হিয়ার মাঝে (৭ম পর্ব)

হিয়ার মাঝে (৬ষ্ট পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)
-“কোন্ ধ্যান ধারনা? ওহ্… হ্যাঁ…. অবশ্যই…সমাজে আমাদের একটা মানসম্মান আছেনা? ইরাকে কি আমরা কম দিচ্ছি? ফুল ফার্নিশড ফ্ল্যাট দিচ্ছি! ফার্নিচার সব হাতিলের। তারপর গহনাপত্র যা দিচ্ছি তা তো তুই জানিসই! তোর ফুপু তো বিনা পণে মেয়ে গছাতে চায়! এভাবে কে তার মেয়েকে নেবে? তারা কি রূপ ধুয়ে পানি খাবে নাকি? আমাদের ইরার জামাইকে যে প্লাটিনামের আংটিটা দিলাম তার দামইতো হবে…..! “
-“হয়েছে…থামো! শোনো মা…তোমাকে আমি স্পষ্ট বলে দেই,আমি যে মেয়েকে পছন্দ করবো তার বেলাতে এসব ফালতু সামাজিকতার ধুয়ো তুলতে পারবেনা বলে দিলাম। শ্বশুড়বাড়ি থেকে কিচ্ছু নেবোনা আমি! আমার যা আছে তাই.! মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু দাবী করবেনা তুমি…! “
রানী চোখ গোল গোল করে তাকালেন-
-“তুই আবার এর মধ্যে এলি কি করে?
আর কি বললি তুই? মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু নিবিনা মানে? তুই আমার একমাত্র ছেলে? কোটিপতির মেয়ে ছাড়া তোকে আমি বিয়ে দেবো মনে করেছিস? আমার কতদিনের শখ একমাত্র ছেলের বিয়েতে ধুমধাম করবো আমি আর তুই এসেছিস নীতিকথা শোনাতে? ঠিক করে বল্…এরকম এক আধটা জুটিয়েছিস নাকি? “
রাজ মৃদু হেসে আপনমনে বললো-“জুটাতে আর পারছি কই…দেখাই তো দেয় না! “
রাণী ভ্রু কুঁচকে বললেন-“কি বলিস একা একা? “
রাজ মায়ের দিকে তাকালো-“যদি জুটাতে পারি…তুমি কি তাকে মেনে নেবেনা? “
রাণী তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন! তর্জনী তুলে ছেলের দিকে তাক করলেন-
-“রাজ খবরদার বললাম…..খবরদার! আমাকে প্রাণে মারিসনা! তুই আমার একমাত্র ধন। যারে তারে জুটাইস না বাপ আমার! সমাজে আমার মাথা কাটা যাবে যদি তোর জন্য সেরকম পাত্রী না আনতে পারি তো! তোর জন্য মন্ত্রী লেভেল থেকে অফার আসে….জানিস তুই? মেয়ের বাপেরা তোর মত ছেলে পেলে বর্তে যাবে! তাহলে তুই কেন ফকিন্নী মার্কা মেয়ে বিয়ে করতে যাবি? তেমন হলে তো মেয়ে হাতের কাছেই ছিলো! বিয়ে করিয়ে নিজের ঘরে কি রেখে দিতে পারতাম না? “
-“কার কথা বলছো? “
মায়ের এমন কথায় বুক ধড়াস করে উঠলো রাজের! মা কি পৌষীর কথা বলছে? রাণী বললেন-
-“আরে পৌষীর কথাই যদি বলি….সে তো দেখতে শুনতে কোন অংশে কম না! কিন্তু আমি আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করাবোনা…এটা আমার সাফ কথা। তাছাড়া মেয়েটা ম্যানার্সও জানেনা! গাইয়া টাইপের। সারাদিন গ্রাম্য বউঝিদের মতো ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা করে! পুরুষ মানুষ দেখলে তিন লাফে ঘরে লুকায়। পুরাই খ্যাত..! কারো সামনেও যেতে চায়না! সে তো আমাদের বর্তমান কালচারে একদম আনফিট! ইসতিয়াকের মা কি দেখে মজেছে কে জানে? “রাণী মুখ বাঁকালেন।
রাজ নীরবে মায়ের কথা শুনছে আর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছে! মা কি ওকে সতর্ক করে দিচ্ছেন কথাগুলো বলে? কিন্তু রাজ কিভাবে ফিরবে? ও যে পৌষীকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছেনা!
রাণী বকবক করেই চলেছেন-
-“তাছাড়া পৌষীর মায়ের কি আছে তোকে দেবার মতো? যাক্ গে….যা হবার না তা নিয়ে কথা বলছি কেন? তোর জন্য আমি শহরের সেরা রুপসীকে খুঁজে বের করবো! আমার ছেলের বিয়ে সারা শহর জানবে! সবাই জানবে যে বিজনেস টাইফুন ‘আমজাদ চৌধুরীর’ ছেলে “হাসান আবরার চৌধুরী রাজ” এর বিয়ে হচ্ছে! তোর বিয়ে নিয়ে আমার যে কত প্ল্যান! তাই,খবরদার বাবা…পছন্দ করলে বুঝে শুনে করিস। তোর বাবা কিংবা আমি কেউই যা তা পাত্রীর সাথে তোকে বিয়ে করাবো না আগে থেকেই বলে দিলাম! “
রাজ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“হমম…বুঝলাম! আচ্ছা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মা! ফিরতে লেট হবে! ফ্রেন্ডরা কেউ এলে সন্ধ্যের পর আসতে বলবে…! “
বলে রাজ বেরিয়ে গেল! গাড়ী বারান্দায় থেমে থাকা দুটো গাড়ীর একটা খুলে তাতে উঠে পড়লো! ড্রাইভার সাথে নিলোনা, সে নিজেই চালাবে বলে!
রাণী ছেলের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বাঁকা হাসি হাসলেন! ভাবছেন,’তোমার মতলব আমি বুঝিনা ভেবেছো? তোমার মা আমি….তোমার মনের কথা আমি না বুঝলে মা হলাম কি করতে? ইসতিয়াকের যদি পৌষীকে পছন্দ হতে পারে তাহলে তুমিইবা বাদ যাবে কেন? তাই কথায় কথায় আগেভাগেই জানিয়ে দিলাম,পৌষির দিকে নজর দিয়ে লাভ নেই! আমি এটা কোনোদিনই মেনে নেবো না….কোনো অবস্থাতেই না! ইসতিয়াকের মা মানবে কিনা সেটাই তার ব্যপার! বরং সেটাও এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে যে এমন হতদরিদ্র মেয়ে তারা বিয়ে করাবে কিনা ! তাই বাপজান… তোমার মনে এসব চিন্তা এসে থাকলেও নিজে থেকেই সাবধান হয়ে যাও,আমি ইচ্ছে করে বুঝে শুনেই এসব কথা বলেছি….হুঁ হুঁ…! “
ভাবতে ভাবতে রাণী আপন মনেই নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলেন! সময় মতোই ছেলেকে সবক টা দিতে পেরেছেন তিনি! এবার ছেলে ঠিকই বুঝেশুনে চলবে!
রাজকে দেখে সিঁথি অবাক হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো!
-“হাই…রাজ? মাই হিরো..! এতদিন পর তোর পদধূলি পড়লো? “
রাজ কোনো জবাব না দিয়ে চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো!
এটা ফিনের বাড়ি।
ফিন রাজের এক ঘনিষ্ট বন্ধু। ওর বাড়ির লনে একত্রিত হয়েছে ওরা! বিরাট ধনী বাবার একমাত্র ছেলে। ওদের বাগানেরই এককোনে চেয়ার পাতা আছে! সেখানেই রাজ, ফিন আর সিঁথি বসেছে!


সিঁথি ওদের পুরোনো বান্ধবী। ভালো ছবি আঁকে। ওর গেটাপ দেখলে ছেলে না মেয়ে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়।
গত একমাসে রাজে এমুখো হয়নি।
তাই সিঁথি ওকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছে!
রাজ কোনো উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সিঁথিকে বললো-“কথা পরে বল্,আগে তোর মোবাইলটা বের করতো !”
সিঁথি বোকার মতো নিজের মোবাইলটা বের করে বলল-“বের করলাম…! “
রাজ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসছিলো,এবার একটু ঝুঁকে বললো-“তোকে একটা নাম্বার দিচ্ছি..তুই অন্য একটা মেয়ের নাম দিয়ে কথা বলবি এই নাম্বারে! “
বলে ইসতিয়াকের নাম্বারটা বের করে দেখালো!
সিঁথি অবাক হয়ে বলল-“কি বলছিস…? বুঝলাম না? “
-“আরে না বোঝার কি হলো? তুই পৌষী সেজে কথা বলবি..! “
-“পৌষী কিডা? “
-“পরে বলছি। আগে কথা শেষ কর। তোর এখানে কোনো রিস্ক নাই! কাজটা তুই করবি জাষ্ট আমাকে হেল্প করতে! “
-“মানে? বুঝলাম না….আর একটু ক্লিয়ার কর দোস্ত! “
-“উফ্…..! “
বলে রাজ দুহাতে মুখ ঢাকলো। তারপর হাত সরিয়ে সিঁথিকে বোঝাতে শুরু করলো!
-“শোন্,আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসি সেই মেয়েটার বিয়ে আরেক জায়গায় ঠিক হতে যাচ্ছে! বিয়েটা যে করেই হোক ঠেকাতে হবে..ব্যস! তুই সেই ছেলেটাকে ফোন করে বলবি যে তুই “পৌষী”! আর তুই অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসিস। তাই তোর পক্ষে ইসতিয়াককে বিয়ে করা সম্ভব না। সে যেন এটা থেকে বিয়ের স্বপ্ন দেখা ভুলে যায়। ব্যস…তোর কাজ এতটুকুই! বুঝেছিস কিছু না আবার বোঝাতে হবে? “
রাজ হাত ঝাঁকালো। সিঁথি হা করে ওর কথাগুলো শুনছিলো এবার ‘টুউউ…..করে বখাটে ছেলেদের মতো করে শীষ বাজিয়ে উঠলো সিঁথি!
চিৎকার করে ফিনকে ডাকলো-“অই ফিনের বাচ্চা শুইন্না যা! আমাদের হিরো তার নায়িকা খুঁজে পেয়েছে! একেবারে হাবুডুবু অবস্থা! “
ফিন কাছেই ছিলো!
একটা ট্রে হাতে ওদের পাশে এসে বসল! হাসিমুখে বলল-“তাই নাকি দোস্ত? এতোদিন তো জানতাম মেয়েরা তোর পেছনে লাইন মারে! আজ প্রথম শুনলাম তুই কারো প্রেমে পড়েছিস! কে সেই সৌভাগ্যবতী যে আমাদের হিরোকে একেবারে ল্যাং মেরে ফেলে কুপোকাত করে দিয়েছে? “
-“পরে সব বলবো দোস্তো ! আপাতত…এই উপকারটুকু কর! “মৃদু হাসলো রাজ!
-“আচ্ছা…এই রিকোয়েষ্টটা তোর ডার্লিংকেই করছিস না কেন? সে কি এই ছেলেকে মানে ইসতিয়াককে পছন্দ করে নাকি? “
-“আরে ধুর! সে এই টাইপের মেয়েই না! সে এসবের মধ্যে নাই! সে তো এটাও জানেনা যে আমি ওকে লাইক করি। সে বিয়ের আগে প্রেম থেকে একশ হাত দুরে…মানে সে খালি ওর জামাইয়ের সাথে প্রেম করবে। শালা এক বাসায় থাকি,সারাদিনে একনজর দেখার জন্য চাতক পাখির মতো হা করে থাকতে হয়! দেখা মেলেনা! কথা বলবো তো বহু পরে! “
-“কস কি? এ তো দেখি পাক্ পরহেজগার? এরে পাইলি কই? ” ফিন টিটকারীর সুরে বলে উঠল!
-“ও আমার আপন ফুপাতো বোন! ”
শান্ত স্বরে বলল রাজ!
-“তাই নাকি? তা আগে জানালে না? “
সিঁথির এ কথায় গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো রাজ! ও টেবিলে নিজের মোবাইলটা আনমনে ঘুরাচ্ছিলো!
তখন ফিন বলল-
“-“তুই যখন পাগল হইছিস তো সেইরকম মেয়েই হবে! বল্ না দোস্ত তোর লাভ এ্যাটাকের গল্পটা পুরোটা শুনি? খুব আগ্রহ হচ্ছে! “
-“আজ না দোস্তো,আরেকদিন…তাছাড়া আজ গল্প বলতে তেমন কিছুই না ! তাকে দেখলাম একদিন। একটা লজ্জাশীল মেয়ে তার নারীত্বের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা মেয়ের মধ্যে যা যা থাকা উচিত তার সবগুণ ওর মধ্যে আছে। উপরন্তু সে নামাজী পর্দানশীন অথচ সে কলেজ গার্ল। ইউনিক একটা কম্বিনেশন। আজকাল যেটা রেয়ার! “
-“হমমম…হুজুর! “
-“ওরকমই বলতে পারিস! “
-“বাট বন্ধু সে তো তোমার বিপরীত হয়ে গেলো। তুই যেরকম গার্লফ্রেন্ড পরিবেষ্টিত ছেলে সে হলো পর্দা করা মেয়ে। সে কি তোকে মন থেকে কোনোদিন মেনে নেবে? “
-“জানিনা। তবে ওকে না পেলে স্রেফ মরে যাবো! “
-“এতোটা সিরিয়াস হইছিস? “
-“আমি জানিনা আমার কেন এমন হচ্ছে। ওর জন্য আমি সব ছেড়ে দেবো। তবু ওকে ছাড়তে পারবোনা! “
-“পোলাপানের মতো কথা বলিস না রাজ। সে এখনো তোর প্রেমে পড়ে নাই তার আগেই তুই দেবদাসের ডায়লগ মারিস না! “
-“আচ্ছা,এসব কথা ছাড়তো! সিঁথি….তুই ইসতিয়াককে একটা ফোন দে তো মা! ‘
সিঁথি লাফিয়ে উঠলো-
-“ওহ্…এখন আমাকে তো এখন মায়ের মতোই লাগবে……তাই না? শালা বজ্জাত কোথাকার! “
সিঁথি দাঁত কিড়মিড় করে বললো!
রাজ দাঁত বের করে হেসে বললো!
-“কয়েকদিন পরে দেখবি তোরাও আমাকে নানা ডাকবি। আগে সব সেটেল করে নেই তারপর! “
-“হইছে…বুঝছি…তু গায়া…ইয়ার! এখন আমগো নানীর নামটা ক’…বাপ! “
-“পৌষী! “আস্তে করে বলল রাজ!
-“উঁঊহ্….কি আদুরে ভঙ্গিতে বললি! যেন তোর পুষি ক্যাট! দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে রে! ” সিঁথি বললো।
-“পরে…..এখন ফোন দে…! ‘রাজ ধমক লাগালো।
সিঁথি এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে ফোন দিলো! ওপাশ থেকে সম্ভবত ইসতিয়াকই ধরেছে! সিঁথি মিষ্টি স্বরে বলল-
-“জ্বী,আসসালামুআলাইকুম…ইসতিয়াক ভাই বলছেন? “
ফিন তো সিঁথির কথা শুনে পেটে হাত দিয়ে হেসে কুটিকুটি! রাজের মুখও নিরব হাসিতে ভরে গেছে। ডান হাতের দুটো আঙ্গুল ঠোঁটের উপর ঠেকিয়ে সিঁথির কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো রাজ।
(চলবে)

হিয়ার মাঝে (৬ষ্ট পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

One comment

  1. দয়া করে পরবর্তী অংশ তারাতাড়ি দিবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *