প্রিথি (সায়েন্স ফিকশন)

১ম পর্ব
ভয়ঙ্কর বার্তা
হলোগ্রাফিকের বড় স্ক্রিনের সামনে দাঁডি়যে় কারও সঙ্গে কথা বলছেন ওমর ফারুক। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে অন্য একজনকে। যার সঙ্গে তার কথা হ”েছ। ওমর ফারুকের বা হাতে আজকের একটি দৈনিক পত্রিকা। তারা দু’জনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তিনি যতই কথা বলছিলেন, ততই তার চেহারায় পরিবর্তন আসছিল। ধীরে ধীরে মলিন হযে় এলো। এক সময় তার গলার স্বরও অনেকটা পাল্টে গেলো। আস্তে আস্তে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
স্ক্রিন থেকে সেই লোকটির ছবি মুছে গেলে হলোগ্রাফিক অফ করলেন তিনি। তবে মুখ ফেরালেন না পর্দা থেকে। ওমর ফারুকের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীকে এখন খুবই আনমনা লাগছে। তাকিযে় আছেন স্ত্রিনের দিকে। চেহারায় দুশ্চিন্তার চাপ। গভীর ভাবে ভাবছেন কিছু। এমুহূর্তে কি একটা বিষযে়র সমাধান যেন খুঁজে ফিরছেন তিনি। একসময় বসলেন সোফায় গিযে়। হাতের পত্রিকাটি ছুঁডে় ফেললেন ফ্লুরে। সেটি একটু দূরে গিযে় ছডি়যে় পড়লো। বাম হাত উরুর উপরে শুইযে় ডান হাতের পাঁচ আঙুল দিযে় পুরোটা মুখ আড়াল করে রেখেছেন।
‘কি ভাবছো, ফারুক?’ স্ত্রী আনোয়ারা ফারুকের কণ্ঠ শোনা গেল। নিজের স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তার দিকে তাকালেন। তবে সেটি এক মুহূর্তের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিযে় নিলেন। কবে যে স্ত্রী এসে তার পাশে বসেছেন তা টেরই পাননি তিনি। কথা না বলে হেলান দিযে় বসলেন। চেহারায় ভীষণ উদাসী ভাব। সামনের দিকে চেযে় থাকা চোখগুলো আর মন একটা সমাধান খুঁজছে। ভাসছে ভাবনার অকূল দরিয়ায়! কিন্তু কোন সমাধান পাচ্ছে না। ‘কি ব্যাপার?’ স্ত্রী কোন জবাব না পেযে় আবার জানতে চাইলেন, ‘কথা বলছো না যে?’
‘আনু,’ একটু নডে়চডে় বসলেন ওমর ফারুক। স্ত্রীকে পুরো নাম ধরে না ডেকে আনু নামেই ডাকেন। ‘একটা বিপদ এগিযে় আসছে।’
‘বিপদ!’ আনোয়ারা বিষ্ময় প্রকাশ করলেন। আরও আগ্রহী হযে় ঝুঁকলেন তার দিকে। ‘কি বলো! বিপদ কিসের?’
‘শুধু বিপদ নয়।’ ফারুক বলছেন, ‘রীতিমতো মহাবিপদ!’
‘বোঝলাম না।’ মাথা ডানে-বাযে় নাড়ালেন আনোয়ারা। তার চোখ স্বামীর দিকে। মাথা কাত করে তার দিকে তাকিযে় আছেন। যেন তার চেহারার ভাষা পডে় বুঝতে চেষ্টা করছেন আরও ভাল ভাবে।
‘ট্রনিকটন গ্রহের তিন বিজ্ঞানী এ্যালিযে়ন পৃথিবীতে আসছেন।’
‘সে তো ভাল সংবাদ। এখানে বিপদের কি দেখলে?’
‘হ্যাঁ। সে ভাল সংবাদই। আমাদের বিজ্ঞানীরা সেটাকে ভাল সংবাদ হিসেবেই দেখছেন। তবে আমি তাকে ভাল সংবাদ হিসেবে দেখছে না। আমি জানি তাদের। আমি স্পষ্ট দেখতে পা”িছ তাদের উদ্দেশ্যটা অতি ভয়ঙ্কর। ওরা খুবই নেরো মাইন্ডের, আনু।’
আনোয়ারা স্বামীর দিকে থেকে চোখ সরালেন না। তিনি আগের মতোই বিষ্ময় প্রকাশ করলেন, ‘মানে…’
‘হ্যাঁ।’ এতোক্ষণে ফারুক স্ত্রীর দিকে চোখ ফেরালেন। তিনি নীরব। আনোয়ারাও।
ওমর ফরুক বিজ্ঞানী হলেও আনোয়ারা বিজ্ঞানী নন। কিন্তু বিজ্ঞান নিযে় তার পড়াশোনা। ফারুকের বিজ্ঞান নিযে় সমস্যা দেখা দিলে তিনি সব সময় সহযোগিতা করেন, বুদ্ধি-পরামর্শ দিযে়। তিনি এও জানেন যে, ওমর ফারুক মিথ্যে বা ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে কখনও কিছু বলেন না। ভবিষ্যৎ বাণী করেন না। যা বলেন, তা অভিজ্ঞতা, গবেষণা কিংবা দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতেই বলেন। কোন বৈজ্ঞনিক বিশ্লেষণ ছাড়া তিনি কোন ধারণাকে প্রযে়াগ করেন না, বাস্তবেও রূপ দিতে চান না। আজ ওকথা শোনার পর তিনি সত্যিই বুঝতে পারলেন, ওমর ফারুক যা বলছেন সত্যি বলছেন আর এটাই শেষ পর্যন্ত বাস্তব হবে।
বিপদের কথা শোনে নিজেকে অসহাযে়র মতো মনে হলো। চেযে় থাকলেন ফারুকের দিকে। তার চেহারায়ও এখন আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার চাপ। ফারুক পলক ফেললেন। চোখ সরালেন প্রিয়তমা স্ত্রীর দিক থেকে। তিনিও এক সময় চোখ সরিযে় হেলান দিলেন সোফায়। মাথা পেছনে ঠেস দিযে় উপরের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করলেন। ভাবছেন কিছু। একটু পরে ওমর ফারুক বসা থেকে উঠে টেবিলের দিকে এগুলেন। সেখানে রাখা বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে তা এক নিঃশ্বাসে পান করলেন। চেয়ারের উপর রাখা তোয়াল হাতে নিযে় কপাল মুছলেন। কপালে সম্ভবত ঘাম জমে গিযে়ছিল।

ওমর ফারুক সব সময় নিজের ক্ষুদ্রযান নিযে় চলাফেরা করেন। পাবলিক যানগুলোতে আগে চড়তেন। যখন অবসরে যাননি তখন অফিসের ক্ষুদ্রযান ছিল। প্রত্যেক পরিচালকের জন্য বরাদ্দ করা যান অবসরে যাওয়ার সময় সেটি নিজের হযে় যায়। তার জন্য বরাদ্দ যানটিও তাই হযে়ছিল। কিন্তু তিনি সেটি নেননি। বিনযে়র সঙ্গে ফিরিযে় দিযে়ছেন। পরে নিজেই কিনেছেন একটি। আর সেটি ব্যবহার করেন এখন। ক্ষুদ্রযানটি রোবটিক সিস্টেমের। আলাদা কোন চালকের প্রযে়াজন হয় না। শুধু নির্দেশনা প্রযে়াজন।
বাসার গ্যারেজে রাখা সেটি। পাশে রাখা আরেকটি যান। সেটি আনোয়ারার। যখন তিনি একা কোথাও বের হন তখন ওই যান ব্যবহার করেন। আর দু’জনে এক সাথে গেলে প্রায়শই ফারুকের যানে করে যাওয়া হয়। তার ক্ষুদ্রযানের নাম ট্যার্লু।
কাছে আসার আগে দূর থেকে যানের দিকে তাকালেন। পাশাপাশি রাখা দুটি। নিজের যানের কাছে এসে বললেন, ‘হ্যালো টার্লু, শুভ সকাল।’
কিন্তু গলায় রস নেই আজ। অন্যদিন হলে এর সঙ্গে ‘আমার প্রিয় সহচর’ শব্দটাও যোগ করতেন তিনি। আজ তা করলেন না।
‘ধন্যবাদ স্যার, শুভ সকাল।’ যানের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো। দরজার কাছে আসার আগেই সেটি খুলে গেলো। চডে় বসে সিটের ব্যালট বাধলেন।
‘সেন্ট্রাল অফিসে।’ বলে ভাল হযে় বসলেন। সামনের মনিটর আগে থেকেই চালু রযে়ছে। এবার চালু হলো ক্ষুদ্রযানটি। সেন্ট্রাল অফিস মানেÑ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। এখান থেকে কেন্দ্রে যেতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে।
বেশ আরামদায়ক এই যানটি। ছোট্ট; কিন্তু আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা রযে়ছে। অন্য অনেক যানের চেযে় সুবিধা বেশি, কারণÑ এটি প্রথম শ্রেণীর একটি ক্ষুদ্রযান। আর তা নবম মাত্রার সর্বশেষ সংস্করণ। নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় একে এখনও পর্যন্ত আর কোন যান অতিক্রম করতে পারেনি।
যান চলতে শুরু করেছে। সেদিকে ফারুকের খেয়াল নেই। অন্যমনষ্ক তিনি। নিচের দিকে চেযে় কিছু ভাবছেন। হাতলে পুরো হাতের ভর দিযে় আস্তো আস্তে কপাল চুলকাচ্ছেন। অন্য দিন হলে যানের সঙ্গে এটা-ওটা নিযে় কথা বলতেন। আজ একেবারেই নীরব। যানের রোবটিক সিস্টেম কি সেটা বোঝতে পেরেছে?

সম্ভবত ভাবছে। অবাক হওয়ার মতো ক্রিটিক্যাল গুণ না থাকলেও সে কিছু একটা অনুমান করতে চেষ্টা করছে। তা না হলে মিনিটখানেক ধরে রানওতে দাঁডি়যে় আছে আর ফারুক নামছেন না, তা দেখেও সে নীবর থাকতো না। বলতো, ‘আমরা পৌঁছে গেছি! আমি কি এখানেই অপেক্ষা করবো?’ না, তা বললো না। সে বললো অন্যকথাÑ ‘মি. ফারুক। আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন?’
ফারুক কথাটা শুনে যেন সম্বিত ফিরে ফেলেন। ‘এ্যাঁ, না।’ বলে দরজার কি’তে চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো দরজা। নেমে পড়লেন কিছু না বলেই। সিস্টেমও আর কিছু বললো না। সে নিশ্চয় একটু অবাক হযে়ছে। নবম মাত্রার রোবটিক যানের অবাক হওয়াটাও বিষ্মযে়র কিছু না। ওমর ফারুক নেমে নিচের দিকে চেযে় হাঁটছেন। আশাপাশে কোন দিকে আজ তার খেয়াল নেই। কোথাও কিছু আছে কি না তাও টের পেলেন না। কেন্দ্রের ভেতরে আসতে সময় লাগলো এক মিনিটেরও কিছু কম।
আসার পথে তাকে দূর থেকে দেখছিলেন একজন। যান রানওযে়তে নামা থেকে শুরু করে অপেক্ষা, ভেতর থেকে নামা, কোন দিকে না তাকিযে় দ্রুত ভেতরের দিকে চলে যাওয়া সব ওখানে দাঁডি়যে় পর্যবেক্ষণ করলেন অদ্ভুৎ চেহারার এক এ্যালিযে়ন। তিনি ভীনগ্রহের একজন বিজ্ঞানী। ফারুকের এই অন্য মনস্কতা দেখে তিনি খানিকটা অবাক হলেন। একটা মানুষ এভাবে নিচের দিকে চেযে় দ্রুত হেঁটে চললে হয়তো অবাক হওয়ারই কথা। আর যদি তাকে দেখতে মনে হয় সম্ভ্রান্ত আর প্রবীণ কেউ। আসার পথে যদি আশাপাশের লোকজন খুব ঘনঘন হাই-হ্যালো স্যার বলে তাহলে তো কথাই নেই। তার বেলায় তাই হচ্ছিল। কিন্তু কারও দিকে তার খেয়াল নেই। মনে হলো তিনি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। গভীর মনোযোগে ভেবে ভেবে হাঁটছিলেন। আর সেই বিষয়টিতেই খটকা লেগেছিল ভীনগ্রহী বিজ্ঞানীর। এদিকে যখন অদ্ভুৎ এই মানুষটি ওমর ফারুক নিযে় এতো কিছু ভাবছেন, তখন তিনি কেন্দ্রের অফিসিয়াল কক্ষে প্রবেশ করেছেন। তার সামনে বিজ্ঞানী অ্যামসন।
ফারুক রুমে এসে ঢুকার আগে অ্যামসন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দরজার একেবারে সামনে এগিযে় এলেন। আগেই সিস্টেম থেকে তাকে জানানো হযে়ছে মি. ফারুক আসছেন। আর রুমে ঢুকার আগে মনিটরে দেখছিলেন রানওযে় থেকে নেমে সোজা তার রুমের দিকে আসছেন ওমর ফারুক।
ভবনের এই তলায় মানে তৃতীয় তলার ডি ব্লকে দু’জন সিনিয়র বিজ্ঞানী বসেন। কিন্তু ওমর ফারুক এই ব্লকে এলে সাধারণত আর কারও কাছে যান না। তার কাছেই আসেন। তাই ব্লকে ঢুকতে দেখে অনুমান করেছেন তার রুমেই আসছেন ফারুক। ‘মি. ফারুক। আপনাকে স্বাগতম।’ একটা হাসি দিযে় বলতে থাকলেনÑ ‘এই মুহূর্তে আমি আপনাকে টেলিফোন করতাম…’
‘তার আগেই আমি চলে এসেছি। তাই তো?’
‘আপনার মতো বিজ্ঞানীকে এখন আমাদের খুবই প্রযে়াজন।’ অ্যামসন এগিযে় যাচ্ছিলেন তার টেবিলের দিকে। কিন্তু ওমর ফারুক ওদিকে না গিযে় সামনের সোফার দিকে পা বাড়ালেন। তাকে অনুসরণ করলেন অ্যামসনও। সোফার কাছে আসলে ফারুককে বসতে বললেন, ‘বসুন, প্লিজ।’ তিনিও বসলেন পাশের সোফায়।
‘আপনার কথার পেছনে কোন রহস্য না থাকলেই আমি বেশি খুশি হবো।’
‘মানে!’ অ্যামসন চমকালেন খানিকটা। ‘না না। রহস্যের কিছু নেই। আমার তরফ থেকে এখানে লোকানোরও কিছু নেই। আমাকে তো আপনি জানেন ভাল করে। তাই না?’
ওমর ফারুক তার কথা শুনছেন তখন ঠিক। কিন্তু মনোযোগ যে সেদিকে নেই তা টের পেলেন অ্যামসন। বসেই আনমনা হযে় নীরবে নিচের দিকে তাকিযে় আছেন তিনি।
‘মি. ফারুক। আপনি গুরুতর কিছু ভাবছেন মনে হয়?’
‘এ্যাঁ, না কিছু না।’ একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা, মি. অ্যামসন। উনারা কি চলে এসেছেন?’
‘উনারা মানে! কারা? আপনি কি আমাদের অতিথি বিজ্ঞানীদের কথা বলছেন?’
‘অতিথি বিজ্ঞানী!’ কথাটা অবাক হযে়ই বললেন। অ্যামসন তার অবাক হওয়ার দিকে খেয়াল দিলেন বলে মনে হলো না। ‘হেঁ, তারা। তারা আসেননি? নাকিÑ’
‘এসেছেন।’ দুই সেকেণ্ড বিরতি দিযে় জানতে চাইলেন, ‘আপনি ট্যার্লু নিযে় এসেছেন নিশ্চয়?’ ওমর ফারুক শব্দ করে উত্তর না দিযে় মাথা উপর-নিচে দোলালেন।

‘রানওযে়তে তাহলে অদ্ভুত ধরনের একটি আকাশযান দেখে এসেছেন?’
‘আমি খেয়াল করিনি।’
‘আমরা কিন্তু এখনও সে রকম অত্যাধুনিক কোন যান তৈরি করতে পারিনি। আমরা এগুলো তৈরি করা থেকে এখনও অনেক পিছিযে় রযে়ছে। কতটুকু পিছিযে় রযে়ছি, তাদের যানের পাশে আমাদের পরিবহনগুলো দাঁড় করালে টের পাওয়া যায়।’ তারপর গলার আওয়াজ একটু নিচু করেÑ যেন কেউ শুনতে না পায় সে রকম ফিসফিস আওয়াজ করে বললেন, ‘তবে দেখবেন, এবার তৈরি হবে। হেঁ।’
ওমর ফারুক সে কথায়ও কোন সাড়া দিলেন না। আগের মতো নীরব থাকলেন। ‘উনারা এখন কোথায়?’
‘গেস্ট হাউজে।’ বললেন অ্যামসন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাদের সঙ্গে তো এখনও আপনার পরিচয় হয়নি? তাই না?’
‘না।’
‘আসুন তাহলে, পরিচিত হযে় আসবেন।’
‘না, থাক। এখন না।’ ওমর ফারুক আস্তে করে বললেন। ‘পরে কোন এক সময় পরিচিত হওয়া যাবে। এ্যাঁ, হেড প্রোপাইটার এখনও আসেননি?’ দেয়ালের বাম পাশে লাল, নীল, হলুদ রঙের ছোট্ট বাতির মধ্যে হলুদটার দিকে তাকিযে় বললেন ওমর ফারুক। বাতিটা নেভানো। তার অর্থ হেড প্রোপাইটার কেন্দ্রে নেই। থাকলে বাতি জ্বলতো।
তার প্রশ্ন শুনে অ্যালসনও ওদিকে তাকালেন। ‘আপনি আসার একটু আগে তিনি বেরিযে় গেছেন। তবে আজ আবার আসলেও মনে হয় একটু দেরি হবে।’
‘ঠিক আছে তাহলে,’ বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন ওমর ফারুক। ‘আসলে বলবেন, উনার সঙ্গে আমার জরুরী প্রযে়াজন আছে। আমি এখন চললাম।’
‘আমি ভাবছিলাম আপনি এসেছেন জরুরী কিছু কথা বলবো।’
‘আজ না। অন্যদিন। খুব একটা ভাল লাগছে না আজ।’
‘হেড প্রোপাইটারকে কিছু বলবো? আপনি আসবেন, নাকি তাকে যেতে বলবো?’
‘আমিই আসবো।’
‘কখন? কোন দিন?’
‘আগামী কাল সকালে।’
‘ঠিক আছে। আমি তাকে সংবাদটা পৌঁছে দেবো।’
‘ভাল থাকবেন।’
ওমর ফারুক তাকে আর কোন কথা বলতে না দিযে় হাঁটতে লাগলেন। অ্যালসনের রুম থেকে বেরিযে় কেন্দ্রের বাইরে এলেন। আসার পথে আগের মতো কারও সঙ্গে কোন কথা বললেন না। একেবারে ক্ষুদ্রযান ট্যার্লুর কাছে এসে দাঁড়ালেন। দরজা খুলে গেলে তাতে চড়তে যেযে় চোখ গেল বাযে়। দৃষ্টি ওখানে থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। যানে না উঠে ওদিকে আগ্রহ নিযে় তাকালেন। মনে পড়লো অ্যালসনের কথা। তিনি বলেছিলেন, ভীনগ্রহীরা অদ্ভুত ধরণের আকাশযান নিযে় এসেছে। এটা নিশ্চয় সেই যান। আগে কখনও তিনি পৃথিবীতে এই যান দেখেননি। কেউ বানিযে়ছেও সেকথা শুনেননি। এটা নিশ্চয় এ্যালিযে়নদেরই।
তাহলে তো সত্যি! অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক প্রতিভা তাদের। চোখ ফিরালেন ওদিক থেকে। যানে উঠে বসলে ট্যার্লুর ইঞ্জিন চালু হলো। যানকে নিদের্শ দেয়ার আগে ভাবলেন, কোথায় যাবেন। নিজের বাসায়? নাকি বিজ্ঞানী রুবল ডি রযে়র বাসায় যাবেন? দেখা করে আসবেন তার সাথে? সিদ্ধান্ত নিলেন, তার আগে কল করে দেখবেন, তিনি বাসায় আছেন কি না। নাকি অন্য কোথাও গেছেন। ফোন করলেই জানা যাবে। সঙ্গে সঙ্গে অন করলেন হলোগ্রাফিক। যানে তার সীটের সামনে থাকা মনিটর সচল হযে় উঠলো। পরপরই ভেসে উঠলো রুবল ডি রযে়র মুখ। তার মানে তার হলোগ্রাফিক অন ছিল? কোথাও নিশ্চয় কথা বলছিলেন তিনি। ‘মি. রুবল।’ একটু মুখ বাডি়যে় বললেন ফারুক।
রুবল কিছু একটা লিখছিলেন তখন। হলোগ্রাফিকে ওমর ফারুকের ডাক শুনে মনিটরে তাকালেন। ‘ও, মি. ফারুক? কেমন আছেন?’ উত্তরের আশা না করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই ভাল?’
উপর নিচে মাথা দোলালেন। ‘হুঁ! আপনি?’
হাতের কলম কাগজের উপর রেখে পুরোপুরি মনোযোগ দিলেন মনিটরে। ‘এই তো, বেশ আছি।’
‘আপনি তো বাসা আছেন দেখছি। আমি কি আসতে পারি?’

‘অবশ্যই, কেন নয়? প্লিজ ওযে়ল কাম। আমি আপাতত কোথাও বেরু”িছ না। তা এক্ষুণি আসবেন?’
‘গবেষণ কেন্দ্র থেকে রওয়ানা দেবো।’
‘ঠিক আছে।’ একটু নডে়চডে় বসলেন। ‘আপনার অপেক্ষায় থাকবো তাহলে। প্লিজ আসুন।’
‘তাহলে আসি। আসলে কথা হবে।’
‘ধন্যবাদ।’
রুবলের স্ক্রীন ছায়াহীন হযে় গেল। তার অর্থ লাইন কেটে দিযে়ছেন ফারুক।
ট্যার্লু তখন নীরব। ‘হ্যালো ট্যার্লু, মি. রুলবের বাসায় চলো।’ ট্যার্লুকে আগেই রুলবের বাসা চিনিযে় দেয়া হযে়ছে। সেটা অবশ্য একটা কোডের মাধ্যমে। এখন শুধু নাম বললেই হলো। ছোট যানের কম্পিউটার সেভাবে কাজ করবে অর্থাৎ গন্তব্যে নিযে় যাবে। এটা অবশ্য প্রযে়াগ হয়, গাণিতিক নির্দেশনায়। সেখানে একটা মানচিত্র আছে। এবং দূরত্ব ও দিক নির্দেশ করা আছে। স্যাটেলাইটের সহায়তায় ওযর়্াল্ড ম্যাপের মাধ্যমে এই কাজটি সারে কম্পিউটার। যানের ডাটাবেজে এটা আগে থেকেই সংযুক্ত করে রাখা হযে়ছে। চাইলে সিকিউরিটি সিস্টেম থেকেও সহায়তা নেয়া যায়। ট্যার্লু গন্তব্যের নির্দেশনা পেযে় সঙ্গে সঙ্গে সচল হযে় উঠলো। ততক্ষণে সে আকাশে উড়াল দিযে়ছে। চলছে ঘণ্টায় ত্রিশ হাজার মাইল গতিতে। একেবারেই শব্দহীন।

ট্যার্লু নামলো রুলবের রানওযে়তে। অদূরে দালানের নিচে পথের মুখে দাঁডি়যে় আছেন রুলব ডি রয়। তার মুখে হাসির ঝিলিক। চেযে় আছেন ট্যার্লুর দিকে। অভ্যর্থনা জানাবেন বিশ্ববিখ্যাত গ্রহবিজ্ঞানী, গ্রেট বাবর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযে়র গ্রহগবেষণা বিভাগের সাবেক স্বনামখ্যাত ডিন ড. ওমর ফারুককে। এখন ওসব রেখে যিনি শুধুই একজন গ্রহবিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বব্যাপি পরিচিত। এক নামে তার পরিচিতি। সম্ভবত গ্রহবিজ্ঞান নিযে় তার মতো এতো জনপ্রিয়তা আর কোন বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারেননি। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বাইরে বেরিযে় এসেছেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর রুবল ডি রয়। ট্যার্লু থেকে মুছকি হাসি দিযে় বেরিযে় এলেন ফারুক। ‘আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, মি. ফারুক।’ বললেন রুবল। বিনিমযে় আবার মুছকি হাসলেন। ‘আসুন।’ দু’জন ভেতরের দিকে হাঁটছেন। ‘অনেকদিন পর হঠাৎ, সত্যি একটু অবাক লাগছে!’
‘জানেনই তো, কাজ ছাড়া আমার বেড়ানো খুব একটা ভাল লাগে না। গ্রীষ্মকালিন ছুটি কয় বছর কাটিযে়ছিÑ জানেনই তো মনে হয়।’
শুনে হাসলেন রুবল। ‘তার মানে কোন অভিযানে এসেছেন?’
‘আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। ভেতরে যাই, সব বলবো।’
তারা এসময় রুলবের স্টাডি রুমে ঢুকছিলেন। এই রুমেই চলে রুলবের বৈজ্ঞানিক গবেষণা। পাশে আছে ল্যাবরেটরি। ‘সব বলবেন…’ কিছুটা চমকে উঠেছেন বলে মনে হলো। ‘মানে?’ বললেন রুবল। রুবল তার টেবিলের সামনে গিযে় একটা চেয়ার টেনে দিলেন ফারুকের জন্য। ‘বসুন, প্লিজ।’
বসলেন ফারুক। বসতে বসতে বললেন, ‘আমি স্পষ্ট একটা বিপদ সংক্ষেত পা”িছ। এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’
তখন রুবল তার চেয়ারে গিযে় বসেছেন। ‘বলেন কি?’ উত্তেজিত কণ্ঠ মনে হল। ‘কিছু একটা ঘটতে যা”েছ তাহলে কি? কোন দুর্ঘটনা নয় তো?’
‘এ মুহূর্তে নয়। তবে অবশেষে তাই ঘটবে।’
‘সৌরজগতে?’ প্রশ্ন করলেন রুবল। ‘না পৃথিবীতে?’
‘পৃথিবীতে।’
‘পৃথিবীতে! আমি কিছুই বোঝতে পারছি না। আরেকটু পরিষ্কার করে বলবেন?’
‘আমরা যাদের এ্যালিযে়ন বলি। ভীনগ্রহের প্রাণী। তাদের তিনজন এখন আমাদের পৃথিবীতে।’
‘সত্যি! সত্যি তারা কেউ এসেছেন?’
‘এখানে তারা অতিথির মর্যাদাও পেযে়ছেন!’
‘সত্যি তাহলে ভীনগ্রহের কেউ অবশেষে পৃথিবীতে পা রাখলেন? কি আশ্চর্য!’
রুবল ডি রযে়র বিষ্ময় দেখে ওমর ফারুক তার দিকে তাকালেন ভাল করে। একটু অবাক হলেন রুবলের উৎসাহ দেখে। ‘হেঁ, কিন্তু…’
‘আমরা খুব ভাগ্যবান মি. ফারুক। বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের স্যাটেলাইট যোগাযোগ তাহলে সঠিক ভাবে সম্পন্ন হযে়ছিল। রেডিও সিগনাল অকার্যকর ভাবে ফেরত আসেনি! যাক, শুনে ভাল লাগছে।’
ফারুক অবাক হ”েছন খুশীতে উন্মাদ রুলবকে দেখে। ‘আমার কিন্তু তা মনে হ”েছ না। খুশির কিছ্ ুদেখছি না আমি।’
মুহূর্তেই চেহারা থেকে উ”ছাস মিলিযে় গেলো রুবলের। ‘মানে!’
‘ওদের চরিত্র আমার জানা।’
‘কি বলছেন?’
‘ওরা ট্রনিকটন গ্রহ থেকে এসেছে। তবে…’
‘পৃথিবী থেকে ৬০,০০০ পারসেক দূরের সেই খ্যাতিমান গ্রহ ট্রনিকটন? তারা সেই গ্রহের নাগরিক?’
একটা ঢোক গিললেন ফারুক। ‘হেঁ। আর আপনার হয়তো অজানা সেই গ্রহে ঘটে যাওয়া অনুন্মোচিত রহস্য সম্পর্কে।’
‘রহস্য! কি রহস্য?’
‘ওরা প্রতারণা জানে।’
‘প্রতারণা!’
‘ভীষণ প্রতারক। ট্রনিকটনে তারা প্রথমে ঠিক এভাবে অতিথি হযে় এসেছিল।’
‘তারপর?’
‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অতিথিরা গ্রহের অতিথি পরায়ন প্রাণী সম্প্রদায়কে ভয়ঙ্কর ভাইরাস দিযে় ধ্বংস করেছিল। একেবারে নিশ্চিহ্ন হযে় গিযে়ছিল সেই গ্রহ। একসময় প্রাণহীন ট্রনিকটনে এসে তারা বসতি স্থাপন করে। সৌরজগতে আধিপত্য বিস্তারে তারা চরম কৌশলী। আর সেটাই চাইছে। এর অংশ হিসেবে তারা পৃথিবীতে এসেছে।’
‘আপনি সেই গ্রহে গিযে়ছিলেন, সেটা জানি। কিন্তু এসব জানেন, তা তো জানি না!’
‘আপনারা জানতে চাননি। কেন অভিযানে গিযে় ফিরে এলাম। কেউ তো তাতে আগ্রহ দেখাননি। সফল হয়নি কেন সেটাও তো কেউ শুনতে চাননি! চাইলে জানতে পারতেন। বাইরের একটা গ্রহ নিযে় আপনাদের আগ্রহ যে খুব ছিল তা কখনই মনে হয়নি।’
‘আপনার ধারণা ভীণগ্রহের সম্মানিত অতিথিরা সে রকম উদ্দেশ্য নিযে় পৃথিবীতে এসেছেন?’
‘এবং এটাই এতদিন সত্য প্রমাণিত হবে।’ একটু থামলেন ফারুক। দু’হাত বুকের মাঝখানে বেধে ফের বললেন, ‘আমি আমার কথায় একশ ভাগ নিশ্চিত মি. রুবল।’
‘এ ব্যাপারে তাদের কাছে কিছু জানতে চেযে়ছিলেন?’
‘দেখা করার ই”েছও হয়নি।’
‘মানে, দেখা করেননি?’
‘প্রযে়াজন হয়নি।’
‘আপনার ধারণা হয়তো একদিন মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে।’
‘মি, রুবল!’ অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘আমি চাই সেটাই হোক। কিন্তু আপনি জানেন, এমন ধারণা যেটা শেষে মিথ্যে প্রমাণিত হবে তা নিযে় আমি কখনই মাথা ঘামাই না।’
‘আপনার কথা সত্যি হলে আমি আপনার সঙ্গে থাকবো। আমাকে আপনি সাথে পাবেন।’
‘অন্তত কেউ না এলেও আমি আমার কাজ একাই করে যাব।’
‘মানে? কি কাজ?’
‘প্রযে়াজনে প্রতিবাদ করবো। না পারলে বাধা দেবো। আর তাও না পারলে আমি আমার কোন সহযোগিতা তাদের দেবো না। তখন যে আমার সাথে আমার যুক্তিতে থাকতে চাইবে, সে থাকবে।’
‘আপনি যে এককথার বিজ্ঞানী সেটা আমার অজানা নেই মি. ফারুক। আপনার নিজের মনের উপর এতো বিশ্বাস আর আস্তা সেজন্য ধন্যবাদ জানা”িছ।’
শুনে মুছকি হাসলেন ওমর ফারুক। জবাবে তার যেন আর কিছু বলারও ছিল না। ‘আ”ছা, আজ আসি।’ উঠে দাঁড়ালেন। ‘বিষয়টা ভাববেন। আমাদেরই কিছু না কিছু করতে হবে।’ বহির্বিশ্ব থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ রাখার বিষয়টি আমাদেরই ভাবতে হবে। আমাদের উপর অনেক দায় আছে। অনেক আস্তা তাদের। তাছাড়া প্রশ্নটা যেহেতু ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্যও জরুরী। তখন তো আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। তা না হলে আমাদের কেউ ক্ষমা করবে না।’
‘দুশ্চিন্তার ব্যাপার।’
হাটতে শুরু করলেন ওমর ফারুক। এক সাথে দু’জনেই। ‘আপনি বিষয়টি নিযে় ইতিবাচক একটা ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই আপনাকে জানালাম বিষয়টি। আমি একা কি আর করতে পারবো। ধন্যবাদ।’
ততক্ষণে তারা রানওযে়তে নেমে এসেছেন। ট্যার্লুর পাশে এসে দাঁড়ালেন ফারুক। ‘ভালো থাকবেন। জার্নিটা ভালো হোক।’ বিদায় জানালেন তাকে। ফারুক যানে ওঠলে রুবল একটু পিছিযে় এলেন। দুই সেকে- পর ট্যার্লু আকাশে উড়াল দিল। আকাশের দিকে তাকিযে় থাকলেন কিছুক্ষণ। ফারুকের যান চোখের সীমানার বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেদিকে তাকিযে় ছিলেন। আকাশে তখন আরও অনেক ছোট যান উডে় যেতে দেখা যা”েছ। রুবলের সেদিকে খেয়াল নেই। পাখির মতো যান এদিকে-ওদিকে যা”েছ। কিন্তু কোন সংঘর্ষ হ”েছ না। ট্রাফিকিং সিগনাল আগে বেশ দুর্বল ছিল। এখন স্যাটেলাইট টার্মিনালগুলোর সংস্কার করায় দুর্ঘটনার হার একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসছে। ফিরলেন তিনি বাসার ভেতরে।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *