ব্যক্তি ও সমাজ জীবন উন্নয়নে রমজান

সময়ের আবর্তে আরবি সনের এগারোটি মাস অতিক্রম করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে মাহে রমজানুল মুবারক। বহু প্রতীক্ষিত বস্তু যখন সুন্দর উপস্থাপনায় কারো কাছে উপস্থিত হয়, তখন আর আনন্দের কোন সীমা থাকে না। তেমনি, চাতক পাখির ন্যায় এগারোটি মাস প্রতীক্ষার পর মুসলমানদের কছে যখন মাহে রমজানুল মুবারক উপস্থিত হয়, তখন প্রবাহিত হতে থাকে রহমাতের ঝর্ণাধারা। খুলে দেয়া হয় ক্ষমার দুয়ার। খুলে দেয়া হয় জান্নাত। আকাশের দরজা। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজা। কবর আযাব। শয়তানকে করা হয় শিকল বন্ধি। পবিত্র করে তোলা হয় মানুষকে। পাপ থেকে করা হয় মুক্ত। ধনীরা আদায় করতে থাকে গরীবের হক। আদায় করতে থাকে জাকাত। আদায় করে ফেৎরা। পাপীরা তওবার মাধ্যমে ফিরে আসে সত্যের দুয়ারে। ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে যায় একই কাতারে। শুরু হয় শন্তি, সৌহার্দের অপরুপ লীলা ও রহমাতের ঝর্ণাধারা।
কৃচ্ছসাধনা, ত্যাগ, সংযম এবং পরহিতৈষনার মহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় মাহে রমজান। এ মাসকে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু সিয়াম পালনের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-অনুক্ষণ আল্লাহ তা’আলার খাস রহমতে পরিপূর্ণ। এ মাস এক অসাধারণ মাস। নিঃসন্দেহে এ মাস স্বতন্দ্র ও মাহাত্ব্যের দাবি রাখে।
সমগ্র মুসলিম জাহানে রহমাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শুরু হয়। দীর্ঘ এক মাস ব্যাপি রমজানের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আল্লাহর তাকওয়া অর্জন ও এর সামগ্রিক সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে বিশ্বব্যপি মানবতার শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। রমজানের রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের রিপুকে আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিত করা হয়। অন্তরের পশু প্রবৃত্তি তথা নফসে আম্মারাকে বশীভূত করে মানুষ নফসে লাওয়ামা ও নফসে মুতমাইন্না (সর্বোচ্চ প্রশান্ত আত্মা) এর পর্যায়ে উপনিত হয়। প্রকৃত রোজাদার তাই এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের পর্যায় উপনিত হয়। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আর সত্যিকার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার ও সন্ত্রাস দুরীভূত হয়। গোটা ব্যক্তি জীবনে নিরাপদ ও নির্বিঘেœ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়। রোজার বিভিন্ন দিক নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।
এক. আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে রোজা। আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে রোজা একটি অপরিহার্য এবং চিরন্তন বা সকল যুগ ও কালের ইবাদত। রোযা কেবল মুসলমানদের জন্যই অপরিহার্য নয় বরং পূর্ববর্তিকালের সকল নবী- রাসুলের উম্মতের জন্যও অপরিহার্য ছিলো। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে, ‘‘রোজা তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তিদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পার।’’ (সুরা আল- বাকারা : ১৮৩) রোযার মাধ্যমে মানব হৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়েও মহান প্রভুর ভালবাসা ও ভয়ে বান্দার কিছুই গ্রহণ না করা, যাবতীয় অন্যায়- অনাচার থেকে বিরত থাকা তাকওয়ার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
দুই. রোজা আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন। রোজার মধ্যে কোনরুপ বাহ্যিকতা বা লৌকিকতা নেই। রোজা একমাত্র আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসার নিদর্শন। হাদিসে কুদসীতে মহান আল্লাহ তা’আলার ফরমান হচ্ছে, ‘‘রোজা কেবল আমার জন্যই, আমিই এর প্রতিদান দেব।’’
তিন. রোজা খোদাভীতি সৃষ্টি করে। রোজা আদায়ের মাধ্যমে মানব হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় বান্দা এসব থেকে বিরত থেকে রোজা পালন করে। আল্লাহর ভয় করার নামই তাকওয়া বা খোদাভীতি। আর রোজার মাধ্যমেই খোদাভীতি অর্জন করা যায়।
চার. রোজা গুনাহ মার্জনাকারী। করুণাময় মহান প্রভু রোজাদার বান্দার পূর্বকৃত সকল গুনাহ ও অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, যে ব্যাক্তি ঈমান ও আত্মবিশ্লেষনের সাথে রোজা পালন করে সে পূর্বকৃত সকল গুনাহ মার্জনা করে নিলো। প্রিয়নবী (সা.) আর বলেন, যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করে তারা সদ্যজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যাবে।
পাঁচ. রোজা ঢালস্বরুপ। যে ব্যক্তি রোজা রাখে, সে যাবতীয় অন্যায়, অনাচার থেকে রক্ষা পায়। রোজা মানুষকে ষড়রিপুর আক্রমণ থেকে ঢালস্বরুপ বাঁচিয়ে রাখে। কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা ইত্যাদি রিপুর তাড়নায় মানুষ বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। রোজা মানুষের এ সকল কুপ্রবৃত্তি দমন করে। এ কারণেই প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘‘রোজা ঢালস্বরুপ।’’
ছয়. রোজা আহারে সংযম করে। শুধু খাদ্য নয়, সকল অর্থনৈতিক প্রয়োজন সম্বন্ধে আমাদের আত্ম সংযম অভ্যাস করা উচিত। অর্থনৈতিক প্রয়োজনগুলোর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি। এ প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণে শক্তি অর্জন করতে পারলে অন্যান্য চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ভালো জামা না পেলে বা সোফা সেটে না বসলে বা মোজাইক করা রুমে বাস করতে না পারলে এতটুকু কষ্ট হয় না, যতটুকু কষ্ট হয় ক্ষুধার্ত দেহে ৬ ঘন্টা জাগ্রত থাকতে। ক্ষুধার তাড়নায় পিতা সন্তান বিক্রি করে, বাঘিনী সন্তানের ঘাড় মটকে রক্ত পর্যন্ত পান করে।
সাত. ধৈর্যধারণ। একজন মানুষ যখন নি:স্বার্থ ভাবে আল্লাহকে রাজী খুশি করার জন্য রোযা পালন করে তখন সে ব্যাক্তি তাওয়াক্কুল রাখতে ও সবর ধৈর্য ধারণ করতে শেখে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ধৈর্য ধারণকারীদের উপর খুশি হয়ে অসীম পুরস্কারে ভূষিত করেন। মহান আল্লাহর ফরমান হচ্ছে, ‘‘নিশ্চয় রোযাদারদের বেহিসাবে পুরস্কার দেয়া হবে।’’ (সূরা জুমার : ১০)
আট. মুক্তির উপায়। কিয়ামতের কঠিন মুহুর্তে রোযা বান্দার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোজা সুপারিশ করে বলবে, হে প্রভু! আমি এ ব্যক্তিকে দিনে পানাহার ও অন্যান্য কামনা- বাসনা হতে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করবেন। (বায়হাকী)
নয়. কল্যাণই কল্যাণ। আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা হযরত উমর ফারুক (রা.) বলেন, ঐ মাসকে স্বাগতম, যা আমাদের পবিত্রকারী। গোটা রমজান মাস কল্যাণই কল্যাণ। দিনের বেলায় রোযা হোক, কিংবা রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত। এ মাসে আল্লাহর পথে ব্যয় করা জিহাদে অর্থ ব্যয় করার মর্যাদা রাখে। (তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃষ্ঠা ১৭৬)
এ কথা না বললেই নয়, রোজা হতে হবে অবশ্যই একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য। রোজা পালন কালে কোন রূপ মিথ্যাচারে লিপ্ত হলে সেই রোজা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যাচার করা বর্জন করে না তার খাওয়া- দাওয়া ও পানীয় গ্রহণ পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারি শরিফ)
রমজান মাসকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। এ মাসকে তিনি রোজা পালনের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন যাতে তার বান্দাগণ বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাকি এগারো মাস সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে। এই মাসেই রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ মাসেই সংঘটিত হয়েছিলো ইসলামি ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র লড়াই গাজওয়ায়ে বদর। এ মাসেই হয়েছিলো মক্কা বিজয়। পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস এটিই। এ মাসেই আমাদের প্রিয়নবী (সা.) বেশি বেশি দান খায়রাত করতেন। রমজান মাসে ঝগড়া- বিবাদ, পরনিন্দা, পরচর্চা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সকল প্রকারের অশ্লীলতা প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার এক একটা মহা প্রশিক্ষণ লাভ হয় রোযা পালনের মাধ্যমে। এই মাসে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রোধের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ হয়।
দশ. আদর্শ সমাজ গঠন। রোজা ব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ ষড়রিপুর তাড়না থেকে মুক্তি পায়। ফলে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, ক্রোধ, নেশা, মিথ্যা, প্রতারনা, প্রবঞ্চনা, গীবত, ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীলতার চর্চা প্রভৃতি থেকে পূত- পবিত্র হয়ে সুন্দর আদর্শ জীবন লাভ করে। তাই অপরাধমুক্ত আদর্শ সমাজ গঠনে সাওমের ভূমিকা অনবদ্য। কাজেই রোজার ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব সীমাহীন। রোজা মানুষকে সর্ব প্রকার অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, কামাচার থেকে বিরত রাখে। সর্ব প্রকার ধর্ম বিরোধি ও সমাজ বিরোধি, পরনিন্দা, পরচর্চা, ঝগড়া-বিবাদ, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, প্রভৃতি সর্বপ্রকার অবাঞ্চিত ও অনভিপ্রেত কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই রোজা ব্রতের গুরুত্ব, ফজিলত ও মহাত্ম ইসলামি জীবন দর্শনে এত বেশি।
এগার. রমজানে বাজারদর। যেহেতু ধনীগণ আমাদের সোনালী যুগে বা আরব দেশে এ মাসে কেনা কাটা, খাওয়া দাওয়া করতেন কম। তাই বাজারে জিনিস পত্রের দাম থাকতো সব চেয়ে কম। স্বল্প ও সীমিত আয়ের লোকেরা যে খাবার ব্যয় বাহুল্য হবে মনে করে অন্য মাসে খেতে পারতো না। তারা রমজান মাসের মন্দা বাজারে তা কিনতে পারতো। কিন্তু আমাদের দেশে রমজান মাসে ধনীগণ খাদ্য বস্ত্র সব কিছুতেই বেশি ব্যয় করেন। তাদের বিত্তের আক্রমণে বাজারের হাল-হাকিকত হয় বেশামাল। একশ টাকার মাছ পাঁচ/ছয়শত টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে সব কিছুর দামই বেড়ে যায়। এতে সীমিত ও সল্প আয়ের মানুষের অবস্থা রমজানে ত্রাহী ত্রাহী।
বার. সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টি। সামাজিক জীবনে মানুষ রোজার অনুশীলনের মাধ্যমে ক্ষুধার্ত, অনাহারী ও অর্ধাহারী মানুষের দুঃখ- কষ্ট এবং ক্ষুধা- পিপাসার অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করতে পারে। ক্ষুধা- পিপাসার যন্ত্রনা যে কিরুপ ভয়ঙ্কর তা উপলব্ধি করে অভাবী ও নিরন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার ভাব জাগ্রত হতে পারে। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, এ মাস সহানুভূতির মাস।
তের. রোজা চরিত্র গঠনের হাতিয়ার। রোজা উত্তম চরিত্র গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র উন্নত করতে সক্ষম হয়। ফলে সে ভালো চরিত্রবান হয়ে ওঠে।
চৌদ্দ. প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ। রোজা একজন বান্দাকে সকল প্রকার অপবিত্রতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাচিয়ে রাখে। যেমন, প্রিয়নবী (সা.) এর ফরমানে ইবরাত নিশান হচ্ছে, ‘‘তোমনা যদি কেউ সামর্থবান হও তাহলে বিবাহ কর, কেননা এটা চক্ষু অবনমিত করে। যৌনাঙ্গ হেফাজত করে আর যে তাতে সক্ষম হবে না সে যেন রোযা রাখে। তবে রোজাই তার জন্য যৌন চাহিদার রোধক।’’ (তিরমিযী, আবু দাউদ)
পনের. সাম্য ও সহানুভূতি সৃষ্টি। রোজাদার যখন উপোস থাকে তখন সে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কষ্ট সম্পর্কে অবহিত হয়। ফলে ভিক্ষুক, এতিম, অসহায়, উপবাসী ও অভাবীদের প্রতি রোজাদারের মনে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই সাম্য ও সহানুভূতি সৃষ্টিতে রোযা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ষোল. রোজা ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। রোজার মাধ্যমে মানুষ একই আল্লাহর আদেশ একই নিয়মে পালন করে থাকে। যার ফলে সমাজের প্রতেকটি মানুষকে একই সূত্রে গ্রেথিত করে। একে অপরের দুঃখ-সুখে এগিয়ে আসার অনুভুতি সৃষ্টি করে। ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পরস্পরে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।
সতের. রোজা বাকসংযম শিক্ষা দেয়। মহৎ মানুষের অন্যতম প্রধান চারিত্রিক উৎকর্ষ তার বাকসংযম। মুমিনের এটি নিত্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ, তার ঈমানের দাবি। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর ও সংগত কথা বল।” (সুরা আল আহযাব :৭০)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরবতা পালন করে।” (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলাম মানুষকে ইসলামের আদলে গড়ে তুলতে চায়। ইসলামে নামাজ, রোযা, হজ্জ, জাকাত, জিহাদ, দাওয়াত প্রভৃতি আমল মানুষকে নিখাদ যোগ্য মানুষে পরিণত করে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে তার সামগ্রিক বাকসংযমের উপর আর রমজানের রোজা মুমিনের জন্য এক বাস্তব প্রশিক্ষণ।
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তার নিকটেই থাকে সদা তৎপর প্রহরী।” (সুরা কাফ ঃ ১৮) আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টি এবং ফেরেশতাদের প্রহরার বেড়াজালে মানুষ আবদ্ধ থাকে বলেই তাকে তার প্রতিটি কথা সংগতভাবে বলতে হবে। এসত্ত্বেও অনেক মানুষ যথাসংগত কথা না বলে অযথা ও অসঙ্গত কথা বলে ফেলেন। তারা রমজানের রোযাকে এ রোগের প্রতিষোধক হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, রোজা হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের কারও রোজা পালন করতে হলে সে যেন অশ্লীল ও অযথা কথা না বলে। কেউ যদি তার সাথে ঝগড়া বা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় তাহলে সে যেন বলে আমি রোযাদার। (বুখারি ও মুসলিম)
এখানে রোজা অবস্থায় তিনটি কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেগুলো হলো :
অশ্লীল কথা না বলা বা কর্ম না করা।
ঝগড়ায় লিপ্ত না হওয়া।
অযথা বিতর্ক- সংঘর্ষে লিপ্ত না হওয়া।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে এ তিনটি কাজ মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করে। রোজাকে যথাবিহিত করার সার্থে মানুষ এ তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকে। ফলে সে বাকসংযমী হয়ে ওঠে। এভাবে রোজা তার জন্য ঢালস্বরূপ তার অযথা কথাকর্মের ছোঁয়া থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে। যে মানুষ বাকসংযমী হয় না তার স্থান জাহান্নাম। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, জিহ্বার উপার্জনই (কথোপকথন) মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। (মুসনাদে আহমদ, সুনানে তিরমিযী)
একাধিক সহীহ হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় নির্যাস হচ্ছে, রোযাদার বাকসংযম না করলে তার রোযা অবধারিতভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। সুতরাং কোন ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা বলা যাবে না, গীবত বা পশ্চাতে পরনিন্দা করা যাবে না। এই পরনিন্দা তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমপর্যায়ের অপরাধ। অনর্থক, অনাবশ্যক কথা বলা যাবে না। এটা বড় ধরণের পাপ। ব্যক্তি সংগত কথা বলতে না পারলে চুপ থাকবে এটাই ইসলামের আদর্শ। কোনভাবেই অযথা কথা বলা যাবে না। তাহলে তা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হতে পারে। চোগলখুরি করা যাবে না। কারও গোপন কথায় কান পাতা যাবে না। কথাবার্তায় দাম্ভিকতা প্রকাশ করা যাবে না। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া যাবে না। কাউকে অভিসম্পাত করা যাবে না। কার নামের বিকৃতি করা যাবে না। মুমিনদের নাস্তিক বা নাস্তিককে মুমিন বলা যাবে না। হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল বলা যাবে না। মিথ্যা শপথ করা যাবে না। তথ্যসন্ত্রাস করা যাবে না। এমন কোন কথা বলা যাবে না, যার দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন হয়। বিদ্রুাপাত্মক কথা বলা যাবে না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মাঝে (জিহ্বা) ও দুই পায়ের মাঝে যে অঙ্গ আছে সে ব্যাপারে জিম্মাদারী হবে আমি তার জান্নাত গমনের ব্যাপারে জিম্মাদারী হব। (সহীহ বুখারী)

Comments

comments

About

Check Also

আমরা রোজাদার হই

আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রামাদ্বান। রহমত, মাগফিরাত, আর নাজাতের স্রোতদ্বারা বয়ে যাবে এ মাসে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *