কাতার : ইসরাইল ও পশ্চিমাদের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার

কাতারের সাথে ডিপ্লোমাটিক ক্রাইসিস (কুটনৈতিক সংকট) শুরু হয় জুন (২০১৭) মাসে, সেই থেকে সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর, কাতারের সঙ্গে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে। একইসঙ্গে জল, স্থল ও আকাশপথে কঠোর অবরোধ আরোপ করে। কিন্তু কেন? হঠাৎ করে এই সংকটের কারণ কি? কাতার কি ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার? কাতার কি বরণ করতে যাচ্ছে ইরাক বা লিবিয়ার পরিণতি? আমরা যদি মনে করি যে, কাতারকে নিয়ে যা চলছে তা তাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অথবা কয়েকটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব তাহলে জেনে রাখুন আমরা বিরাট এক ভুলের মধ্যে আছি। আমাদেরকে পিছন ফিরে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকিয়ে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে এই ভুল ভাঙাতে হবে। আমরা যদি হলুদ মিডিয়ার সংবাদ দেখে চোখে পর্দা দিয়ে কাতারের সাথে সন্ত্রাসবাদের কানেকশন খুঁজি এবং তাদের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করি তাহলে পৃথিবীর লক্ষ কোটি মুসলমান খুব আহত হবে। বাস্তবতা হল, মুসলমান জাতির সর্বশেষ আস্তানাগুলো উৎপাঠন করার চেষ্টা চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উসমানী খেলাফতের ধ্বংসের মাধ্যমে মরুভূমির বর্বর জাতিকে আরবের রাজত্ব দান করে মুসলমান জাতির উপর গোলামীর আলখেল্লা চাপিয়ে দিয়ে এবং ইসরাঈল নামক অবৈধ রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা জাগ্রত হয়ে যেসব ইসলামি রাষ্ট্রগুলো বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এখনো তাদেরকে ‘বিরক্ত’ করছে সেগুলো সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা এবং মুসলমান জাতির ঘাড়ে সর্বশেষ মরণ-কামড় দেয়ার ষড়যন্ত্রই মুলত কাতার সমস্যার অন্যতম কারণ।
কিন্তু এই বিষয়টাতো আর কড়া পারফিউম দিয়ে ধবধবে সাদা জুব্বা, মাথায় গোলগাল চাক্কা দিয়ে চোখ ঢেকে ২০০ কিলোমিটার গতিতে লক্ষ ডলারের স্পোর্ট কার দৌড়িয়ে পশ্চিমা সাগর সৈকতে যারা বৃষ্টির মতো পেট্রো ডলার উড়িয়ে সাদা চামড়ার অপবিত্র রমণীদের সাথে লাল শরাব পান করে বিলাসিতার সাগরে বাজনা বাজায় তাদের মগজে ঢুকবেনা এটাই স্বাভাবিক। মুসলমান জাতির কল্যাণের চিন্তা করে ইহকালীন অল্প কষ্টের চেয়ে নিউয়র্ক, লন্ডন, মিলান, প্যারিসের বিলাসবহুল নাইট ক্লাবে নর্তকিদের সাথে নৃত্য করা আর দামি ব্রান্ডের হুইস্কিসহ বিভিন্ন প্রকার লাল পানিয় পান করে জাহান্নামে চিরস্থায়ী ঠিকানা করে নেয়াই তাদের জন্য অনেক বেশী শ্রেয়। কিন্তু আমাদের মতো গরিব অসহায় মুসলমানদের মনে এতোসব অন্যায় জুলুম দেখে অন্তরে খুব কষ্ট হচ্ছে। মুসলমানরা সমাধানের পথে না গেলেও পশ্চিমারা কিন্তু তাদের কুটনৈতিক খেলা অব্যাহত রেখেছে। এএফপি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদে জানা যায়, কাতার সংকট নিরসনে উদ্যোগী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ সফর করেছেন এবং কাতার বয়কটের ইতি টানার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি বয়কট উঠিয়ে নেয়া না হয় তাহলে উপগাসরীয় দেশগুলোতে নজিরবিহীন এ সংকট সামরিক উত্তেজনায় রূপ নেবে।’ এদিকে কাতার সংকট সমাধানে মধ্যস্থতা করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, কুয়েত সফরে যাচ্ছেন। কুয়েতও মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত তা সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতার সংকটের সমাধান সহসাই হচ্ছে বলে মনে হয় না। সৌদি জোট তার মুখরক্ষার জন্য সমাধান চাইলেও সেটা সহসাই ঘটছে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ক্রিশ্চিয়ান আলরিচসেন বলেন, ‘আমার মনে হয় এ সংকট আরও বহু পথ পাড়ি দেবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী মুখপাত্র হিদার নয়ার্ট বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস এটা কয়েক সপ্তাহ চলতে পারে।’
কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা অধ্যয়ন বিভাগের অ্যান্ড্রিয়াস ক্রিগ বলেন, ‘কাতারের ওপর অবরোধ শিগগিরই উঠবে বলে মনে হয় না। আমি তেমন সম্ভাবনা দেখছি না।’

ব্রিটেনের ডারহাম ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার ডেভিডসন বলেন, মনে হচ্ছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারের সামর্থকে খাটো করে দেখছিল। কাতার দ্রুতই প্রধান আঞ্চলিক শক্তি যেমন তুরস্ক ও ইরানকে এ বিরোধে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ক্ষীণ। এক্ষেত্রে কাতারের অর্থনীতির ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণই হয়তো এখন সৌদি ও আমিরাতের কৌশল।’ তাছাড়া সৌদিও চাচ্ছেনা এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক। ইসরাইলের মিত্র পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই জঘন্য নীতি অবলম্বন করে বিষ কামড় দিয়ে ধ্বংস করেছিল ইরাক ও লিবিয়াকে, এই ইতিহাস কারো অজানা নয়! যদিও শেষ পর্যন্ত কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। সে সময় কাতারও সৌদি সহ মিত্র রাষ্ট্রদের সহযোগী ছিল! কিন্তু আজ কেন হঠাৎ এই সম্পর্কচ্ছেদ? সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হঠাৎ এলেও, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কাতারের সম্পর্কের টানাপোড়নের শুরু হয় কিন্তু কয়েক বছর আগেই, যা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এসে বৃদ্ধি পেয়েছে। সৌদি আরবের উত্থাপিত অভিযোগ গুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:
(১) কাতার অনেকদিন যাবত সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে এবং সৌদির জনগণকে দেশের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে।
(২) সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তাদের মিডিয়ায় সবসময় অপপ্রচার।
(৩) সৌদি আরবের আল কাতিফ অঞ্চলে শিয়া বিদ্রোহীদের সবধরণের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান।
(৪) বাহরাইনের শিয়া জঙ্গিদের মদদ ও সাহায্য সহযোগিতা করা।
(৫) কাতার সন্ত্রাসবাদের মদদ দিচ্ছে এবং সৌদি আরবের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের সহায়তা প্রদান।
(৬) এঁষভ ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ এর সদস্যদের সাথে ধমৎববসবহঃং লঙ্গন করছে। ঘবংিবিবশ গঊ. ১৪ ঔঁহব ২০১৭.
(৭) আরব জোটে থাকার ঘোষণা দেওয়ার পরও কাতার কর্তৃক ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুতি মিলিশিয়াদের আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা প্রদান।

অন্যান্য দেশগুলোরও প্রায় একই ও অভিন্ন অভিযোগ। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে সেটি হলো, জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাতারের সংযোগ এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের প্রতিপক্ষ ইরানের ভূমিকা। কাতারের সাথে ঘটনার শুরু হয় ২৪ শে মে থেকে। প্রায় মধ্য রাতের দিকে কাতারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম ছঘঅ এর ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ ভেসে উঠে। “কাতারের আমীর বলেছেন- ইরান আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং এই এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ইরানের সাথে শত্রুতা পোষণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। ইসরাইলের সাথেও আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এই ব্যপারটাই কাতারের জন্য দুর্গতির কারণ হয়েছে। সংবাদ প্রচারের ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই কাতারের পক্ষ থেকে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয় যে, তাদের সরকারী ওয়েবসাইট হ্যাক করা করা হয়েছে এবং আমীরের নামে যা প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া। এটা হ্যাকারদের কাজ। কাতারের গোয়েন্দাসংস্থা এবং এফবিআই এর যৌথ তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, রাশিয়ান হ্যাকারদের মাধ্যমে ছঘঅ কে হ্যাক করা হয়েছে। কিন্তু তবুও সৌদি আরব তা মানতে রাজি হয়নি। তাহলে কি সবকিছু পূর্ব পরিকল্পিত? এখানে কি ইসরাইল বা মিত্র শক্তির কোন হাত আছে?
ইসরাইল বা মিত্রশক্তি চায়না কাতার ইরানের সাথে মৈত্রী প্রতিষ্ঠা বা শিয়াদেরকে সহযোগিতা করুক। কাতার খুব ছোট একটা মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্বেও ইরানের সাথে সৌদি আরবের মত বিশাল রাষ্ট্রের সমমান বানিজ্যিক লেনদেন করে যাচ্ছে! যেখানে সৌদিআরবের বাৎসরিক বানিজ্যের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার সেখানে কাতারের বাৎসরিক বানিজ্যের পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
ইসরাইল বা পশ্চিমাদের দুশমন ইরানকে আন্তর্জাতিক অবরোধের দখল থেকে বাঁচাতে কাতার বা আরব আমিরাতই সবচেয়ে বেশী ভুমিকা পালন করে। শিয়ারা বা ইরান যেমন ইসরাইলের দুশমন ঠিক তেমনি সৌদিআরব বা তাদের মিত্রদেরও দুশমন! তাই অতি কুশলী ইসরাইল সৌদি কোয়ালিশনের কাঁধে বন্দুক রেখে কাতারকে কপোকাত করতে চায়।
কাতারের বিরুদ্ধে অন্যতম আরেকটি অভিযোগ হলো, তারা ইখওয়ান এবং হামাসকে সহযোগিতা করছে। এই অভিযোগটি কাতারের জন্য অত্যন্ত সম্মানের এবং গৌরবের বিষয়। ইখওয়ান বা হামাসকে সহযোগিতা করে তারা ইসরাইলের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গোটা মুসলিম জাতির পক্ষ থেকে কিঞ্চিৎ হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব আন্জাম দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আলোকে এখনও হামাস তাদের বুকের তাজা খুন দিয়ে প্রজ্বলিত করে রেখেছে। বিগত সাত দশক ধরে ইসরাইল এবং তাদের মিত্র আমেরিকা, হামাস বা সমমনা দলের কারণে এখনো ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করতে পারেনি। আর তাইতো ইসরাইল সহ পশ্চিমা শক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে কাতারকে ধ্বংস করার জন্য।
এত ষড়যন্ত্র বা ফরঢ়ষড়সধঃরপ পৎরংরং এর পরেও আশার বাণী হলো যে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়্যেপ এরদোগান কাতার সঙ্কট নিরসনে ছয় রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই হয়তো আরবের উদ্ভূত এ পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। তিনি উপসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীল শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে ওআইসির প্রেসিডেন্ট ও তুরস্কের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ আলোচনা শুরু করেন। এরদোগান এ কথাও বলেছেন যে, আরব বিশ্বের এই সঙ্কট মোকাবিলায় আঙ্কারা সব ধরণের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও তিনি শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসার জন্যও আরব নেতাদের প্রতি আহবান জানান। অন্য আরেকটি সূত্র জানিয়েছে যে, কাতারের এই সঙ্কট নিরসনে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য কুয়েতের আমির বর্তমানে সৌদি আরব সফর করছেন। সবকিছু মিলিয়ে একটি সমাধানের মিটিমিটি আলো দেখতে পাচ্ছি। কাতারিরা আমাদের মুসলমান ভাই, সৌদি এবং অন্যান্য আরবরাও আমাদের ভাই। আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে আর কোনো দ্বন্দ্ব চাই না বরং মিলেমিশে থাকতে চাই। আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো অনৈক্য, দূরত্ব ও বিভাজন চাই না। আমরা চাই স্থিতিশীল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে সকলেই এগিয়ে যাক। বন্ধন আরও অটুট হোক। ভালোবাসা, সৌহার্দতা আরও দৃঢ় হোক। হৃদ্যতা আরও গভীর হোক। ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ হোক মাওলার দরবারে এই প্রার্থনা সতত।

Comments

comments

About

Check Also

চিনে মুসলমানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা

সিরাজুল ইসলাম সা’দ নজিরবিহীন ভাবে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কমিনিষ্ট পার্টির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *