রক্তাক্ত মসজিদুল আকসা : কবে আসবে আরেকজন সালাহুদ্দিন আইউবি?

১.
মসজিদুল আকসা। ১৮০ কোটি মুসলমানের প্রাণের স্পন্দন। স্তম্ভিত এক আলোর মিনার। ভালোবাসা আর মহত্ত্বের তাজমহল। আমার রাসূলের সিজদা করা প্রাণের কিবলা। বুকফাটা চিৎকার করে বলতে হচ্ছে আজ বিরহের কথা। ১৮০ কোটি মুসলমানের সেই হৃৎপণ্ডে পড়েছে আজ জাতশত্রু ইয়াহুদিদের কালো থাবা। ক্ষতবিক্ষত হতে চলেছে তার প্রতিটা ইটপাথর। ফিলিস্তিনবাসীর শরীর থেকে ঝরছে রক্তের বন্যা। কিন্তু বিশ্ব বিবেক আজও ঘুমন্ত। মানবতার ফেরিওয়ালাদের চোখে হলুদ আবরণ। জুব্বা,ভিড়াওয়ালারা পশ্চিমা দাসত্বে সদা মগ্ন।
৬৯ সালের ঘটনাটির পর এটিই হচ্ছে মসজিদে আকসায় ইসরাইলের সবচেয়ে বড় হামলা। কাতার, তুরস্ক, জর্ডান ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র এই ঘটনার নিন্দা জানায় নি। যারা সন্ত্রাসের দোহায় দিয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের মুখ দিয়ে আকসার জন্য একটি বাক্যও বের হয় নি। মুসলমানদেরকে তাদের সন্ত্রাসী মনে হয়। হামাসকে তাদের সন্ত্রাসী মনে হয়। কিন্তু ইসরাইলী বর্বরতাকে তাদের বৈধ আধিকার চর্চা মনে করে। গত (২১/০৭/২০১৭ঈসা.) জুমার দিনটি ছিল, মসজিদুল আকসার জন্য জীবন দেয়ার দিন। গোটা কুদস এবং তার আসে পাশের শহরগুলোতে ওইদিন জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় নি। সবাইকে আকসায় এসে জুমা পড়তে বলা হয়েছে। জুমার আগে ও পরে পুরা আকসা প্রাঙ্গণ যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ ধারণ করে। তিনজন ফিলিস্তিনি ভাই শাহাদাত বরণ করেন। তুরস্কসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ওই সময় ফিলিস্তিনীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে মিছিল সমাবেশ করা হয়। কিন্তু দুঃখজক! এ নিয়ে কিছু চিহ্নত জুব্বাওয়ালারা কোনো মুখ খুলেনি।

২.
মুসলমান খুব সহজেই ইতিহাস ভুলে যায়। ভুলে যায় নিজেদের ঐতিহ্য। মুসলামান! ভুলে গেলে চলবে না ইতিহাস(!) বলছিলাম, বহুকাল আগের কথা। আজ থেকে অনেক আগে; মানি পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পরের কথা- হযরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন।
তারপর হযরত সুলাইমান (আ.) এই পবিত্র মসজিদের পুনঃনির্মান করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা। এবং পবিত্রতার দিক থেকে মক্কা-মদিনা মুনাওয়ারার পরের তৃতীয় পবিত্র স্থান। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববি এবং মসজিদে আকসা-এর উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা অন্য কোন মসজিদ সম্পর্কে করেন নি। ৬৩৮ ঈসায়ীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে পুরো বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের আয়াত্বে চলে আসে। ১০৯৬ সনে খৃষ্টান ত্রুসেডারগণ পুরো সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করার পর ‘মসজিদে আকসা’-এর ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গীর্জায় পরিণত করে ফেলে। তারপর ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর ও সিপাহসালার সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবির হাতে পরাজিত হওয়ার পর খৃস্ট শক্তি কিছুটা পিছু হটলেও ইয়াহুদী চক্র বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি রাখে। এবং তারা ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে সুদূর মদিনা পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে বসে। এবং এরই প্রেক্ষিতে তারা তুরস্কের তৎকালীন শাসক ‘সুলতান আবদুল হামিদ’-এর নিকট ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি চায় এবং এর বিনিময়ে তারা তুরস্কের সকল বিদেশী ঋণ পরিশোধ করে দেবে বলে অঙ্গীকার করে। ককিন্তু সুলতান তাদের ষড়যন্ত্রমূলক এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা গোপনে জমি কিনতে থাকে। ১৯১৭সনে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ও ১৯২০ সনে সেখান পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং ‘স্যার হার্বাট স্যামুয়েল’ নামক একজন ইয়াহুদীকে সেখানে বৃটিশ কমিশনার নিযুক্ত করে। এই জমি কেনায়র ফলে বহিরাগত ইয়াহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনের দরজা খুলে যায়। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইয়াহুদীবাদী উগ্র সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনে বসবাস ও জমি কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার প্রদান করে। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যে বহু সংখ্যক ইয়াহুদী ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে।১৯৪৮সনের ১৫ ই মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে যায়নবাদী অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইয়াহুদীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের কচুকাটা করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের মাধ্যমেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

৩.
ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদ্স (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইসরাঈল ফিলিস্তিনের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্ত্ব শাসনের কথা বলে কিছু সংখ্যক নেতাকে বিভ্রান্ত করেছে। ২০০৭ সনে থেকে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে আরব বিশ্বের ক্যান্সার খ্যাত এই যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রটি। তখন থেকে গাজাবাসীকে ত্রাণের আশায় অপেক্ষা করতে হয়। জাতিসংঘ নামক অথর্ব সংস্থাটি মাঝে মাঝে ত্রাণ সামগ্রী পাঠায় ইসরাইলীদের মাধ্যমে। ইসরাইলের মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছানোই প্রমাণ করে জাতিসংঘ আজ দাফনযোগ্য সংস্থায় পরিণত হয়েছে। গত বছর তুরস্ক সব বিভিন্ন দেশের ত্রানসামগ্রীসহ জাহাজবহর ফ্লেটিলায় আক্রমন চালিয়ে তারা ২০ জন বেসামরিক ত্রানকর্মীকে শহীদ করেছে। গাজা অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪। দীর্ঘ ৮ বছরে গাজাবাসী নিঃস্ব হয়ে গেছে জাতি হিসেবে তারা পরাধীন। এদের মুক্ত করার কেউ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমান নিশ্চুপ।

৪.
গত ৯ই জুলাই ২০১৪থেকে তাদের উপর নতুন করে হামলা শুরু হয়েছে। হাজার হাজার বিমান ও মর্টার হামলা চলছে রাত-দিন। পবিত্র রমযান মাসেও তারা রেহাই পাচ্ছে না ইসরাইলী আগ্রাসন থেকে ১৫ দিনে গাজার ৬ শতের মত নারী, শিশু, বৃদ্ধ শহীদ হয়েছেন । লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে আছে। হাজার হাজার বাড়ি ঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। রাতে অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষের উপর চলছে বোম্বিং। নারীদের বেপর্দা উলঙ্গ করে হত্যার পর বনে জঙ্গলে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সামান্য মমাথা ররাখার জায়গা পাচ্ছে না একটা শিশুও। গাজার রাস্তা-ঘাটে শত শত লাশ আর লাশ পড়ে রয়েছে। যেটার শুরু হলে আজ অবধি শেষ হয় নি। সভ্যতার উৎকর্ষতার যুগে এমন বরবর অমানবিক ও করুন হত্যাকান্ড কি মেনে নেয়া যায়? এরপরও বিশ্ববাসীর ঘুম ভাঙ্গছে না। বিশ্ব মুসলিমও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে না। বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আহ্বান যায়নবাদী ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও।
প্রশ্ন হলো কি অপরাধ গাজাবাসীর? কি কারণে দীর্ঘবছর যাবত তাদের অবরোধ করে রাখা হচ্ছে। দীর্ঘ ৬২ বছর যাবত ফিলিস্তিন জনগণকে নিজ জন্মভূমিতে পরাধীনভাবে বসবাস করতে হচ্ছে। গাজা অবরোধের কারণে সেখানে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানুষ প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে ভুগছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তারা বঞ্চিত একমাত্র যায়নবাদী ইসরাইলী আগ্রাসনের কারণে। লাখ লাখ নবী-রাসূলের স্মৃতিধন্য ফিলিস্তিনের কি করুণ অবস্থা। বোমার আঘাতে, গুলির শব্দে সেখানে আকাশ ভারী হচ্ছে আজ অবধি। গাজার জনগণ ত্রাণের জন্য শুধুই পথ চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। ৬০ শতাংশ জনগণ পানিটুকুও খেতে পাচ্ছে না। গাজার বেকারত্বের হার হয়তো বিশ্বে সর্বোচ্চ। যায়নবাদী সন্ত্রাসী ইসরাইল কর্তৃক গাজা অবরোধ আর দেড় থেকে দুই বছর চললে সেখানকার ৪০ শতাংশ লোক অপুষ্টি ও অনাহারে মারা যাবে। গাজায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু বর্তমানে অপুষ্টিতে ভুগছে। তারপরেও যায়নবাদীদের বিশ্বের কেউ থামাতে পারছে না। থামাবেই বা কি করে; বিশ্ব মোড়ল আমেরিকাই তো তাদের লালনকর্তা।

৫.
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হযরত উমার রা. এর খেলাফত আমলে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা এর নেতৃত্বে মুসলমানরা কুদস জয় করে। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেড যুদ্ধে ক্রুসেডারদের হাতে কুদসের পতন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে কুদসে মুসলমানদের ৪৬২ বছরের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। তার পর দীর্ঘ ৮২ বছর এটি খ্রিষ্টানদের দখলে থাকে। ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হিত্তিনের যুদ্ধে সালাহুদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করে কুদসকে শত্রুমুক্ত করেন। ১৯৪৮ সালে বিশ্বমোড়লদের চক্রান্তের ফসল স্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল নামক জারজ রাষ্ট্রটির জন্ম হলে পশ্চিম কুদস মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। কিন্তু পূর্ব কুদসে অবস্থিত হওয়ার কারণে আল-আকসা তখন আপাতত রক্ষা পায়। ১৯৬৭ এর জুন মাসে মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান এবং ইরাকের মতো চারটি আরব রাষ্ট্রের প্রতিরোধ বুহ্য ধ্বংস করে দিয়ে ইসরাইল পূর্বকুদস, পশ্চিমতীর, গাজা এবং গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। দীর্ঘ ৭৮০ বছর পর পবিত্র আকসা থেকে আবারও হেলালী নিশান খসে পড়ে। উমার এবং আইয়ুবীর আমানত আবারও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আল-আকসা কেঁদে চলেছে এবং আরেকজন আইয়ুবীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
যাইহোক দোয়া করি, পবিত্র গাজার মাটি মুক্ত হোক। মসজিদুল আকসা মুক্ত হোক। ফিরে পাক ফিলিস্তিনি মুসলিমানেরা তাদের হারানো শান্তি। উদ্ধার হোক মুসলমানদের প্রথম কিবলা পবত্র বাইতুল মাকদিস।

Comments

comments

About

Check Also

চিনে মুসলমানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা

সিরাজুল ইসলাম সা’দ নজিরবিহীন ভাবে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কমিনিষ্ট পার্টির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *