নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

এক.
সলিমপুরে রফিজ মিয়া বেপারী মানুষ। আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। তবে তিনি কঞ্জুস প্রকৃতির লোক। অর্থ আয়ে যতটা আগ্রহী, অর্থব্যয়ে তিনি তদধিক অনাগ্রহী।
রফিজ মিয়ার মেয়ে সুন্দরি, স্বাস্থ্যবতী। তিনি মেয়ের বিবাহের পাকা কথা দিয়া আসিয়াছেন। তাঁহার স্ত্রী জোহরা খাতুন ইহাতে সম্মত ছিলেন না। যেহেতু এ-বিবাহ পাকা কথা দিবার পূর্বে তিনি মেয়ের মতামত যাচাই করেন নাই। তা ছাড়া ছেলেটি দেখিতেও কুৎসিত। তিনি আরও লক্ষ্য করিয়াছেন যে, বিবাহের কথা শুনিয়া মেয়ে খুশি না হইয়া বরং মনমরা হইয়া পড়িয়াছে। বয়স্কা মেয়ে বিবাহের কথায় এরূপ বিষন্ন হয় না। সুতরাং তিনি স্বামীকে বিবাহ না দিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। রফিজ মিয়া একগুঁয়ে লোক। তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বলেন, মেয়ের বিবাহ করানো আমার দায়িত্ব। আমার যেখানে খুশি, বিবাহ সেখানেই হবে। মেয়েদের আবার মতামত কী? আমি যা ভালো মনে করি, তাই মেনে নিতে হবে।
কাজীর গাঁয়ের মৃত সম্সের আলী মিয়ার পুত্র সফিউর রহমান। পিতার একমাত্র পুত্র। জমি-জমা যাহা আছে, যথেষ্টই বলিতে হইবে। পিতা জীবিত না থাকায় সে নিজেই নিজের অভিভাবক। সংসারের দেখা-শুনা তাহাকেই করিতে হয়। তাহার মাতা এখন জীবিত। বয়স্কা একভগ্নি আছে। তাহার বিবাহ দিতে হইবে। সেটাও তাহার কর্তব্য। এইসব ঝামেলার মধ্যে মন দিয়া পড়াশুনা করা তাহার পক্ষে সম্ভব হইল না। তাই একবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল করিয়া, পড়া ছাড়িয়া দিল। তদুপরি ছাত্র হিসেবেও সে মেধাবী ছিলো না। তবে চেষ্টা করিলে হয়ত পাস করিতে পারিত। কিন্তু সেই অতি চেষ্টা করিবার মতো সময় এবং মন তাহার নাই। ভবিষ্যতে খাওয়া-পরা নিয়া চিন্তা করিতে হইবে না। পৈত্রিক সম্পত্তি যাহা আছে, তাহাতে ভালোভাবেই চলিয়া যাইবে। উন্নতি করিতে পারিলেই চলিবে। বেশি বিদ্যায় তাহার আবশ্যক কী?
সফিউর রহমান সাদা-সিদা ধরণের। তাহার কোনো বিলাসিতা নাই। পোশাক-পরিচ্ছদের পারিপাট্য বা জৌলুস নাই। বর্তমান যুগের ছেলেদের মতো আধুনিকতাও তাহার নাই। এ যুগের ছেলে হইয়াও সে যেন প্রাচীনপন্থী। তাহার কথা-বার্তায়ও কোনো রস-কস নাই। মোট কথা, তাহার প্রতি এ যুগের কোনো আধুনিকা-শিক্ষিতা মেয়ের মন আকৃষ্ট হইবে, এমন রূপ-গুণ তাহার নাই।
রফিজ মিয়া সফিউর রহমানকে খুব পছন্দ করিলেন। সফির সংসারে কোনো ঝামেলা নাই। মা-বুড়ী, মরিতে কতক্ষণ, বোনটি বয়স্কা, বিবাহ দিলেই ল্যাঠা চুকিয়ে যায়। তারপর ঘরের বউ হইবে সংসারের হর্তাকর্তা। বাইরে সফিই সব। কাজেই, এমন নির্ঝামেলার অবস্থাপন্ন ঘর পাওয়া ভাগ্যের কথা।
অপরদিকে সফি ছেলেটি বেশ সভ্য-শান্ত। কোনোরূপ বাবুগিরি নাই। সম্ভবত : হিসাবি। ভবিষ্যৎ মঙ্গল। নিশ্চয় টাকা-পয়সা জমাইতে পারিবে। রফিজ মিয়ার ব্যবসায়ি মন তাহার প্রতি এই সকল কারণেই বেশি ঝুকিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেকে বলিল-তোমার মেয়ে যে রকম ইংরাজের বাচ্চার মতোন সুন্দরী, তাতে পাত্রটি মানন-সই হয়নি।
রফিজ মিয়া বলিলেন-তাতে কী? ছেলেদের রূপে কী দরকার? তাদের স্বাস্থ্য আর অর্থ থাকলেই হলো।
কেহ কেহ বলিলেন-স্বাস্থ্য আর অর্থই সব নয়। সকলদিক সামঞ্জস্য থাকা চাই, বুঝলে?
রফিজ মিয়া বেপারী মানুষ। সকল দিক বুঝিতে চাহেন না। তিনি লাভের দিকটাই ভালো বুঝেন। সফি ছেলেটির স্বাস্থ্য আছে, অর্থ আছে, বিদ্যাও কিছু আছে। আর, কী চাই? তাহাকে কোনো যৌতুক দিতে হইবে না। চাহিদা কিছুই নাই। একমাত্র তাঁহার মেয়ের রূপ মুখ মারিয়া দিয়াছে। আর কিছু চাহিবার যো নাই। খুব বাঁচা গেল। এক প্রকার বিনা খরচে মেয়ে পার করার ব্যবস্থা হইল। তিনি অত্যন্ত খুশি হইলেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা চোখটাটাইয়া মরুক। তাহাতে তাঁহার কী ক্ষতি হইবে? মেয়ে সুখে থাকিলেই হইল।
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-বান্ধব, সংসারের আর সবাই প্রতিবাদ করিলেও, রফিজ মিয়া ঘাবড়াইলেন না। এমনকি মেয়ের মতামত জানিবার আবশ্যকতাও বোধ করিলেন না। তিনি সানন্দে আত্মীয়-কুটুমকে দাওয়াত দিতে লাগিলেন এবং বিবাহ-বিষয়ক অন্যান্য কার্যে মনোনিবেশ করিলেন।
রফিজ মিয়ার মেয়ে মাসুদা। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়িয়াছে। লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক থাকিলেও পিতার ইচ্ছাক্রমে পড়া ছাড়িতে হইয়াছে। প্রায় দুই বৎসর হইলে সে পড়া ছাড়িয়াছে। তবুও গৃহে কিছু-কিছু লেখাপড়ার চর্চা করে।
গেঁয়ো গৃহস্থ ঘরের মেয়ে হইলেও, মাসুদা আধুনিকা মেয়ে। পেশাকে-পরিচ্ছদে, চলনে-বলনে সবকিছুতেই একটা সুরূচির ছাপ সুস্পষ্ট। সে যেমন অনিন্দ সুন্দরী-জুঁইফুলের সুভ্রতা মাখানো শরীর, মনটাও তেমনই পরিচ্ছন্ন। সবদিকেই একটা পারিপাট্য এবং শালিনতা আছে।
মাসুদার বয়স আঠারোর কম নয়। গাঁয়ের হিসেবে তাহার বিবাহের বয়স অনেক পূর্বেই উৎরাইয়া গিয়াছে। কেন না, গাঁয়ের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকদের ধারণা-১২/১৩ বৎসর বয়স হইলে, মেয়েদিগকে ঘরে রাখা সমীচীন নয়। বিবাহ দিয়া স্বামীগৃহে পাঠান উচিৎ। যদি কেহ, যে কারণেই হউক, ইহার ব্যতিক্রম করে তবে নানা কথা শুনিতে হয়।
যাক সে-কথা। এখন অন্য প্রসঙ্গ আলোচনা করিব। বিবাহের আর একদিন বাকি। মাসুদা নির্জনে বসিয়া একাকিনী ভাবিতেছিল। সময় অপরাহ্ন। প্রতিবেশিনী বান্ধবী আয়েষা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। সে তাহাকে বলিল-খুব যে ভাবতে শুরু ক’রে দিলে! বিয়ের আগেই এতো-পরে কতদূর হবে?

একটু হেসে জবাব দিলো মাসুদা-এ-থেকেই আন্দাজ করে নে, তবেই বুঝতে পারবি!
: নিলাম। বুঝলামও।
: আয় কাছে এসে বস্।
: তোর কাছেও যে বসতে নেইরে!… সকৌতুক উক্তি।
: কেনো রে?
: তোর যে বর আসবে।
: তা’তে কী? হিংসে হচ্ছে? তবে আমার বর তহইনে-না?
: মুখে সবাই অম্নি বলতে পারে। কিন্তু-
: কিন্তু কী?
: কিন্তু দেবার বেলায় কাঁচকলা!
উভয়ে কৌতুকপূর্ণ চাঁপা হাসি হাসিল কিছুক্ষণ। তারপর মাসুদা স্মিতকণ্ঠে বলিল: বন্ধুকে কিছুই অদেয় নেই, জানিস্?
: জানি। কিন্তু ওটি বাদে।… মৃদুহাস্যে জবাব দিলো।
: তুইতো তলে-তলে বেশ পেকে উঠেছিস্! আয়, কাছে এসে বস।
আয়েষা বসিল। তারপর মাসুদাকে বলিল-এখন দু’টো প্রাণের কথা শুনিয়ে দে-না। এর পরতো আরও লোক পাবি কথা বলবার।
: অইসব ইংগিত দিয়ে কথা বল্বিনে। ভালো লাগে না, বুঝলি?… বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর।
: ওঃ! …। বিশেষ ভংগীতে কথাটি উচ্চারণ করিল।
: মানে?
: মানে, দেখাতে চাও যে, আমি খুুুউব লাজুক মেয়ে-একেবারে লজ্জ্বাবতী লতাটি! বিয়ের হাম, স্বামী সম্পর্কে আলাপ শুনতেই আমি শরমে একেবারেই জড়োসড়ো। অতএব, ভালো লাগে না। নইলে-
: নইলে কী?
: নইলে কি আর তা’তে কোনো মেয়ের অসাধ?… … …মৃদু-মৃদু হাসিতে লাগিল।
: কথায় বলে-চোরের মনে বোচ্কা!… … … সেকৌতুক উক্তি।
: চোর না হলে চোর ধরা যায় না।
: খুব ধরে দিস্ যা হোক!
: তাহলে বলতে চাস্?, পাত্রটিকে তোর পছন্দ হয়নি?
: আমার আবার পছন্দ-অপছন্দ! শোনে কে?
: কেনো? তোর বাপতো কিছুটা লেখা-পড়া জানা লোক। তাঁর তো অবুঝের মতো কাজ করা সাজে না। তোর মত্ নেননি? আশ্চর্য্য! আমি কিন্তু এটা ভাবতেই পারিনি। শিক্ষিতা মেয়ের বিয়ে হবে তার অমতে? এটা নেহাৎ বর্বরতা।
: যা-ই বলিস্ না কেনো, আমাদের সমাজে তা’ এখনো সুপ্রচলিত। আর শিক্ষিত বলছিস্? গাঁয়ের লোক শিক্ষিত হলেও, প্রগতিশীল, উদার, আধুনিক এবং সুসভ্য হ’তে এখনো অনেক দেরী। দেখতেই তো পেরেছিস্-সপ্তম শ্রেণি যেই উৎরে গেলাম, অম্নি বাবা পড়ালেখা বন্ধ করে দিলেন। মেয়ে মেট্রিক, আই-এ, পাস করলে নাকি বিয়ে দেয়া মুশকিল।
: মানে?
: মানে বুঝলিনে? লেখাপড়া কম জানা মেয়ের যার-তার সংগে বিয়ে হতে পারে। বেশি লেখা-পড়া জানা মেয়ের জন্য পাস করা ছেলের দরকার।
: তাতে লোকসান?
: মেয়েদের লোকসান না হোক, তাদের অভিভাবকদের মস্তো লোকসান আছে।
: কী লোকসান আছে?
: ধরো, আজকালকার পাস করা ছেলের দাবি বড়ো বেশি। কষ্ট করে পড়ে পাস করল, কতো টাকা খরচ হলো। বিয়ের সময়ে দামটাতো সূদাসলে আদায় হওয়া চাই! তাই-ঘড়ি-কলম-সাইকেল এসব না পেলে তাদের চলবে কেনো? এখন বুঝে দ্যাখ, অভিভাবকদের কোন্খানে গিয়ে টান পড়ে! আর, অল্প শিক্ষিত ছেলেরা যদি তাদের তুলনায় একটু বেশি লেখাপড়া জানা সুন্দরী মেয়ে পায়, তবে কোনো কোন্দল নেই। কিচ্ছুই আব্দার থাকে না।
: আজকালকার শিক্ষিত ছেলেগুলো বেজায় স্বার্থপর। বোকাও বলতে পারো। আরে বাপু, টাকাটাই কি সব? যৌতুকাদি কি না পেলেই নয়?
: ওদের যে তা-ই দরকার। বউ পাওয়া যতো সহজ, টাকা এবং যৌতুক পাওয়া ততো সহজ নয়। কাজেই, দুর্লভের প্রতিই আকর্ষণ বেশি থাকবার কথা।
: তবে আর বিয়ে করা কেনো? টাকা আর যৌতুক পেলেই তো হলো।
: আজকালকার শিক্ষিত ছেলেগুলো বেজায় স্বার্থপর। বোকাও বলতে পারো। আরে বাপু, টাকাটাই কি সব? যৌতুকাদি কি না পেলেই নয়?
: বিয়ে না করলে টাকা আর যৌতুক দ্যায় কে? কাজেই বিয়ে করতে হয়।
: তাহলে বিয়েটা গৌণ, কী বলো?
: তা-ই তো মনে হয়। নইলে টাকা এবং যৌতুকাদির জন্যে দর কষাকষি করবে কেনো?
: তা’ওতো বটে! অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়-ছেলের মেয়ে খুব মনের মতো হয়েছে। কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। ছেলের দাবী নগদ এক লাখ, তার পরেও ঘড়ি-সাইকেল দিতে হবে। মেয়ের বাপ অপারগ। অতএব, মেয়ের অযোগ্যতা প্রমাণিত হলো।
: মেয়ের বিয়েতে সেই তো মস্তো সমস্যা। এটা যে শুধু শিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এমন নয়। অশিক্ষিত সমাজেও যৌতুকাদির ব্যাপারে নানা করচা হয় এবং বিয়ের আসর থেকেও বরপক্ষ সরে পড়ে।
: আর, মেয়ের অভিভাবকেরাও যতো সস্তায় মেয়ে পার করা যায়, সেই চেষ্টাই করে। পরত: পক্ষেও অধিক খরচ করে ছেলে যোগাড় করতে চায় না। এটাও ঘোর অবিচার। মেয়েরা চিরকাল বাপের সম্পত্তি ভোগ করে না। আইনে থাকলেও পায় না। পাওয়াটা সহজও নয়। অথচ আসর থেকেও বরপক্ষ সরে পড়ে।
অথচ-
: হ্যাঁ, অথচ বিয়ের সময়ে কিছু বেশি খরচ করে উপযুক্ত পাত্রে মেয়েকে পাত্রস্থ করবার প্রতি খুব কম লোকেরই অভিপ্রায় থাকে।
: কথায়-কথায় অনেক দূরে সরে গেছি। থাক ও-সব। এখন, পাত্রটি পছন্দ হলো কি না, তাই বল্।
: পাত্রটি আমি না দেখেছি এমন নয়। কালো-সেটা ধরি না। তবে হাবা-গোবা ভাব, ছিরি-চেহারা তথৈবচ। যাকে ইংরেজিতে বলে ব্যাক্ওয়ার্ড-তাই মনে হলো তাকে। স্বাস্থ্যটা অবশ্যি বলতে হয় নাদুস-নুদুস, তবে ‘ছুরতে শোভতে মূর্খ’ গোছেরই হবে হয়তো। কোনো জানি না, আমার ভালো লাগে নি।
: তবে আপত্তি করিস্নে কেনো?
: আপত্তি শুনবে কে? আমার বাবা একরোখা মানুষ। তাঁর কাছে অন্যের মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। এ-নিয়ে মায়ের সংগে তাঁর একচোট ঝগড়াও হয়ে গেছে। তিনি স্থির করছেন, বিয়ে হবে, নড়চড় হবার উপায় নেই, বুঝলে?
: তবে যে শরীয়তের বিধান-মেয়ের সম্মতি নিতে হবে, তার কী হবে?
: সেজন্যে ভাবনা কী? মোল্লামিয়া যখন বলবেন-‘মেয়ের সম্মতি নিয়ে এসো’ তখন জিজ্ঞেস করা হবে-অমুকের ছেলে তমুকের সংগে তোমার বিবাহ। এতে তোমার মত আছে তো?’ তখন আর মত-অমত জানিয়ে ফল কী/ স্বভাবত: মুখফুটে কিছু বলতেও পারে না মেয়েরা। অতএব, ধরে নেয়া হয়-‘মৌনং সম্মতি লক্ষণ’। এই হলো আমাদের সমাজের প্রথা।
: এমনি খেয়ালের বশেই অভিভাবকেরা মেয়েদের সমূহ সর্বনাশ করে বসেন। এটা অত্যন্ত অন্যায়-অবিচার। এও কি চিরকাল নীরবে সইতে হবে?
মাসুদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বেদনাভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলিল-তাছাড়া উপায় কী, বল? মেয়েদের জনমটাই যে পুরুষদের খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করার জন্যে। পুরুষের যথোচ্ছার চিরকালই আমাদের সইতে হবে। আমাদের হাত-পা যে বাঁধা! যুগ-যুগ ধরে তাই আমাদের উপরে জুলুম চলছে, চলবেও চিরকাল। গুরুপাক হজম করতেই হবে যে, আমাদের পাকস্থলীর বিদ্রোহী হওয়া সাজে না! অদৃষ্টের উপরে নির্ভর কর।
: এই সভ্য যুগে, স্বাধীনতার যুগে আমরাই শুধু অদৃষ্টের হাতে মার খাবো? ‘তদবীরে তকদীর ফেরে’ নাকি, সে-চেষ্টাও আমরা করতে পারব না? অপরের উপরে ছেড়ে দিতে হবে আমাদের ভাগ্যচক্র? আমরা শুধু ক্রীড়নক হয়েই থাকব?
: উপায় নেই তাছাড়া। সমাজ-ব্যবস্থা আমাদের তেমনিই। আমরা যে অধীন্য, পরাশ্রিতা, পরমুখাপেক্ষিনী। কারো কাঁধের বোঝা সে আস্তে নামাক কি ধপাস্ করে আছড়ে ফেলুক, তার কোনো আপত্তি সেখানে ঠিকবে না!
আয়েষা উত্তেজিতা হইয়া তীক্ষèকণ্ঠে বলিতে লাগিল-না-না, এটা চিরকাল চলতে পারে না। চলা উচিৎ নয়। চলতে দেয়া হবে না। আমরা কেনো মুখ বুঝে সইবো সব অনাচার-অবিচার? অধিকার কেউ স্বেচ্ছায় দেয় না-অর্জন করে নিতে হয়। প্রাণপণ চেষ্টায় এর গতি রোধ করতেই হবে।
: চেষ্টা করে দ্যাখ। সকল মেয়েকে যদি অহেতুক লজ্জাকে বর্জন করাতে পারিস, মনে অদম্য শক্তির সঞ্চার করাতে পারিস, তবে হয়তো প্রতিকার হতে পারে।
: হ্যাঁ, সবাইকে লজ্জা পরিত্যাগ করতে হবে। কিসের লজ্জা? যাকে চাই না, ভালোবাসি না-তাকে নিয়ে ঘর করতে হবে লজ্জার খাতিরে? অভিভাবকের ইচ্ছায় অপছন্দনীয় স্বামীকে বরণ করে নিয়ে সারা জনম জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে কেনো? না, তা চলবে না। প্রতিবাদ করা উচিৎ। প্রত্যেকটি মেয়েরই উচিৎ মনটাকে শক্ত করা, সাহস সঞ্চয় করা। বিয়ে দিতে হয়, আমি যাকে চাই, তার সাথে দাও, নচেৎ কলসি-দড়ীর অভাব কী? এমনি জোর-প্রতিবাদ তুলে একটা বিপ্লবের ঝড় আনবার প্রয়োজন। তবেই অভিবাবকদের এই খামখেয়ালীপনা দূর হবে। কী বলিস?
: হ্যাঁ, সবাই যদি এমনি শক্তভাবে প্রতিবাদ করে, তবে অভিভাবকেরা আর অবিবেচনার কাজ করতে সাহসী হবে না। তবেই মেয়েদের আশা-সাধ-স্বপ্ন অনেকাংশে সফলতা লাভ করবে।
: সেই শুভ দিন কবে আসবে বলতে পারিস?
করুণ ভাবে হাসিয়া মাসুদা বলিল-আসবে কবে? যেদিন আমরা আর থাকব না, সেই দিন-সেই দিনই নতুন যুগের সূচনা হবে!
আয়ষো স্মিত কণ্ঠে বলিল-তোমার-আমার শুভ দিন আর হলোই না তাহলে!
: তাতে কী? আমাদের সুখ না-ইবা হলো। যারা ভবিষ্যতের অভিযাত্রিনী, তারা যদি সুখি হতে পারে, মরেও আমরা শান্তি পাবো!
আয়েষা প্রসংগান্তরে চলিয়া গেল। বলিল-আচ্ছা মাসুদা, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব-সত্যি উত্তর দিবি তো? মাসুদা মৃদু হাসিয়া বলিল-কথাটা আগে বলবি, না উত্তরটা আগে চাস?
আয়েষা স্মিতকণ্ঠে উত্তর করিল-উত্তরটা আগে পেলে ভালো হতো। কিন্তু তাও যে অসম্ভব। আমার কাছে লুকোসনে, বল-কাউকে ভালোবাসিস নাকি?
মাসুদা ব্যথিতভাবে জবাব দিলো-কালই তো বিয়ে। আজ আর ও-কথা জানতে চাসনে!
আয়েষা কী বুঝিল, ভাবিল সে-ই জানে। বলিল-তবে থাক। জানতে চাইনে! কিন্তু একটা কথা-যাতে ভালো লাগেনি, তার সংগে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে সুখি হতে পারবি?
মাসুদা অসহায়ভাবে সকরুণকণ্ঠে কহিল-চেষ্টা করব খাপ খাওয়াতে, সুখি হতে। তাছাড়া কী উপায় আছে বল?… … … মাসুদার কণ্ঠে ভাষা যোগাইল না। বান্ধবীর মর্মবেদনা তাহাকেও মর্মান্তিক পীড়া দিতে লাগিল।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *