নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শ্রেণিকক্ষেও বিশেষ সুবিধা নাই। যতক্ষণ শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত থাকেন, ততক্ষণ মেয়েরা নিরাপদ। পরক্ষণেই আর তাহাদের নিরাপত্তা রক্ষিত হয় না। এখানে ছেলেরা বেপরোয়া। তাহাদের আধিপত্য বিস্তৃত। মেয়েদের যেন অনধিকার প্রবেশের অপরাধ হইয়াছে। তাই ছেলেদের অশ্লীল উক্তি নীরবে হজম করিতে হয়। আর, পাল্টা জবাব দিবার মতো বুকের পাটা আমাদের মেয়েদের আছেই বা কোথায়? তাহারা লজ্জা-ভয়ে জড়ো-সড়ো হইয়া থাকিতে পারিলেই বাঁচিয়া যায়। কিন্তু ইহাতে কী ক্ষতি? ক্ষতি আছে বৈকি। ইহাতে মেয়েদের অভিভাবকগণের অবমাননা হয়। আর, তাহাদের মেয়েদিগকে ছেলে-ছোকরারা যা-তা বলিবে, ফলে তাঁহাদের এবং তাঁহাদের মেয়েদের নামে গ্রামময় পল্লবিত হইয়া অপবাদ রটিবে, ইহা তাঁহারা সহ্য করিবেন কেন? ফলত:, মেয়ে পড়াইতে কেহ বড়-একটা সাহসী হন না। এতে শ্রীশিক্ষাই ব্যাহত হয়। অবশ্য ইসলাম নর-নারীকে শিক্ষা লাভের অধিকার দিয়াছে।
শুধু যে মিথ্যা অপবাদই রটে তাহাই নহে। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর, লজ্জাকর ব্যাপারও ঘটিয়া যায়, যাহাতে মেয়েদের চরিত্রে কলংক অংকিত হইয়া থাকে। এইসব দুর্ঘটনার ফলে ছেলেদের ক্ষতি কী? তাহাদের কোনো কিছু আটকাইয়া থাকিবে না সে জন্য। কিন্তু কলংকিনী নারীকে কেহ সমাজে ঠাঁই দিতে অসংকোচ রাজি হইবে না। মিথ্যা অপবাদ হইলেও নারী বরাবর সকলের ঘৃণার পাত্রীই থাকিয়া যাইবে। সত্য হইলেও ছেলেদের বয়সের দোষ অনুকল্পালাভে সমর্থ। সেদিকে কেহ দৃকপাত করিবে না। এটাই বর্তমান সমাজে চলিতেছে।
সকল কিছু অপরাধের জন্য মেয়েরাই নিমিত্তের ভাগী। পুরুষের প্ররোচনায় এবং বলপ্রয়োগের ফলে নারী যদি অপরাধমূলক কার্য্যে জড়াইয়া পড়িতে বাধ্য হয়, সেজন্যও সে-ই দায়ী। সব পাপ-তাপ, অনাচারের হোতা সে একাই। কবি তবু বলিয়াছেন-
‘বিশ্বে যা-কিছু এলো পাপ-তাপ
বেদনা, অশ্র“বারি,
অর্ধেক তার-আনিয়াছে নর,
অর্ধেক তার নারী।’
যাহোক, তবু আধাভাগের ব্যবস্থা হইল, যদিও সমাজ তাহা স্বীকার করিতে বাধ্য নয়। কেতার কথা, কবির কথা কে মানিবে?
সমাজ চিরকালই নারীকে দুষিয়া আসিতেছে। হিন্দুদের শাস্ত্র বলে, ‘নারী নরকের দ্বার’। তাই ‘অবিদ্যারূপিনী নারী’ বলিয়া তাহার নিন্দাবাদ করিতে ছাড়ে নাই। অমংগল-আশংকায় এককালে আরবিয়রা মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিতো, তাহা আমরা জানি। যতো অনর্থপাত তাহাদের জন্যই পৃথিবীতে সংঘটিত হয়। কিন্তু ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য হেলেন কতোটুকু দায়ি? কারবালার মর্মান্তিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পশ্চাতে নারীর কী হস্তক্ষেপ ছিলো? সীতার জন্য রাবণের সবংশে নিধন হইলেও সেজন্য সীতার কী অপরাধ?
তবু, ‘যতো দোষ নন্দ ঘোষের’। ইস্কুলের জীবনে, যাহাই কিছু অশোভন ব্যাপার ঘটুক। সেজন্য মেয়েরা দায়ি। বিবাহিতা জীবনে স্বামীর সংসারের সকল প্রকার ক্ষয়-ক্ষতির জন্য তাহাকে বলা হয় অলক্ষ্মী। শ্বশুর নদীতে গেলে তেমন আর ইলিশের খোট্ পান না, কেননা, বউয়ের কপাল মন্দ। গোয়ালের গাইটা মরিল, সেটা বউয়ের দোষ। খন্দ-পাতি কম হইল, সংসারে ব্যারাম-পীড়া ঢুকিল, তাহা বউয়ের অলক্ষুণে বরাতের জন্য। মোটকথা, সংসারের সকল প্রকার দৈব-দুর্বিপাক, বিপদাপদ, অসুবিধার জন্য নারীই দায়ি। তাহার উপরে দোষ চাপাইতে পারিলে, কেহ আর অদৃষ্টকে দোষারোপ করে না। কবি বলিয়াছেন-
‘এ বিশ্বে যতো ফুটিয়াছে ফুল,
ফলিয়াছে যতো ফল
নারী দিলো তাহে রূপ-রস-মধু
গন্ধ সুনির্মল।

জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী,
শস্য-লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে
রূপে-রূপে সঞ্জারি।’
কিন্তু সমাজ তাহা স্বীকার করিবে না। কবি-কল্পনার কি বাস্তব-স্বীকৃতি আছে? উহা শুধু ভাবাবেগ বলিয়াই প্রতীয়মাণ হয়। কবি আরও বলিয়াছেন-
‘শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো
পুরুষ চালালো হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া
করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী রহে জল,
সেই জল মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফরিয়া উঠিল
সোনালি ধানের শীর্ষে।’
আমরা পুরুষ। ওই অবমাননাজনক, আপত্তিকর কথা আমরা মানিয়া নিতে পারিব না। নারী জাতিকে সমাজ-সংসার একটা বড়ো স্থানে বসাইতে অর্থাৎ তাহাকে কর্ম-গরীমায় সমান মনে করিতে আমরা নারাজ। আর যে দেখুক, আমরা নারীকে সমান চক্ষে দেখিতে পারিব না। যে দেখে, কবির ভাষায় বলি-
ক্লীব সে, তাই সে নারী ও পুরুষে
সমান মিশিয়া রহে।’
জীবনের সকল ক্ষেত্রেই দেখি নারী অসহায়-অরক্ষণীয়া। তাহাকে নিয়াই যতো দূর্ভাবনা। তাহাদের শিক্ষা-দীক্ষা লাভের ভালো ব্যবস্থা নাই। সে জন্য আমাদের কর্মতৎপরতাও নাই। শুধু অযোগ্য মনে করিয়া তাহাকে গৃহাভ্যন্তরে রাখিবার প্রতিই যতœবান হই। তাইতো গলগ্রহ হইয়াই থাকে।
সহশিক্ষা কাহারও জন্য সুফল প্রসু নয়। উহাতে মেয়েদেরও নানা অসুবিধা আছে, ছেলেদের শিক্ষা ও চরিত্রগঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই সংগত কারণেই গাঁয়ে মেয়েদের উচ্চশিক্ষাকে সুনজরে দেখা হয় না। আর, সেকারণেই কেহ শিক্ষালাভ করিতে চাহিলে নানাজনে নানা কথার ঝড় তোলে। অবশ্য সবক্ষেত্রেই যে একটা কিছু হেতু থাকেই, তাহা নহে। অহেতুক গুঞ্জরণ করা গেঁয়ো লোকদের স্বভাবজাত।
এই সকল অসুবিধার ভিতর দিয়াও গাঁয়ের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভের চেষ্টা পাইতেছে। কোনো কোনো উদার মনা অভিভাবক উড়ো কথায় কান না দিয়া মেয়েদিগকে ইস্কুলে পড়াইতেছেন। অবশ্য কেহবা পাত্র জুটিতেছেনা বলিয়া দায়ে ঠেকিয়া উদারতা দেখাইতেছেন না, এমনও নয়।
আয়েষার পড়া চলিতেছিল বিশেষত: শেষোক্ত কারণেই। তার পিতা এখন জীবিত নাই। তিনি শিক্ষিত লোকও ছিলেন না। ছিলেন সাধারণ চাষা-ভূষা মানুষ। আমাদের পূর্ব পরিচিত নূরু তাঁহার একমাত্র পুত্রসন্তান। নূরু নবমশ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়া বিবাহ করিল। আয়েষার পড়িবার অদম্য বাসনা এবং নূরুর উৎসাহ, তদুপরি উপযুক্ত পাত্রের অভাব, এই তিন কারণ মিশিয়া তাহাকে এতোদূর শিক্ষা লাভের সুযোগ করিয়া দিলো। আর, বর্তমানে নূরুই তাহার অভিভাবক বিধায় পড়া-শুনা চলিতেছে। কিন্তু সমাজ সুনজরে দেখে না। বক্র উক্তি এবং বক্রদৃষ্টি অহরহ সইতে হইতেছে। একদিকে যেমন পথে-ঘাটে, ইস্কুলে ছেলেদের উপদ্রব, অপরপক্ষে সমাজের তরফ হইতে
‘শাসন ছুটে আসে ঝটিকা তুলি।’
তবুও বেপরোয়াভাবে তাহার অগ্রগতি অব্যাহত রাখিয়াছে। পাছে লোকে কিছু বলে নাকি, তাহার পরোয়া করিলে কোনো কাজ করা সম্ভবপর নয়। আয়েষার সে-পরোয়া নাই। সে জানে-
চীনের প্রাচীর লংঘিতে হলে
চাহি অপূর্ব মনের বল্,
শক্তি তোমার আসবেনা কাজে
ফেলো যদি বয়ে অশ্র“জল।
অভয়-মন্ত্রে দীক্ষা লইয়া
সাধিতে থাকিয়ো আপন কাজ,
তাহলে জীবনে ব্যর্থ হবে না
পুরিবে আশা এ বিশ্ব-মাঝে।
একদিন আয়েষা ইস্কুলে যাইতেছিল। বেলা একটু বেশি হইয়া পড়িয়াছিল। প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীরা পূর্বেই ইস্কুলে পৌঁছিয়াছিল। তাই পথে কোনো সাথী পাইল না, সে একা-একা চলিতেছিল। এমন সময় সহসা পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া চাহিয়া দেখিল পূর্বোল্লেখিত রহিম আসিতেছে। প্রসংগত: উল্লেখ্য যে, রহিম অনেকদিন যাবত ইস্কুল কামাই দিয়া সংপ্রতি পুনঃ যাওয়া শুরু করিয়াছে। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বয়স ২০/২১ বৎসর। স্বাস্থ্য লিকলিকে, রুগ্ন। স্বভাবে উচ্ছৃংখল।
আয়েষা রহিমকে দেখিয়া সহাস্যে কহিল-তুমি আবার এতোদিন পরে ইস্কুলে যাচ্ছো, ব্যাপারী কী?
রহিম কৌতুকপূর্ণ উক্তিতে নাটকীয় ভংগীতে বলিল-মুর্শীদাবাদের মায়া কাটাতে পালুমনা গোলাম হোসেন, তাই আবার ফিরে এসেছি তার বুকে!
আয়েষা ওর কৌতুকোক্তিতে হাস্যসংবরণ করিতে পারিল না। সহাস্যে কহিল-যাক ইস্কুলের প্রতি এতোটা আকর্ষণ যখন তোমার হয়েছে, এবার যদি পরীক্ষার সাগর পাড়ী দেয়া ভাগ্যে জোটে!
রহিম বেহায়ার মতো দন্তবিকাশ করিয়া কহিল-সেজন্যেও তোদের গোদা পায়ে নমস্কার। অংক, ভূগোল, ব্যাকরণের মতো নীরস কেতাবের মায়ায় কি ইস্কুলে আসি নাকি? আমি তোদেরই আকর্ষণে। তাই বলি-
কী যাদু জানে ও আঁখি দুটি তব
হৃদয়ে শায়ক হানে,
আমি যে পারি না থির থাকিবারে
নয়ন ধনুর বানে।
আয়েষা রাগ করিল না। রাগ করিয়া লাভ নাই। সহজভাবে হাসিয়া কহিল-ভালোইতো। একভাবে তোমার পড়া হলেই হলো।
রহিম খুশী হইয়া কহিল-তোরা থাকিস্ বলেই তো ইস্কুলটা ছেলেদের কাছে নেহাৎ হাজতখানা নয়। কিছুটা রোমান্সের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
আয়েষা রগড় করিয়া কহিল-কিছু কেনো, যথেষ্টই বলতে পারো। যাকগে। বড্ডো অসময় হয়ে গেলো। একটু জোরে হাঁটি।… … গতি দ্রুত করিল।
রহিম কহিল-কিন্তু আসল কথাটা যে এখনো বলা হয়নি। শোন দাঁড়া-না একটু।
আয়েষা গতি মন্থর করিয়া কহিল-বলো।
: তোকে আমি মানে এই ইয়ে আরকি!… … … নিলর্জ্জেরও একটু সংকোচ হইতেছিল। তাই আমতা আমতা করিতে লাগিল।
আয়েষার হাসি পাইল তাহার হাব-ভাবে। হাসিয়া কহিল-চলি। তুমি খুব দুর্বল পুরুষ। কিচ্ছু বলতে পারবে না।
রহিম কহিল-আমি যা-ই হই না কেনো, তুইতো মেয়ে! আকার ইংগিত কিছু কি বুঝিস না। সব কথা কি খুলে বলতে হয়?
আয়েষা সকৌতুকে কহিল-খুলে না বল্লে কী করে বুঝবো? আমি বাপু, তোমার আকার-ইংগিতের ধার ধারিনে!
রহিম শুধু কহিল ‘বেশ’! ক্রমে তাহারা ইস্কুলের নিকটবর্তী হইয়া পড়িয়াছিল। কথা আর হইল না। বলা বাহুল্য, রাত্রে যখন পড়িবার জন্য বই খুলিল, আয়েষা উহার ভিতরে একখানা সুদীর্ঘ প্রণয়লিপি পাইল।
তাহাকে লিখিয়াছে। কে, কখন তাহার বইয়ের ভিতরে উহা রাখিয়া দিয়াছে, তাহা সে দেখে নাই। চিঠিতে প্রেরকের নাম নাই। তবে হস্তাক্ষর দেখিয়া তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, উহা কোন মহাপুরুষের কীর্তি।

উৎপাত লাগিয়াই আছে। তবু আয়েষা দমিল না। মানুষের বক্রচাহনি এবং কথার গুঞ্জরণ উপেক্ষা করিয়া সে রীতিমতো ইস্কুলে যাতায়াত করিত। তবে খুব সাবধানে চলিতে হয়। কোনোরূপ অপ্রীতিকর ব্যাপার না ঘটে কিংবা কোথাও কোনো মনুষ্য-শ্বাপদের শিকার হইতে না হয়, এই সব দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখিয়া সে পথ চলে। সাবধানের মার নাই। তাই সতর্কতা। তবুও সেদিন রহিমের পাল্লায় পড়িতে হইল।
আয়েষা হাঁটিয়া যাইতেছিল ইস্কুল ছুটির পরে। সহসা তাঁহার আঁচলের কাপড়ে টান পড়িল। ত্বরিতে পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল, রহিম মিটি মিটি হাসিতেছে। তাঁহার ক্রোধের উদ্রেক হইল। কর্কশভাষে কহিল-ফাজলেমীর আর জায়গা পাওনা? অসভ্য কোথাকার!
রহিম নির্লজ্জ হাসিতে দন্তবিকশিত করিয়া কহিল-ফুলস্পীডে গাড়িতে ছুটাচ্ছিলে, আমি একটু স্লো করে দিলাম। তাকে অসভ্য হলাম কিসে?
রাগিয়া আয়েষা কহিল-অসভ্য নাতো সুসভ্য? ইতর অভদ্র, জানোয়ার!… … ক্রোধে কাঁপিতেছিল।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *