পালের নৌকা

ছোট্টকালে বর্ষা মৌসুমে যখন বিকেলে স্কুল মাঠে খেলতে যেতাম তখন প্রায় চার/পাঁচ কিলোমিটার দূরে সুরমা নদীর শাখা বাসিয়া নদীতে সাদা লম্বা গাছের মত কি যেন ধীরে ধীরে পশ্চিমের ভাটির দিক থেকে পূর্ব দিকে সিলেটের সুরমা অভিমুখে একের পর এক চলছে দেখে তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকতাম। ভাবতাম এতো লম্বা সফেদ কাপড়ে একের পর এক কারা যায়। মানুষতো এতো লম্বা হওয়ার কথা নয়, আবার এত দূর থেকে প্রত্যক্ষ করাও সম্ভব নয়। আগেকার বুড়োরা মজার মজার ভূতের গল্প করতেন নিশি রাতে নাকি তিন রাস্তার মধ্যখানে ভূত সফেদ কাপড় পরে আকাশ জমিন লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পথচারিকে ভয় দেখাত। ভাবতাম দিনের বেলায় তো এভাবে ভূত পেতœী প্রকাশ্যে লোকালয়ে চলার কথা নয়। পরক্ষণে জানতে পারলাম তা হচ্ছে পাল তোলা নৌকার উঁচু পাল। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না।
আগেকার যুগে মাঝিরা নৌকা চালাতেন বাতাসে ভর করে পাল তুলে। বাতাস অনুকূল না হলে দাঁড় টেনে গুণ টেনে চলতে হতো গন্তব্যে। লুঙ্গি কাছা দিয়ে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘পেছকুন্দা’ মেরে সীমাহীন কষ্টে গুণ টেনে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যেতে হত। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, পলি,

কাঁদা উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গুণ টানতে হতো জীবন জীবিকার তাগিদে। দৃশ্যটি বাংলার পল্লী প্রকৃতির রূপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল অনন্তকাল ধরে। দূর গন্তব্যে যেতে হলে মাঝিরা অনুকূল বাতাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করত যাতে পাল তুলে সহজেই কম সময়ে যাওয়া যায় গন্তব্যে। অনেক সময় মাঝিরা বাতাসের জন্য দুয়া দুরূদ পড়ত। বাতাস শুরু হলে পাল তুলে নৌকার মাঝিদের গ্র“প লিডার কাড়ালে বৈঠা ধরে মনের সুখে গান ধরতো ‘ওরে ও ভাটিয়াল গাঙের নাইয়া…। নৌকা চলত শা শা করে দ্রুত গতিতে। বাকীরা আয়েশ করে ঘুমাত অথবা প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রাণ ভরে উপভোগ করত। সারি সারি পাল তুলা নৌকার দৃশ্য নদীতে এক ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করত। অনেক দূর থেকে নৌকা না দেখলেও পাল দেখা যেত। মাল বহনের নৌকা ও গয়নার নৌকাসহ সব ধরণের নৌকায়ই বাতাস অনুকূল হলে পাল তুলা হতো। গয়নার নৌকায় লোকজন চলাচল করতেন এবং বিয়ে শাদীও হতো। পাল তুলা হলে নৌকার যাত্রীদের মধ্যে কি যে আনন্দ হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পুরনো পাল ছিঁড়ে গেলে মাঝিরা তাতে রঙ বেরঙ্গের তালি দিয়ে চালালেও পালের সৌন্দর্য্যে ভিন্ন রূপ পেত। প্রতিকূল বাতাস হলে গুণ টেনে এবং সাথে তালে তালে দাড় টেনে গন্তব্যে চলতেন মাঝিরা। দাড় টানার দৃশ্যও ছন্দময় শব্দ ছিল খুবই উপভোগ্য। ছাত্রজীবনের এ দৃশ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে একটি কবিতা লিখেছিলাম যার একটি লাইন হল ‘দাড় টেনে আর পাল তুলে ওই নৌকা চলে দিকবিদিক।’
বর্তমানে পালের নৌকা শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। বেশির ভাগ নৌকায়ই ইঞ্জিন সংযোজন করায় নদীতে নৌকা চলে দ্রুত গতিতে। ইঞ্জিনের ভট ভট বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় পল্লী প্রকৃতির শোভা আজ বিষিয়ে উঠেছে। পরিত্যক্ত তেল নদীর পানিতে ফেলায় পানি হচ্ছে দূষিত। মূল্যবান মৎস সম্পদ হচ্ছে ধ্বংস। নদীর তীরে যাদের বাড়ি তাদের ঘুমে হচ্ছে মারাত্মক ব্যাঘাত। বর্তমানে বিভিন্ন নদী পারাপারের খেয়া নৌকায়ও ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়েছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাধ্যমে চলাচলে সময় কম লাগলেও যান্ত্রিক এ যুগে শব্দদূষণযুক্ত ও পুরনো ইঞ্জিন ব্যবহার করায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। অন্যদিকে মৎস্য সম্পদ ক্রমান্বয়ে যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট মহলের নজর দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন।

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে যে কয়জন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এ ভারত উপমহাদেশে কাব্য ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *