়ে একটি রোমান্টিক উপস্থাপনা একজন হুজুর ও আমরা দুই বন্ধু

[বছর ঘুরছে তাই রামাদ্বান মাস এসে হাজির হচ্ছে। সারা দেশে সারা মানুষের কাছে ব্যাপক উদ্দীপনাময় কর্মব্যস্ততা ও প্রস্তুতির কাজ চলছে। মানুষের আকল বিবেক আর রামাদ্বানকে আল্লাহ পাক এমন কুদরতী ভাবে পয়দা করে রেখেছেন যে, এই রামাদ্বানকে ঘিরেই সারা মানুষের হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ধরণের উৎসব আমেজ আর আনন্দ হিল্লোল। তো রামাদ্বানের আগমনে আমাদের কিছু আত্মিক প্রস্তুতির একটা মানে রয়েছে। এর এত্তো গুরুত্ব ও ফজীলত যে, আমার মন মানস এমনিতেই নিবেদিত হতে বাধ্য হচ্ছে। তাই, যদি এবার রোমান্টিক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা যায়, মনে হয় ফলদায়ক ও মজাদার হবে। পড়ার ভুবনে সবাইকে স্বাগতম। অগ্রীম রামাদ্বান মোবারক, ঈদ মোবারক। দুআপ্রার্থী-লেখক] সংলাপ: একজন হুজুর, আমি (লেখক) ও বন্ধু আবতাহী
আমি: আসসালামু আলাইকুম হুজুরজী! কেমন আছেন?
হুজুর: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ফাদ্বলুল্লাহ- ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? কোন খবর আছে?
আমি: জী আপনার দোআর বরকতে আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি। সবকিছু চলে যাচ্ছে ভালোই। সামনে রামাদ্বান আগমন করছে। একটা আনন্দ কাজ করছে আমাদের মাঝে। মনে পড়ছে, ইফতারের সেই মায়াবী পরিবেশ-বাহারী সমাহার, সাহরীতে সেই আলো-আধারীর মিলন মুহুর্ত! কোন ভাষায় সেই আনন্দের কথা বর্ণনা করা যায় না হুজুর। রামাদ্বান এলেই যেন ভূ-চর, নভো-চর, জল-চর সবকিছুতে যেন একটা আলোকিত পরিবর্তন বিরাজ করতে দেখা যায়। নিজের সাথেও যেন মানিয়ে যায় বেশ। কারণ কি হুজুর?
হুজুর: তোমার অনুভূতিটা তো দারুণ হয়েছে। সত্যিই তাই। আমারও এমন মনে হয়। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে কি আর পারি? পারিনে! আমাদের মানুষের এই সাদাসিধে মনোভাবও আল্লাহ কবুল করলে পারেন। এসব অনুভূতি ধরা দেয় শুধু রামাদ্বান এর কারণেই। রামাদ্বানের কত যে ফজীলত! আল্লাহ রহমান রহীম। বহু হাদীস শরীফ বর্নিত হয়েছে। মূল কথা হলো, রামাদ্বানের রোজা একজন মানুষের জন্য ঢাল স্বরুপ। অন্যায় অপরাধ কিছু করতে গেলেই মানুষের মন বাধ সাধে। একজন সাধারন মানুষ খেতে পারে না, পান করতে পারে না, গিলতে পারে না, সহবাস করতে পারে না। আরেকজন আমলদার সাধারণ মানুষ এগুলোর সাথে সাথে মিথ্যা বলতে পারে না। চুরি করতে পারে না। অন্যায় করতে পারে না। আরেকজন ওলীআল্লাহ আলেম এগুলোর সাথে সাথে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। সারাক্ষণ খোদার সস্তুষ্টির চিন্তÍায় মগ্ন থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইত্তেবায় বিভোর থাকে। তাহলে বলো, মানুষের মাঝে কি চিন্তÍার পরিবর্তন না এসে পারে!
আমি: হুজুর! শুনেছি, রামাদ্বানে নাকি মানুষের মাঝের বিভেদ দূর হয়। বিশেষত তারাবীর সেই সুদীর্ঘ নামাজে সবাই যেন এক কাতারী হয়ে যায়। যার কারণে ভেদাভেদও নাকি আর থাকে না। আসলে কি হুজুর?
হুজুর: শোন, তুমি যা বললে ঠিকই বলেছো। বিভেদ দূর হয়। একে তো রামাদ্বানের কারণে পরস্পরের মাঝে বিবাদ দূরীভুত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত তারাবীর দীর্ঘ নামাজে সবাই এক কাতারী হয়ে যায়। সব দু:খ-সুখ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কবি জসিম উদ্দীন এ উদাহরণ স্পষ্ট করে দিয়ে অমর হয়ে কবরে আছেন। তিনি বুঝাচ্ছেন সে কথাই-
গইজদ্দীন গরু ছেড়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান,
ইচ্ছা করিছে থাপ্পড় মারি, ধরি তার দুটো কান।
তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে হবে,
আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে।
মৈজদ্দীন মামলায় করেছে মোরে ছারখার,
টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার।
আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে,
তাহারে ভালোর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে।
মাহে রামাদ্বান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়,
কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়।
আমি: আল্লাহ তোমার শোকর! আজই প্রথম- বিভেদ দূর হওয়ার সিস্টেমটা আমার বুঝে আসলো। সত্যি, আল্লাহ পাকের এ এক দারুণ নিজাম ও বিধান! সমাজের লোকদের এ বিষয়টা খুব করে বোঝানো দরকার হুজ্রু। সুদীর্ঘ নামাজ তারাবীর নামাজ, তাই এ নামাজ এবং সূর্যের উদয়াস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমেই মুলত: বিশৃংখলা দূরীকরণ সম্ভব। আচ্ছা, হুজুর! রামাদ্বানের সবচেয়ে বড় চাহিদা কি?
হুজুর: গুনাহ মাফ হওয়া। তাই আমাদের কাছে সওদা হিসেবে এসেছে এই মাহে রামাদ্বান। রামাদ্বানের মাধ্যমে গুনাহকে মিটিয়ে দেওয়া। হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী, নবীজী মিম্বরের একটি সিড়ি ওঠেন আর আমিন বলেন। এভাবে তিনটি সিড়ি অতিক্রম করলেন আর আমিন বললেন। সাহাবীরা কারণ জিজ্ঞেস করলে নবীজী তার উত্তর করলেন, জিবরাইল এসেছিলেন। তিনি বললেন, যে পিতামাতাকে পেলো, কিন্তু জান্নাত ক্রয় করতে পারলো না- সে ধ্বংস হোক, আমি বলেছি আমিন। আবার বললেন, যে রামাদ্বান পেলো, কিন্তু নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না- সে ধ্বংস হোক, আমি বলেছি আমিন। আবার বললেন, যে নবীর নাম শুনবে কিন্তু দুরুদ পড়লো না- সে ধ্বংস হোক, আমি বলেছি আমিন।
কবি নজরুল ইসলাম আরো আকর্ষণ করেছেন আমাদেরকে আমাদের মাতৃভাষায় ছন্দ রচনা করে-
ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর,
বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।
জীবন ভরে করলি লোকসান আজ তার হিসাব খতিয়ে নে,
বিনি-মূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতি নজর।।
কোরানের ঐ জাহাজ বোঝাই হীরা মুক্তা পান্নাতে,
লুটে নে রে লুটে নে সব ভরে তোল তোর শুন্য ঘর।
…এমন সময় আবতাহী ভাইয়ের আগমন….
: এই আবতাহী, কবি নজরুলের “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ…” এটার পুরো কবিতা কোথায় আছে নিয়ে আয় জলদি।
…সাথে সাথেই প্রস্থান আবতাহীর এবং উধাও…
… হুজুর আবার বলা শুরু করলেন…
রামাদ্বানের লাইলাতুল ক্বদরে তো কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসকে বলা হয় কোরআনের মাস। আয়াত আছে, হাদীস আছে। এ রাতে কুরআন তেলাওয়াত করলে অনেক ফায়দা। এখনকার মানুষগুলো আর কুরআন তেলাওয়াত করে না। তেলাওয়াতের কথা মনেও পড়ে না। অথচ কুরআন আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। দুনিয়ার সব কাজ হচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না কুরআন তেলাওয়াত। শয়তান তাই আরো শক্তভাবে দৃঢ়ভাবে জেঁকে বসেছে। অর্থ্যাৎ বান্দা কুরআন থেকে দূরে থাকবে, শয়তান ততই কাছে আসবে। তাই প্রিয় পাঠক, কুরআন তেলাওয়াত তো আমাদেরই করতে হবে। আমরা তেলাওয়াত না করলে আর কারা তেলাওয়াত করবে? কাদের কন্ঠে বাজবে কুরআন পাঠের সেই হৃদয়গ্রাহী সুর? কার কন্ঠসুরে নিজের কিংবা অন্যের মন আমোদিত হবে? চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরবে? অথবা আশা জাগবে, ভয় বাড়বে? আমি তো জানি, আমার তো বিশ^াস, আমি কুরআন তেলাওয়াত শুরু করলেই ধরার বুকে আবার জারী হয়ে যাবে কুরআন তেলাওয়াতের সেই সুমধুর সুরের গুঞ্জরণ! এবং তা বহমান রবে পরম্পরায়।
তুমি কুরআন বুঝতে চাও, তেলাওয়াতের স্বাদ নিতে চাও? তাহলে তোমাকে কুরআন পড়তে হবে। কুরআনের প্রেমিক হতে হবে। কুরআনের কিতাবটা আগে হাতে নাও না ভাই! একটু পড়েই দেখো না! নিজে না চাটলে কি স্বাদ বিশ^াস করা যায়! একটা গজল আছে না!
“প্রেমিক বিনে কে বুঝিবে কুরআনের বয়ান,
আশিক বিনে কে বুঝিবে মোর নবীজীর শান।”
কুরআন পাকের ইতিহাস পড়েছো! জানা আছে কিছু! অবাক হতে হয়, কুরআনের প্রভাব দেখে। কি এমন লুকানো রয়েছে, যার ছোঁয়ায় মানুষের আমূল পরিবর্তন হচ্ছে! বিশ^াস হয়না! তুমিই পরখ করে দেখতে পারো এভাবে, যার সামনেই কুরআনের মধুর বাণী তেলাওয়াত করবে, দেখবে- নিষ্পাপ শিশুর মতো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কালামে পাক শুনছে। সত্য। একেবারে সত্য। তুমি এখনি মোবাইল বা কম্পিউটারে তেলাওয়াত অন করো, দেখো একই হালাত পয়দা হয়েছে তোমার শুকনো অন্তরে। এ কারণেই নবীজীর উপর এমনি মো’জেজার কারিশমা- ‘কুরআনুলকারীম’ নাজিল করা হয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষী, হিজরতের সময় হযরত জা’ফর বিন সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দয়ালু বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে অবস্থান নিয়েছিলেন। এসময়েও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কত কি ষড়যন্ত্র! কিন্তু বাদশাহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। তিনি বিষয়টা গভীরভাবে ভাবলেন। তাই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তখন নিষ্ঠাবান ও অকুতোভয় সাহাবী জা’ফর বিন সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এক তেজোদীপ্ত ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে বাদশাহর টনক নড়েছিল। তারপর সুরা মরিয়মের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আবারো বলছি, ইতিহাস সাক্ষী- সে অমীয় তেলাওয়াত শুনে বাদশাহ নাজ্জাশী না জানা সত্যের টানে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দুচোখ থেকে ঝরেপড়া অশ্রুজলই তার সাক্ষী। দুচোয়াল সে পানিতে সিক্ত হয়েছিল। শুভ্র দাঁড়িগুলো ভিজে গিয়েছিল। ব্যস, বিচার এখানেই শেষ। তখন বাদশাহ মুশরিকদের, কাফিরদের এবং উপস্থিত সকলকেই- ইসলামের জন্য সবটুকু শ্রদ্ধা ও ভালবাসা উজাড় করে বুক ফুলিয়ে তেজোদীপ্ত মুখে বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই এটা (এই কুরআন) আর হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে যা এসেছে, তা একই চেরাগের সলতি।” ইসলামের জয় এখানেই।
হজরত আমর বিন মুররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, আমর! তুমি একটু কুরআন পড়ে শুনাও। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কুরআন তো আপনার উপর নাজিল হয়েছে, আমি কি আপনাকেও কুরআন পড়ে শুনাবো!? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমর, আমি অন্যের থেকে তেলাওয়াত শুনতে খুব পছন্দ করি। অত:পর সুরা নিসা তেলাওয়াত করতে লাগলাম। করতে করতে যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত আসলাম, আয়াতটি হলো
Ñ“সুতরাং সেই দিন কি অবস্থা হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং হে নবী, আমি আপনাকেও ওইসব লোকদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরুপে উপস্থিত করবো! ”
নবীজী তখন বললেন, আমর! হয়েছে, এবার থামো। চক্ষু তুলে তখন দেখি, নবীজীর নূরময় আঁখি মোবারক থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে! নবীজী কাঁদছেন!
এই যে অন্যের থেকে কুরআন শ্রবণ, এর অনেক ফায়েদা রয়েছে। এবং আরো বিস্ময়কর প্রভাব। সহজেই মন-মেজাজ ধীর ও শান্ত হয়ে আসে। শুষ্ক অন্তর সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কলব- কুরআনের ঐশী শক্তিতে হয়ে ওঠে বলীয়ান। আল্লাহ ও তাঁর পিয়ারা নবীর ভক্তিতে ও বিশ^াসে ঈমান বেড়ে- হয়ে যায় দ্বিগুণ। খোদাভীতিতে হৃদয় হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ। এক আয়াত শোনে, তো মনে মনে বলে ওঠে, আহ! এ কুরআন কি যে মধুময়!… কি যে তৃপ্তিময়!… অন্তর ছুয়ে যায়… পাথুরে হৃদয় আপছে আপ গলে যায়… সত্যিই বিস্ময়কর! প্রিয় পাঠক! এগুলোই তো সম্পদ! তাহলে কি কুরআন কি তেলাওয়াত করতে হবে না? আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। কুরআন সম্পর্কে লেখকের কাব্যিক রচনা-
কুরআন তালিমে নেইকো শক শ্রেষ্ঠ ইবাদাত,
এমন কাজে রইলে রত করবে শাফায়াত।
কুরআন তেলাওয়াত করলে পরে লভিবে অসম বল,
যখন তুমি যেভাবেই পড়ো, পাবে শুধুই আজর-ঢল।
ভক্তিমনে কুরআন পড়ো নামবে চোখে অশ্রুজল,
সে জলেতে সিক্ত হবে তোমার দেহ-কায়া-মন।
মধুর সুরে শুনলে কুরআন, পরাণ গলে যায়-
তখন আল্লাহ-রাসুল ছাড়া মোর কিছুই নাহি চায়। (Ñলেখক)
…. কিরে! কি ভাবছিস? তন্ময় হয়ে গেলি যে! পলক ফেল। কথা ক।
আমি: হুজুর, আপনার বর্ণনায় কুরআনের কারিশমা শুনে আমি বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছে- কুরআনের প্রতি আমার স্বত্তার ভিতর একটা ঢেউ, একটা স্পৃহা, একটা উদ্দীপনা, একটা প্রেম কাজ করছে। হুজুর, কুরআন আমাকে পড়তেই হবে। আমি পড়া শুরু করবো এবং জারী রাখবো ইনশাআল্লাহ। আপনি দুআ করেন।
হুজুর: তোমার জন্য দুআ করলে আমার লাভ। সত্যিই তুমি তেলাওয়াত শুরু করলে আমি সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাবো। বরং এ কাজের মাধ্যমে তুমি আমার এই একটু উপকার করো।
হুজুর: আচ্ছা, যাই হোক। আমরা এবার একটা পর্যায়ে আসতে পারি। প্রথমত বলি রোজার ফজিলত সম্পর্কে। জানার দরকার আছে না! আসলে রোজার ফজীলতগুলো জানতে শুনতে এত ভালো লাগে যে, ওতেই বান্দার জন্য যথেষ্ঠ হয়ে যায় রোজাকে বরণ করার জন্য। শোন তাহলে,
-“আর তোমরা যদি বুঝতে তবে সিয়াম পালন করাটাই তোমাদের জন্য অধিক মঙ্গলের হতো।”
-“রোযা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমি নিজেই দেবো।”
-“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোযা রাখবে তার পিছনের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শিকল লাগিয়ে আবদ্ধ করা হয়। (বুখারী হাদীস নং ১৭৭৫, মুসলিম: ২৩৬৫)
-“হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন বান্দার সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কুপ্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমাদের সুপারিশ কবুল কর। অত:পর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (বায়হাকী)
আমি: হুজুর, মসজিদে অনেকে ইতেকাফে বসেন। কিন্তু ঠিকমত পালন করেন না। গল্পগুজব করে কাটান। কিংবা অলস সময় পার করেন। শুধু শুধু অথবা প্রয়োজনেও মসজিদের এরিয়ার বাইরে যেয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন। এভাবে তো ইতেকাফের যে সৌন্দর্য, তা তো অর্জিত হতে পারে না। আসলে ইতেকাফের অর্ন্তভূক্ত বিষয় বা সৌন্দর্য কি- বলবেন কি?
হুজুর: ভালো একটা প্রশ্ন করেছো। সমাজে এখন হক আদায় করে ইতেকাফ পালন করা হয় না বললেই চলে। এভাবে ইতেকাফ শুদ্ধও হতে পারে না। মুলত: প্রত্যেকটি জিনিসের সৌন্দর্য আছে। যার বিপরীত দেখা গেলেই তার অসৌন্দর্যতা বৃদ্ধি পায় তখন এটাকে মানানসই দেখায় না। অনুরূপভাবে ইতেকাফের সৌন্দর্য বিদ্যমান।
ফতোয়ায়ে আলমগীরী কিতাবের ১ম খণ্ডের ২১২ পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে- ইতিকাফের সৌন্দর্যাবলী সুস্পষ্ট। কারণ এতে ইতেকাফকারী সর্বস্ব আল্লাহর ইবাদতের প্রতি নৈকট্য লাভের নিমিত্তে বিলিয়ে দেয়। এবং নিজেকে দুনিয়াবী কর্মব্যস্ততা থেকে দূরে রাখে, যা বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ থেকে বাধা প্রদান করে। ইতেকাফকারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার সময় গুলোকে নামাজে ব্যস্ত রাখে। কারণ ইতেকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো- জামাতে নামায আদায় করার অপেক্ষায় থাকা। স্বয়ং ইতেকাফ কারীর তুলনা হল ঐসব আত্মার সাথে যারা আল্লাহর হুকুমের নাফরমানী করেনা, যা তাদেরকে আদেশ করা হয় তা তারা পালন করে এবং সে সব লোকের সাথে (ইতেকাফকারীর তুলনা) যারা রাত দিন আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। আর একটি সৌন্দর্য্য হলো ইতেকাফকারীর পক্ষে রোযা থাকা শর্ত। কেননা রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান। (ফতোয়ায়ে আলমগীরি ১/২১২)
আমি: হুজুর! একজন রোজাদার মুমিনের জন্য ঈদ কতটা আনন্দময়- অনেকেই উপলব্ধি করে, অনেকে করে না। কিন্তু কবি কাজী নজরুল ইসলাম এও আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। কত গাফলতের মানুষ আছে, যারা ঈদের আনন্দই বোঝে না। অথবা এটা যে আনন্দের একটা দিন- তা লাফালাফি, আতশবাজি, নাচানাচি আর বেহায়াপনা চিল্লাচিল্লির মাধ্যমে পালন করাকে বোঝে। আপনিও হয়তো অবাক হয়ে যাবেন- ঈদ সত্যিই এতো এমন নির্মল আনন্দের! এতো উজ্জ্বল খুশীর! পবিত্র অনুভূতিরও বিষয় যে!
হুজুর: আমার বিশ^াস, নজরুলের ঈদসংক্রান্ত কবিতাগুলো তুই-ই বলতে পারবি। বল, বল তাড়াতাড়ি বলে ফেল। আহ, এই বুড়ো বয়সেই শুনতে হলো তার কবিতা!
আমি: আসলে হুজুর সত্যি কথা কি! কাজী নজরুল ইসলামের ঈদ অনুভূতি জানার মাধ্যমে মনে হবে, এখন থেকেই যেন নতুন ঈদ শুরু। আজই আমার প্রথম ঈদ, যাতে ছিলো পবিত্র অনুভূতিতে ভরপুর। তাহলে বলছি শুনুন- যেমন তিনি বলেছেন,
আজ নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে নীল আকাশের গায়
তোরা দেখবি কারা ভাই-বোনেরা আয়রে ছুটে আয়।
ঈদের খুশির তুফান আজ ভাসলো দো-জাহান
এই তুফানে ডুবুডুবু জমিন ও আসমান।
হুজুর: দেখেছ, কত সত্যি হয়ে গেল তার কবিতা! আজকাল আমরা যারা বড় হয়ে গেছি, ঈদের চাঁদ আর দেখি না। ছোটকালে খুব দেখতাম। বড়কালে কি নিষেধ? ছোটকালে ঈদের শুরুটা হতো আনন্দ দিয়ে। কিন্তু আমাদের কি আর আনন্দ দিয়ে শুরু করা হয়? এই আনন্দ করা কি ইবাদত নয়? চাঁদ কি আল্লাহর সৃষ্টি নয়? অথচ কবি আমাদেরকে কিভাবে ঈদের আনন্দ শুরু করতে বললেন!
“এল ঈদুল-ফেতর এল ঈদ ঈদ ঈদ।
সারা বছর যে ঈদের আশায়
ছিল নাকো নিদ।
রোজা রাখার ফল ফলেছে দেখরে ঈদের চাঁদ।
সেহরী খেয়ে কাটল রোজ আজ সেহেরা বাধ।
ওরে বাধ আমামা বাধ
প্রেমাশ্রুতে অজু করে চল ইদগাহ মসজিদ।”
হুজুর: দেখ, আমাদের ঈদ পালন আর তার কবিতার বর্ণায়ন! হে কবি নজরুল, তুমি সবাইকে শিখায়ে দিলে- ঈদের দিন যখন আসবে, যার জন্য সারা বছর ঘুম ছিলো না, রোজা না হলে আমরা পেতাম না এ দিন। তুমি আহ্বান করলে, তাই তোমরা পাগড়ী বেঁধে সেজেগুজে ঈদগাহ মসজিদে চলো- আর অশ্রুসজল চোখে গিয়ে প্রেম নিবেদন করো আল্লাহর কুদরতি কদমে!
“তোর পাশের ঘরে গরীব কাঙ্গাল কাঁদছে যে
তুই তাকে ফেলে ঈদগাহে যাস সৎ সেজে।”
জীবনে যাদের হররোজ রোজ
ক্ষুধায় আসেনা নিদ,
মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে
এসেছে কি আজ ঈদ।
হুজুর: আফসোস, আমরা এ বিষয়ে খুবই গাফলতে থাকি। ঈদের সাজে নতুন সেজে আমরা একধ্যানে হেঁটে চলে যাই ঈদগাহে। আমাদের ঈদের আনন্দ যে মাটি হয়ে যাচ্ছে- তা আমরা এ বয়সেও বুঝতে পারিনি। কিন্তু তুমি হে কবি! তুমিই অনুভব করেছিলে। এ ব্যাপারেও সতর্ক করে অমর হয়ে রইলে! এখন তো মনে হচ্ছে- ৬০ বছরের ১২০টা ঈদ কোথায় ধুলীস্মাৎ হয়ে গেলো! সেই আনন্দগুলোও যেন ম্রীয়মান হয়ে গেলো! হায়….
আমি: আল্লাহ কুবল করুন আমিন। তো হুজুর, আমি কিন্তু কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐ কবিতাটি পারি, যেটা আবতাহীর কাছে চেয়েছেন। আসলে তার বহু কবিতা ও অসংখ্য রচনাবলী আছে আমার কাছে। খুব মনোযোগ দিয়ে বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করি। তো কবিতাটি প্রথম পড়ার সাথে সাথে মনে হলো, যেন নজরুল-চুম্বকেই আমার মুখস্থ হয়ে গেলো। মনের সুরে প্রায়ই গাই। কি মায়া ভরে তিনি আমাদেরকে আকর্ষণ করছেন! বলবো হুজুর, আমি বলবো?
হুজুর: বল দেখি!
আমি: আমার হৃদয়ের কবি, ভালোবাসার কবি জাতীয় কবি ও শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশীর ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানী তাকিদ।
তোর সোনাদানা বালাখানা
সব রাহে লিল্লাহ,
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ
ভাঙাইতে নিদ।
তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন
সেই সে ঈদগাহে,
যে ময়দানে সব গাজি মুসলিম
হয়েছে শহিদ।
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন
হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ^ নিখিল
ইসলামে মুরীদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা
নিত্-উপবাসী,
সেই গরীব মিসকিনে দে
যা কিছু মুফীদ।
হুজুর: তোর কন্ঠেও বুঝা যায়, নজরুলের প্রতি তোর আলাদা টান আছে। আলাদা প্রেম আছে। আলাদা ভক্তি আছে। একেবারে সবার থেকেই আলাদাও বটে। ভালো। খুব ভালো। তো কি বুঝলি কবিতাটি থেকে?
আমি: হুজুর, আমি বুঝেছি। সত্যই বুঝেছি। তিনিই তো স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘ও মন রমজানের ঐ…’ এমনি একটি কবিতা, যাতে বলে দেওয়া হয়েছে, রামাদ্বানের পরে যে ঈদের আগমন হবে- তা কিভাবে কাটাতে হবে! খুশীর জোয়ারের মাথায় আমার কি করণীয়! খুশীটা কিভাবে কাটাবে! গরীব দু:খীদের সাথে কি করতে হবে! একেবারে নগদ পেয়ে গেলাম। কুরআন হাদীস আমার মতো সাধারণ মানুষ কি জানে? জানে না। কিন্তু এ কবিতাটি পড়ে সে অনায়াসেই বুঝতে পারবে। আল্লাহর শোকর!
হুজুর: তুই যে দেখি নজরুল দেওয়ানা! মানুষের সাথে চালাকি চালায়ে দিতে পারিস নজরুলের কবিতা দিয়ে!
আমি: কি যে বলেন হুজুর! আপনার কথা মেনে নিলেও কি আপনার কোন আপত্তি থাকবে? এরকম আরো সংলাপ আছে, যা আসলে এখানে তুলে ধরা সংগত হবে না।
….হঠাৎ আবার আবতাহীর আগমন….
সেই কখন গিয়েছিলো কবিতা খুজতে। আর আসলো অবেলায়। হুজুর এখনি চলে যাবেন। অন্য একটা কাজের তাড়া আছে। শুকরিয়া, তিনি আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন। অনেক মজাদার আলাপ হলো। আমারো সময়টা ভালো কাটলো। নিজেকে খুব হালকা বোধ করছি। অনেক অনুভূতি অর্জিত হয়েছে। হুজুর পরে আরো সময় দিবেন বলে বিদায় নিলেন। রয়ে গেলাম আমি আর আবতাহী।
এখন বিকেল। হাঁটছি দুজন। চলছি গল্প করতে করতে। আমার অভ্যাস- বাস্তব গল্প বলা, বিশেষত জীবনের গল্প। এজন্য অবাস্তব কিংবা ফাউল গল্পের জলসায় আমার মুখ থাকে বন্ধ। তো আমি বলা শুরু করলে শেষ হয় না। তাই আজ চুপ করে আছি। ও হঠাৎ বলে উঠলো, যেন কতকটা ভয়েই- বাতাস! বাতাস! ঝড়ের পূর্বাভাস। তবু সামনে গেলাম। নদীর পাড়ে এসে থামলাম। আবতাহী আমাকে বললো, সামনে রামাদ্বান আসছে। এবারে কিন্তু ভালো ভাবে কাটানো চাই। বলতো কিভাবে করা যায়! আমিও ভাবতে লাগলাম কিভাবে রামাদ্বানটা কাটানো যায়! হুজুরের বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। হুজুর তখন যা বলছিলো, সেগুলো ফাঁকে ফাঁকে তুলে রেখেছিলাম কাগজের ফ্রেমে। সেগুলো তাকে দেখালাম। সে অবাক হয়ে গেলো। সে এতো খুশী হলো যে, আমাকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলো। লেখাগুলো বারবার পড়তে লাগলো। অন্তরে গেঁথে রাখতে চেষ্টা করলো। আমি দেখলাম, সে পড়ছে আর চেহারায় ঝিলিক খেলাচ্ছে। যেন হারিয়ে যাওয়া কি যেন খুঁজে পেলো। কিংবা তেষ্টা পেয়েছিলো পানি পেলো। পথ হারিয়েছিলো, দিশা পেলো। পড়া শেষ হলো, আমার জন্য অনেক দুআ করলো। আবেগে অনেক কথা বললো। আর সবশেষে কানের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় আওয়াজে বললো, দোস্ত…

Comments

comments

About

Check Also

আমরা রোজাদার হই

আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রামাদ্বান। রহমত, মাগফিরাত, আর নাজাতের স্রোতদ্বারা বয়ে যাবে এ মাসে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *