রিকশা ভ্রমণে একদিন…

“এ্যাই রিকশা, যাবেন? “

“জি আপা।”

“স্টেশনে যাব।”

“আচ্ছা আপা, উঠেন।”

“ভাড়া কত? “

“আপনে যতো দিবেন। “

“৩০ টাকা দিব।”

“আচ্ছা দিয়েন।”

অটো রিকশাটি চলতে শুরু করলো তাঁর নিজস্ব গতিতে। আমি নানুর পাশে আরামসে বসে আছি। ঠোঁটে একটা বিজয়ের হাসি। আজ খুব ভালো ভাবেই জিতে গেছি। রিকশা চালক ৩০ টাকায় রাজি হয়ে গেল! উহু, ভাবতেই অবাক লাগছে। যেখানে ৫০ টাকার কম যেতে চায় না সেখানে ৩০ টাকাতেই স্টেশনে যেতে পারব! আহা, বাকি টাকা দিয়ে ছোট্ট বোনের জন্য বাদাম কিনে নেয়া যাবে। হঠাৎই রিকশাটি জোরে ব্রেক কষলো। মূহুর্তেই আমার কল্পনায় ছেদ পড়লো। ইতিমধ্যেই আমার পঞ্চইন্দ্রিয় ব্রেনে সংকেত পাঠিয়েছে। এক মূহুর্তেও দেরী না করে আমি দু’হাতে জাপটে ধরলাম নানুকে। ততক্ষণে নানু তাল সামলাতে না পেরে সিট থেকে উঠে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গেছে। পাশে তাকাতেই দেখলাম, অন্য আরেকটি রিকশার সাথে বেশ বড় রকমের সংঘর্ষ ঘটেছে। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার দয়ায় আমরা বিপদের মুখ থেকে ফিরে এসেছি। খানিকক্ষণ সেখানে বাকবিতন্ডা হলো। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার রিকশাওয়ালা সব কিছু হজম করে নিল। একটি ঢুঁ শব্দও করলো না। এরপর পাশের রিকশাটি সেখান থেকে প্রস্থান করল। ক্ষয়ক্ষতি যা হবার আমাদের রিকশাটারই হয়েছে। চাকার বেশ কয়েকটি স্পরক ছিঁড়ে গেছে। লোকটি সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর আবারও রিকশা চলতে শুরু করলো ধীর গতিতে। ” জানেন আপা, ছোট্ট ভাইটি আমার হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমি বড় ভাই হয়েও কিছুই করতে পারছি না।” হঠাৎ রিকশা চালকের এহেন কথায় আমি চমকে উঠলাম। পিছন থেকে লোকটির মুখের অবস্থা বোঝা গেল না। তবে কন্ঠ স্বরটা ভারাক্রান্ত ছিল। আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম, ”কি হয়েছে আপনার ভাইয়ের? ” ” অনেক টানাটানির সংসার আমাদের। দুই ভাই-ই পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু উপার্জন করি। ছোট ভাইটি একটা বিল্ডিংয়ে কাজ করছিল। ঘটনাক্রমে ওখানে ছোট একটা বিস্ফোরণ হয়। অন্যান্য মানুষ গুলো বাঁচলেও ঝলসে যায় আমার ছোট্ট ভাইটি। পুড়ে যায় তাঁর শরীরের প্রায় অর্ধেক। হাসপাতালে নেয়ার পর গ্রামের লোকজন অনেক সাহায্য করেছেন। প্রতিদিন মেডিসিনের পাশাপাশি তাঁর শরীরে অনেক দামী ইনজেকশন পুশ করতে হয়। আমিও ভাইয়ের সুস্থতার জন্য হাতে তুলে নিলাম রিকশা। ডাক্তার এ-ও বলেছেন তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত রাজধানীতে নিতে হবে। নয়তো বড় ধরনের কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ” এই পর্যন্ত বলেই লোকটা থেমে গেলেন। হয়তো তাঁর গলা ধরে আসছিল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছিলাম এক সংগ্রামী ভাইয়ের হৃদয় বিদারক ঘটনা।

মূহুর্তেই ভুলে গেলাম আমার জিতে যাবার কথা। বেছে যাওয়া রিকশা ভাড়া দিয়ে ছোট বোনের জন্য বাদাম কেনার কথা। কত আর বয়স হবে ছেলেটার? এই ২২/ ২৩। এই বয়সে আমি নিশ্চিন্তে ছুটে বেড়াচ্ছি একস্থান থেকে অন্যস্থানে। ইচ্ছে মতো বাবার টাকা ওড়াচ্ছি। সেখানে আমার বয়সী এক ভাই জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। কলিজার টুকরো ছোট ভাইয়ের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করছেন না। মূহুর্তেই মনে পড়ে গেল আমার ছোট্ট বোনটির কথা। যে আমার কলিজার একাংশ। নাহ, এর বেশি ভাবতে পারছি না। খুবই ভালোবাসি আমি তাঁকে। সামনাসামনি সদা শাসনের লাঠিটা থাকলেও হৃদয়ের বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে তাঁর বিচরণ। হৃদয়টা আমার হু হু করে কেঁদে উঠলো। ” আমি পারিনি আপা। আমার ভাইয়ের জন্য ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। ” ছেলেটি নিজের আক্ষেপ প্রকাশ করল। খেয়াল করলাম আমার কন্ঠস্বরটা অসার হয়ে আসছে। বরাবরের মতো মুখে কুলুপ এঁটে গেছে আমার। হৃদয়টা আবারও কেঁদে উঠলো। মনের ভিতরেটা অজানা একটা কষ্টে ছেয়ে গেল। ” আপা, এই খানে নামবেন?” ” জি, দাঁড়ান। ” সেই সাথে ব্যাগ হাতড়াচ্ছিলাম আমি। অন্য একটা ফান্ডে দান করার জন্য কিছু আপুর টাকা ছিল। সেটাই বাড়িয়ে ধরলাম লোকটির দিকে। ” আপনার ভাইয়ের জন্য সামান্য কিছু। ” লোকটির ছলছল নয়নে কৃতজ্ঞতার চাহনি। যথেষ্ট স্পেস রেখেই তিনি টাকাগুলো নিলেন। ” আপনি যে আমার কত বড় উপকার করলেন এটা বোঝাতে পারব না আপা। আমি খুব খুশি হয়েছি। ” সত্যিই লোকটার মধ্যে অদ্ভুত একটা আনন্দ বিরাজ করছিল। হয়তো আজকের মতো তাঁর ভাইয়ের ঔষধের টাকাটা যোগাড় হয়ে গেছে বলে। লোকটাকে বুঝতে খুব জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট ভদ্র পরিবারের সন্তান মনে হলো। মানুষ কে সম্মান দিতে জানে। প্রয়োজন আজ তাঁকে অন্যের কাছ থেকে নিতে বাধ্য করছে। চিন্তার ছাপটাও বয়সে ফুটে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে, কলিজার টুকরো ভাইয়ের চিন্তায় তাঁর বয়স বেড়ে দিগুণ। নানু মনিও নেকাবের নিচ থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন । এরপর নানুমনিকে নিয়ে পা বাড়ালাম স্টেশনের দিকে। স্টেশনের সামনে বিস্তৃত মাঠ। চারিদিকে বিভিন্ন বয়সের অনেক মানুষ রিকশা, অটো সমেত যাত্রীদের আসার প্রহর গুনছে। অনেক বড় বড় ফলের দোকানের মাঝেও একজন বৃদ্ধ সামান্য কিছু বরই নিয়ে বসেছে। বেশির ভাগ লোক সেটা দেখতে পেলেও ছুটছে বড় বড় ফলের দোকানগুলোর উদ্দেশ্যে । কে জানে! কত গল্প এ মানুষগুলোর জীবনে জড়িয়ে রয়েছে। যে গল্পগুলো কেউ জানে না। যে অজানা গল্পগুলো হার মানায় রুপকথাকে-ও। তখন খাঁ খাঁ রোদ্দুরের মধ্যেও এক চিলতে হাওয়া এসে আমার ঘর্মাক্ত দেহ ছুঁয়ে গেল। আহা! কি এক প্রশান্তি। এ যে মহান রবের পক্ষ থেকে একটি নেয়ামত।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *