কাদিয়ানী ধর্মমত : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (২য় পর্ব)

মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন কালারুকী

(পূর্ব প্রকাশের পর)
উপরোক্ত সন্তানদের মধ্যে ইসমত বিবি, বশির আওয়াল, শওকত, মুবারক আহমদ ও আমাতুন নাসির এরা অল্প বয়সেই মারা যায়। মির্যা আহমদের প্রথম তরফের দুই পুত্রের মধ্যে (যারা বড় চাচা গোলাম কাদিরের আশ্রয়ে ছিল) বড় ছেলে সুলতান আহমদের বিয়ে হয় তার চাচির ভাই নিজামুদ্দীনের মেয়ের সাথে। উল্লেখ্য যে, নিজামুদ্দীনের সাথে মির্যা গোলাম আহমেদ সম্পত্তি নিয়ে মামলা হলে বড় পুত্র সুলতান আহমদ শ্বশুরের পক্ষ অবলম্বন করেন। পিতার ভ্রান্ত মতবাদে তিনি বড় একটা বিশ্বাসী ছিলেন না। সুলতান আহমদ সরকারি চাকরি করতেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বংশধর হিসাবে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন। ছোট ভাই ফজল আহমদ পিতার জীবদ্দশাই আহমদী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু পরে ঐ জামাতের দ্বিতীয় খলীফা মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (সৎভাই) এর হাতে বায়াত হন।
১৮৮৮ সালে মির্যা গোলাম আহমদ তার চাচার কন্যা উমরান নেছা বেগম ও আহমদ বেগের মেয়ে মোহাম্মদী বেগের সাথে বিবাহের ‘ইলহাম’ পান আল্লাহর তরফ থেকে, অর্থাৎ তিনি মোহাম্মদী বেগের সাথে বিবাহের ‘ইলহাম’ পান আল্লাহর তরফ থেকে, অর্থাৎ তিনি মোহাম্মদী বেগমকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু আহমদ বেগ এ বিয়েতে সম্মত ছিলেন না। তাই আবার আল্লাহর নিকট থেকে মির্যা গোলাম আহমদ ‘ইলহাম’ পান এই মর্মে যে, আহমদ বেগ এ বিয়ে না দিলে তিনি আড়াই বছরের মধ্যে মারা যাবেন। তখন এ বিয়ে হবে। কিন্তু এ ‘ইলহাম’ অগ্রাহ্য করে আহমদ বেগ মেয়ের বিয়ে দেন লাহোর জেলার পট্টি নিবাসী সুলতান মোহাম্মদ এর সাথে। ফলে আহমদ বেগ হঠাৎ বিয়ের ছ মাসের মধ্যে মারা যান। এই অবস্থায় মোহাম্মদী বেগের আম্মা উমরান নেছা বেগম এবং তার স্বামী সুলতান মোহাম্মদ- মির্যা গোলাম আহমদের নিকট দোয়া প্রার্থী হলে মির্যা আহমদ অভিশাপ ফিরিয়ে দেন। মোহাম্মদী বেগম মির্যা আহমদের চাচাত বোন উমরান নেছা বেগমের কন্যা আর আহমদ বেগের বড় ভাই মোহাম্মদ বেগের সাথে মির্যা আহমদের বোনের বিয়ে হয় এবং মির্যা আহমদের বড় ভাই গোলাম কাদিরের স্ত্রী মোহাম্মদী বেগমের আপন খালা। সুতরাং সকলেই পরিবারভুক্ত। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- একথা দাবি করা হয় যে, মির্যা গোলাম আহমদ আল্লাহর কাছ থেকে ‘ইলহাম’ (আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদেশ) পেয়েছিলেন যে তাঁর বংশ বৃদ্ধি হবে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁরা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষ অন্য সকলেই নির্বংশ হবেন। বর্তমানে মির্যা আহমদ এর খান্দানে সন্তান সন্তুতির সংখ্যা প্রায় চার শতাধিক। তাঁর চাচা গোলাম মহিউদ্দীনের অধস্তন বংশধর মির্যা গুল মোহাম্মদ নিঃসন্তান হয়ে মারা যান। সূত্র : ইসলামের ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্ঠী- পৃষ্ঠা : ৭১-৭২
“আজাদপ্রিয় মুসলমানদের অন্তরে ইসলাম ও ঈমানের ছদ্মাবরণে কুফ্র অনুপ্রবেশ করিয়ে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করে তাদের জিহাদের স্পৃহা চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়ার লক্ষ্যে অরিয়েন্টালিস্টগণ (গুপ্তচর) যেসব দাঁড় করায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মতবাদ হলো ‘কাদিয়ানী মতবাদ’। সূত্র : ভ্রান্ত মতবাদ সমূহ ও তার জবাব-১০১। “ইংরেজরা এদেশে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এসে ক্রমশ ক্ষমতার শীর্ষ দেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বিষয়টি সচেতন আলিম-উলামা অনুভব করতে পেরে সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁরাই সোচ্চার হন। কিন্তু মুসলমানদের দুর্ভাগ্য, জাতির নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিলো, তারাই পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে ইংরেজদের সাথে মিলিত হয়ে নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য পলাশীর আম্র কাননে অস্তমিত করা হলো। এরপর থেকেই ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে আলিম-উলামা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করতে থাকলেন।
১৮০৩ সালে মোঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়। ইংরেজরা রাজধানী দিল্লি দখল করে। ১৮০৫ সালে তদানীন্তন ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা সম্মান-মর্যাদার অধিকারী বুযুর্গ দিল্লির শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী (১৭৪৫-১৮২৩ ঈসায়ী) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন। সে ফতোয়ায় তিনি ইংরেজদের ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন এবং এদেশকে ‘দারুল হারব’ (শত্র“ কবলিত দেশ) ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করার আহ্বান জানান। ইসলামের দুশমন দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন ক্ষীণ গতিতে হলেও চলতে থাকে। এরপর ইসলামের বীর মুজাহিদ সায়্যিদ আহমাদ শহীদ বেরলবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৭৮৬-১৮৩১ ঈসায়ী) শত্র“র বিরুদ্ধে ঝড়ের গতিতে মুজাহিদ আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ইংরেজ শক্তি ও তাদের পা চাটা গোলামের বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় বালাকোটের ময়দানে ১৮৩১ সালের ৬ মে ইসলামের এই বীর মুজাহিদদ্বয়কে সঙ্গী-সাথীসহ হত্যা করে তাদের বিরোধী আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হয়। আলিম, উলামাগণের নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লব বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের কারণে ব্যর্থ হয়। তারপরেও সশস্ত্র আন্দোলন চলতে থাকে, ইংরেজরা দিশেহারা হয়ে মুসলিম নামধারী লোকদেরকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করে তাদের মাধ্যমে দখলদার ইংরেজ বিরোধী যে জিহাদ চলেছিলো, সে জিহাদ হারাম বলে এসব দালাল গোষ্ঠী ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা থেকে জিহাদের অনুপ্রেরণা স্থিমিত করার চেষ্টা করে।


শুধু তাই নয়, ইসলামের লেবাসধারী একশ্রেণির লোকদেরকে রাতারাতি পীর (ভণ্ডপীর) সাজিয়ে তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ও ইংরেজদের পক্ষে ফতোয়া দিতে থাকে। এসব ফতোয়া যখন ব্যাপকভাবে সাধারণ মুসলমানদের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হলো, তখন মুসলমানদের মধ্যে ফিতনা শুরু করার উদ্দেশ্যে তারা বেছে নিলো পাঞ্জাবের গুরুদাশপুর জেলার কাদিয়ান নামক স্থানের অধিবাসী শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মির্যা গোলাম আহমদ নামক এক জাহান্নামের কীটকে। এই গোলাম আহমদ নামক লোকটি প্রথমে ইসলামের একজন প্রচারক হিসেবে সাধারণ মুসলমানদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করলো। কিছুদিন পর সে নিজেকে মুজাদ্দিদ (ধর্মসংস্কারক) দাবি করলো। তারপর সে নিজেকে প্রতিশ্র“ত ইমাম মাহদী হিসেবে দাবি করলো। এরপর সে নিজেকে নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম বলে ফতোয়া দিলো। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার শরীয়তের ভিত্তি স্থাপন করলো ইংরেজদের শর্তহীন অনুগত্যের উপর। ইংরেজদের অর্থ ও মদদপুষ্ট পুস্তক রচনা করে প্রচার করলো এবং তার রচিত বই-পত্রে সে ইংরেজদেরকে এ দেশে আল্লাহর রহমত হিসেবে ঘোষণা করলো।
তার অপপ্রচারে যারা প্রলুব্ধ হতো, তাঁদেরকে ইংরেজ রাজশক্তি অর্থ-বিত্ত দিয়ে, উচ্চপদে চাকরিসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি করলো। ইংরেজসৃষ্ট মির্যা গোলাম আহমদ কায়িদানীর অনুসারীরাই ‘কাদিয়ানী’ নামে পরিচিত। ইসলামের দুশমন চরম মুসলিম বিদ্বেষী ইয়াহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের ‘হাইফা’ শহরেই কাদিয়ানীদের প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত এবং সেখান থেকেই পরিচালিত হয় তাদের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম। লন্ডনেও তাদের বিশাল কেন্দ্র রয়েছে। তাদের পৃথক টিভি চ্যানেল রয়েছে (যার নং ৭৮৭)। সাধারণত বিজ্ঞাপন ব্যতীত টিভি চ্যানেল-এর কার্যক্রম চালু রাখা অসম্ভব। পক্ষান্তরে এ ‘এম.টিভি’ চ্যানেল বিজ্ঞাপন ব্যতীতই বিশ্বব্যাপী পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কাদিয়ানীদের টিভি চ্যানেল এ ‘এম. টিভি’ ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এদের আখড়া রয়েছে। ঢাকায় এদের কেন্দ্র বখশী বাজারে। তাই কাদিয়ানীরা মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান হরণ করার কাজে নিয়োজিত। (সূত্র : কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়- পৃষ্ঠা : ৯-১০)

(চলবে)

(১ম পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *