আল্লাহপাক জন্মগতভাবেই প্রতিটি মানুষের মনের মাঝে দিয়ে থাকেন বিভিন্ন ধরণের প্রতিভা। সাহিত্য হচ্ছে তার অন্যতম, যা প্রস্ফুটিত হয় লেখনির মাধ্যমে। এ সাহিত্য আবার নানাভাবে বিভক্ত। লোকসাহিত্য দখল করেছে এর বিশেষ স্থান। লোককবিগণ কঠোর পরিশ্রম করে ইসলামী তাহজিব তমদ্দুনকে প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সুন্দর বোধগম্য আঞ্চলিক ভাষায়। অতীতে লোকসাহিত্যকে অবহেলার চোখে দেখা হলেও বর্তমানে এর কদর আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত। এমন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে লোককবিরা হাত দেন নি। কলিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, নবী-রাসূল, পীর-মুরিদী, প্রতিবাদ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ইত্যাদি নানা বিষয়ে সমানতালে তাদের পদচারণা সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের প্রধান শাখা ‘কলিমা’ বা ঈমান সংক্রান্ত লোককবিদের প্রবচন নিয়ে আজকে উপস্থাপনা।
ইসলাম সার্বজনীন শান্তির ধর্ম। কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত হচ্ছে এর ভিত্তিমূল। প্রথমটি ছাড়া শেষোক্ত চারটি মূল্যহীন। ঈমান কবুল হয় না, হয় না আল্লাহর দরবারে বান্দাদের কোনো এবাদাত। কোককবির কি সুন্দর উপস্থাপনা
ঈমান লড়খড়া
হুদাহুদি নামাজপড়া।
তাহলে ঈমান কী? ঈমান হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অর্থাৎ-আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। এ কথার উপর তাসদীক বিল্ জিনান্ বা অন্তর দ্বারা বিশ্বাস, ইকরার বিল্লিসান বা মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমল বিল্ র্আকান বা কাজে পরিণত করার দৃঢ় অঙ্গীকার। সর্বোপরি ঈমান হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অস্তিত্ব, তাঁর সমুদয় সৃষ্টি, নবী রাসূলগণকে বিশ্বাস এবং তাঁদের আনিত দ্বীন, ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় বিষয়বস্তু এবং সম্পর্কীয় বিধি-বিধান, হুকুম-আহকামকে অন্তর দ্বারা দৃঢ় বিশ্বাস করার নাম ঈমান। লোককবি মান্নান শাহ বলেন-
লা-ইলাহা ইল্লাল্লা বলে
একিনের সাথে
আল্লাহর সাথে রাসূল আছইন
একই মালাতে।
শাহাদাত ইসলামে দ্বিতীয় কালিমা। ফকির আরকুম শাহ শাহাদাত কালিমার মাহাত্মা বা মহিমা কবিতার ছন্দে অবতারণা করেছেন এভাবে-
আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নাই
গুণের নাই সীমা
লা-শরীক মাবুদ মানা
শাহাদাতের মহিমা।
তৃতীয় হচ্ছে কালিমা তাওহীদ। এ কালিমায় পরিলক্ষিত আল্লাহ পাকের একত্ববাদের ঘোষণা এবং রিসালাতের জ্বাজল্য প্রমাণ। একত্ববাদ এবং রিসালাতে বিশ্বাসীরাই পাবে পরকালে শেষ নবীর শাফায়াত এবং দীদারে এলাহী। সুপরিচিত বাউল ব্যক্তিত্ব ফকির শীতালং শাহ তাওহীদ প্রসঙ্গে বলেন-
কালিমা তৌহীদ শরীক নাই
লা-শরীক নিরঞ্জন
শুধুচিত্তে সাধিলে হয় দরশন।
এ ব্যাপারে শেখ ভানুর কাব্যিক সংযোজন
লা-শরীক মাবুদ জানি যেজন
করে এবাদাত
নবীজি তারে, করবা শাফায়াত।
চতুর্থ হলো কালিমা তামজিদ। এতে ঘোষিত হয় আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও রেসালাতের স্বীকৃতি। কালিমা তামজিদে সত্য উপলব্ধি করেছেন লোককবি ফকির সহিফা। বন্ধু যেন বন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে আবেগের শ্রোতে তিনি গেয়ে উঠলেন-
সব তুই, তুইরে বন্ধু
সব তুই, তুই
লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা
সত্য জানি মুই।
সাতটি বিষয়ে ঈমান আনার কথা যে কলিমায় বিবৃত, তার প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে লোককবি আব্দুল বাকী দরাজ কণ্ঠে আহ্বান করলেন-
ওমন পাগেলা রে
দুনিয়া আখের পাইবেরে
যাও আমানতু ধারে
কী ব্যাপার, আমানতুর ধারে মন যাবে কেন? পড়ার জন্য। পড়লে কী হবে? তার উত্তর প্রদানে ফকির আরমান শাহ উচ্চারণ করেন-
পড়ো আমানতু বিল্লা
আমানতু পড়িয়া দেখো
মৌলাজীর লিলা।
চিরশত্র“ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে হর হামেশা পাপ করে মানুষ। এক সময় গুণার বুঝায় ভরে যায় মানব দেহ নামক নৌকাখানি। তাহলে সেই পাপ মোচনের নেই কি উপায়? হ্যাঁ আছে। তবে কোথায়? দেখেন আমাদের লোককবি ফকির আব্দুল বাকীর ভাষায়,
রে কলিমা বড় ধন
বিন্ কালেমায় দেহের পাপ
না হৈব মোচন।
লোককবি ভেলা এ প্রসঙ্গে সুন্দরভাবে ছন্দ আঁকেন-
গুণার দাওয়াই করো
কলমা পড়ো ভাই
ফকির ভেলা শা’য় কয়
নাইলে উপায় নাই।
পরিশেষে বিশিষ্ট লোককবি জনাব হরমুজের একটি ছন্দের মাধ্যমে আজকের লেখার ইতি টানছি-
নছিব থাকিলে ভালা
হাইঞ্জায় বাত্তি জ্বলে
কলিমার হইল্তা যদি
থাকে আপ্না দিলে।
Check Also
আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল
ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে যে কয়জন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এ ভারত উপমহাদেশে কাব্য ও …