আল্লামা আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.) উৎকৃষ্ট চরিত্রের বিরল ব্যক্তিত্ব

ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সৃষ্টজীব মানুষ। আর মানুষের জীবন অতি সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। এ সংক্ষিপ্ত জীবনে কোনো কোনো মানুষ বিরল কীর্তি রেখে পরকালে পাড়ি দেন। আড়ালে চলে যাওয়া মানুষটি যদি আপন চরিত্র মাধুর্য দিয়ে নিকটজনের হৃদয় আকৃষ্ট করে যেতে পারেন তাহলে এমন মানুষকে কারো পক্ষে সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তার আন্তরিক ভালোবাসা, কথাবার্তা, চলাফেরা, উঠাবসাসহ জীবনের খুটিনাটি সামগ্রিক কার্যকলাপ। এমনই উৎকৃষ্ট চরিত্রের এক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন হজরত মাওলানা মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.)।
১৯৬৪ ইং সালের ১লা মার্চ সিলেট জেলাধীন জকিগঞ্জ উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত নান্দিশ্রী গ্রামে তার শুভ জন্ম। সূফী সম্রাট হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর অন্যতম সফরসঙ্গী হজরত শাহ কামাল (রহ.)-এর অধঃস্তন বংশপুরুষ ছিলেন তিনি। তার পিতার নাম মো. আব্দুস ছাত্তার চৌধুরী এবং মাতার নাম হালিমা বিবি।
৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন। বাল্যকালে পিতাকে হারালে পরিবার পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পড়ে তার উপর। অত্যন্ত ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার সাথে স্বীয় কাঁধে বর্তানো দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পাশাপাশি শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগীতায় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান।
আল্লামা আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.) প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন গ্রামের মক্তবে। পরবর্তীতে ১৯৭৭ ইং সনে ‘বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা’ থেকে নানা প্রতিকূলতার ভেতরও অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাস করেন। ১৯৭৯ ইং সনে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আলিম জামাতের ব্যাচের ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে বেশ কৃতিত্বের সাথে আলিম উত্তীর্ণ হন। প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৮১ইং সনে ঢাকাস্থ ‘কাদেরিয়া তায়্যিবিয়া সিনিয়র মাদরাসা’ থেকে ফাজিল এবং ১৯৮৭ ইং সনে ‘দুবাটি মদিনাতুল উলূম কামিল মাদরাসা’ থেকে হাদিস বিভাগে সুনামের সাথে কামিল জামাত সমাপ্ত করেন।
এ মহান ব্যক্তি কর্ম জীবন শুরু করেন শিক্ষকতার পূতপবিত্র পেশা দিয়ে। প্রথমে ‘হলিয়ার পাড়া জামেয়া কাদেরিয়া সুন্নীয়া দাখিল মাদরাসা’য় সহকারী মৌলভী পদে শিক্ষকতা করেন প্রায় সাত বছর। ১৯৮৯ ইং সাল হতে ১৯৯২ ইং সাল পর্যন্ত ‘মুকিমপুর রশিদিয়া সিনিয়র মাদরাসা’র (নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ) অধ্যক্ষের দায়িত্ব বেশ দক্ষতার সাথে আঞ্জাম দেন। এরপর ১৯৯২ ইং সালের শেষের দিক থেকে ‘চৌধুরী বাজার দাখিল মাদরাসা’র (গোলাপগঞ্জ, সিলেট) সহতত্ত্বাবধায়ক (সহ সুপার) পদে যোগদান করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে দায়িত্বপালন করেন।
প্রয়োজনের তাগিদে তিনি ২০০৬ ইং সাল হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ‘তালিমপুর বাহারপুর ইয়াকুবিয়া দাখিল মাদরাসা’র তত্ত্বাবধায়ক (সুপার) পদে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে কৃতিত্ব দেখান। উল্লেখ্য যে, তার স্থায়ী বাসস্থান জকিগঞ্জের নিকটবর্তী উপজেলায় কর্মস্থল করার অভিপ্রায়ে পূর্ববর্তী মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ ছাড়তে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি।
হজরত মাওলানা মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.) স্বীয় বর্নাঢ্য কর্মজীবনকে স্বার্থকতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী এলাকার মুসল্লিয়ানে কেরামগণের অনুরোধে বিভিন্ন মসজিদে খতিবের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত আল্লামা আলাউদ্দীন (রহ.) সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হাটুভাঙ্গা দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া আলিম মাদরাসা’র অধ্যক্ষ পদে বেশ দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব চালিয়ে যান। পাশাপাশি বৃহত্তর ‘হাটুভাঙ্গা ফরিদপুর শাহী ঈদগাহ’র খতিব এবং ‘দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী জামে মসজিদ’র ইমাম ও খতিবের গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
উৎকৃষ্ট চরিত্রবান ব্যক্তিত্ব আল্লামা আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.) অত্যন্ত সহজ-সরল, উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন। ভদ্রতা, নম্রতা, বিচক্ষণতা এবং অন্যের প্রতি তার আন্তরিকতা যে কারো দৃষ্টি সহজেই কাড়তো। তার মুখে কোনো কটুকথা কেউ কখনো শোনেনি। সবার প্রতি তার বিনয় এবং মিষ্টভাষী সম্বোধন নিকটজনের হৃদয় আকৃষ্ট করতো। একজন মুত্তাকী, সুন্নতে নববীর পাবন্ধ ছিলেন তিনি। ২০১৬ ইং সালের ১৫ই এপ্রিল আগের হৃদরোগ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, চার পুত্রসন্তান, আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী, শুভাকাঙ্খীদের রেখে এমহৎ প্রাণ ব্যক্তি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫২ বছর। ‘বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা’র মাঠে তার জানাযার নামাজের বৃহৎ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার ইমামতি করেন- আল্লামা মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। মহান আল্লাহ তায়ালা মাওলানা মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী (রহ.) কে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন; আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

‘বাংলার রুমী’ কাব্যে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

মো. ছাদিকুর রহমান অলংকারী জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা কবিদের কবিতায় বাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *