কাদিয়ানী ধর্মমত : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

‘কাদিয়ানী স¤প্রদায় মুরতাদ ও কাফির’ এ সিদ্ধান্তটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জানার বিষয় নয় বরং ইহা সারা বিশ্বেই আলোচিত একটি কথা। উপরে বর্ণিত বাক্যটি যেমন সহজ অর্থবোধক কিন্তু ইহার ইতিহাস খুব সংক্ষেপ নয়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নবুয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের নানা রকমের মিথ্যাচার চলছে। অর্থাৎ তারা ইসলাম ধর্মের নকল অনুসারী সেজে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় তারা ইসলামের বিপরীত ধর্মানুসারীদের ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন ইসলামের বিরুদ্ধে নানা রকমের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রথমে দেখবো বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে কী বলে গেছেন।
কিয়ামতের আলামত হিসেবে যেসব বিষয়গুলো সারা বিশ্বে অতি পরিচিতি লাভ করেছে, তন্মধ্যে ‘দাজ্জাল’ বের হওয়া’ প্রসঙ্গটি অন্যতম। ‘দাজ্জাল’ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ চরম মিথ্যাবাদী। পরিভাষায় ধর্মপ্রতারককেই ‘দাজ্জাল’ বা ‘চরম মিথ্যাবাদী’ বলা হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের উদ্দেশ্যে ভবিষৎ বাণী রেখে গেছেন; তন্মধ্যে নবুয়াতের মিথ্যা দাবিদার প্রসঙ্গে খুব সতর্ক করে গেছেন। নবীজির এই বাণীগুলো আমাদের জন্য শিরোধার্য।
বিশ্বনবীর মুখ নিঃসৃত বাণী এক প্রকার ওহী : আল্লাহপাক বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে আল কুরআনে উলে­খ করেছেন যে, ‘ওয়ামা-ইয়ানতিকু আনিল হাওয়া, ইন হুওয়া ইল­া- ওয়াহ্য়ুন য়ূহা’ অর্থাৎ তিনি (রাসূল) যা কিছু (হাদীসের বাণী) বলেন- তা তাঁর নিজের খেয়াল থেকে নয় বরং ঐসব কথাগুলো আল­াহর ইশারায় বলে থাকেন, যা এক প্রকার ওহী। সূত্র : আন নাজম ৩-৪। ওহী দুই প্রকার। এর প্রথম প্রকার-‘ওহীয়ে মাতলূ’ যার ওপর নাম আল কুরআন এবং দ্বিতীয় প্রকার হলো ‘ওহীয়ে গাইর মাতলূ’ যার ওপর নাম আল হাদীস। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য বহু রকমের ভবিষৎ বাণী রেখে গেছেন। তন্মদ্যে আজকের উলে­খিত বিষয় হলো নবুওয়াতের নামে মিথ্যাচার প্রসঙ্গ।

মিথ্যা দাবি প্রসঙ্গে আয়াত ও হাদীস
আয়াত : বলুন সত্য এসেছে মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ার মতই।’ সূত্র : সুরা বাণী ইসরাইল-৮১
হাদীস : হজরত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল­াহু আনহু থেকে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘কিয়ামত ঐ সময় পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দুটি দলের মধ্যে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে। অথচ উভয় দলের দাবি এক হবে। তিনি আরো বলেন, কিয়ামত ঐ সময় পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ জন মিথ্যাবাদী (দাজ্জাল) পৃথিবীতে না আসবে; যাদের প্রত্যেকেই দাবী করবে যে, আমি আল­াহর রাসূল।’ সূত্র : বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদ
কিয়ামতের পূর্বে ঈমান-ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রকাশের রহস্য : এটা চিরন্তন সত্য যে, কিয়ামতের আলামতের পরিপূর্ণতা না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী ধ্বংস হবে না। তাই সাধারণত প্রশ্ন আসে, যেহেতু কিয়ামতের পূর্বে সুনির্দিষ্ট কিছুর আবির্ভাব হবে তাহলে আমরা শত চেষ্টা করে ঐসব কিছুর পরিবর্তন করতে পারবো না; তাই এর বিপরীত নীতি অবলম্বনের প্রয়োজন কী? প্রশ্নটি যদিও খুব যৌতিক তবে এর সহজ উত্তর হবে, একমাত্র ঈমানদার মানুষেরা তাঁদের ঈমান এর স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিকর বিষয়গুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করছে কি না তা পরীক্ষার জন্যই কিয়ামতের আলামত প্রকাশের পূর্বে সতর্কতা অবলম্বনের তাকিদ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া উত্তরটি ভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যায়। যেমন কেউ যদি জানে যে কোনো রাস্তার মধ্যে হিংস্র জন্তু আছে তাহলে যে মনে করে ঐ হিংস্র জন্তুটি মানুষকে আক্রমণ করবে, তখন কোনো পথচারী এদিকে যাওয়ার ইচ্ছা করবে না। ঠিক ঈমানদার মানুষেরা যখন জানবে যে কিয়ামতের এই আলামতগুলো ঈমানদার মানুষের জন্য ক্ষতিকর তখন এমনিতেই ঈমান রক্ষার স্বার্থে ঐসব আলামতগুলোর প্রতি সখ্যতা গড়ে তুলতে যাবে না।
মীর্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী, পরিবার ও তার মতবাদ প্রসঙ্গ : ‘কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ ১৩ ফেব্র“য়ারি ১৮৩৫ সালে ভারতের পাঞ্চাব প্রদেশের গুরুদাশপুর জেলার কাদিয়ান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহের নাম মির্যা আতা মুহাম্মদ, পিতার নাম মির্যা গোলাম মর্তুজা ও মাতার নাম চেরাগ বিবি উরফে গেছেটি বেগম। গোলাম আহমদ যমজ ছিলেন এক বোনের সাথে, যিনি জন্মের কিছু দিন পরেই মারা যান। যার নাম ছিল জান্নাত বিবি। এক বড় ভাই ছিলেন-নাম গোলাম কাদির। চাচার নাম মির্যা গোলাম মহিউদ্দিন- তাঁর তিন পুত্র। (১) ইমামুদ্দীন, (২) নিজামুদ্দীন ও (৩) কামালুদ্দীন এবং কন্যা উমরান নেছা বেগম। সতের বছর বয়সে মির্যা গোলাম আহমদ এর মামাতো বোন হুরমত বিবির সাথে ১ম বিয়ে হয় এবং চার বছরের মধ্যে দুই সন্তানের জন্ম হয়। এদের নাম (১) মির্যা সুলতান আহমদ (১৮৫৩-১৯৩১) ও (২) মির্যা ফজল আহমদ (১৮৫৫-১৯০৪)। তার প্রথম দু’ সন্তান পিতার ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাস মেনে নেয়নি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে- পিতার জীবদ্দশায় ২য় পুত্রের মৃত্যু হলে পিতা (মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) পুত্রের জানাযায় অংশগ্রহণ করেননি। স্ত্রীর সাথে তেমন ভাল সম্পর্ক না থাকায় তার সম্বন্ধ ঠেকেনি। হুরমত বিবি দুই পুত্র নিয়ে ভাসুরের (মির্যা গোলাম কাদির) সংসারে উঠেন, যাদের কোনো সন্তানাদি ছিল না। এর পর মির্যা গোলাম আহমদ নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেন ও তার ধ্যান ধারণা অনুযায়ী ধর্মে-কর্মে মনোনিবেশ করেন। মির্যা গোলাম আহমদ বাড়িতেই ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন-এতে কোনো পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। ১৮৬৪ সালে তিনি শিয়ালকোট জেলা আদালতে কিছুদিন চাকরি করেন। পিতার মৃত্যুর পর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৮৮০ সালের পর বুরহান-ই আহমদীয়া (৪ খণ্ড) রচনা করেন। ১৮৮২ সালে মার্চ মাসে মির্যা গোলাম আহমদ দাবি করেন যে, তিনি ‘ওহী’ পেয়েছেন এবং আল­াহ তাকে এক বিশেষ কাজের ভার দিয়েছেন। ১৮৮৮ সালে আরেক ওহী’র বলে তিনি শিষ্যদের কাছ থেকে ‘বাইআত’ (আনুগত্য গ্রহণ) এর দাবি করেন। ১৮৯০ সালের শেষের দিকে তিনি আরেকটি ‘ইলহাম’ পান যে, হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাননি-তিনি কাশ্মিরে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আর আবির্ভূত হবেন না। তাঁর গুণাবলী নিয়ে মির্যা গোলাম আহমদ সাহেব নিজেই আবির্ভূত হয়েছেন। এছাড়া তিনিই (গোলাম আহমদ) মাসীহে ঈসা এবং অঙ্গীকৃত ত্রাণকর্তা।
গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ১৯০০ সালে আরেকটি মতবাদ সৃষ্টি করেন। বলেন, অস্ত্রের জিহাদ বলে কিছু থাকবে না। ১৯০১ সালে মির্যা সাহেব নিজেকে নবী বলে দাবি করেন। ১৯০৪ সালে নভেম্বর মাসে শিয়ালকোটের এক জনসভায় নিজেকে ‘মসীল-ই কৃষ্ণ’ (সম্ভবত মসীহে কৃষ্ণ) বলে দাবি করেন অর্থাৎ হিন্দুদের কল্কি অবতার বলে দাবি করা হয়। তাছাড়া তিনি পার্শিয়ান জোরাস্ত্রিয়ানদের মত অনুযায়ী নিজেকে পার্শীদের নবী অর্থাৎ, ‘মেসিও দারবাহমী’ বলে দাবি করেন। প্রায় ২৬ বছর ধরে মির্যা গোলাম আহমদ ব্যাচেলর জীবনযাপন করেন। ১৮৮১ সালে তিনি আল্লাহর তরফ থেকে ‘ইলহাম’ পান- দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য এবং ১৮৮৪ সালে ১৭ নভেম্বর দিলি­র বিখ্যাত খাজা মীরদাদ বংশে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম সৈয়দা নুসরত জাহান বেগম (১৮৬৫-১৯৫২)। তখন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বয়স হয় ৫০ বছর। এই সময়ে তিনি দুটো মারাত্মক রোগে ভুগতেন। একটি মাথা ধরা এবং অন্যটি বহুমূত্র। তবুও এই দ্বিতীয় বিবাহের কারণে তাঁর দশটি ছেলে ও মেয়ের জন্ম হয়। তারা হলেন-
০১. ইসমত বিবি (১৮৮৬-১৯৯১), ০২. বশীর আওয়াল (১৮৮৭-১৮৮৮), ০৩. বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (১৮৮৯-১৯৬৫) [২য় খলিফা : ১৯১৪-১৯৬৫], ০৪. শওকত (১৮৯১-১৮৯২), ০৫. বশীর আহমদ (১৮৯৩-১৯৬৩), ০৬. শরীফ আহমদ (১৮৯৫-১৯৬১), ০৭. মুবারিকা বিবি (১৮৯৭-১৯৭৭), ০৮. মুবারক আহমদ (১৮৯৯-১৯০৭), ০৯. আমাতুন নাসির (১৯০৩-১৯০৩), ১০. আমাতুল হাফিজ বেগম (১৯০৪-১৯৮৭)। সূত্র : সীরাতে মাহদী-২৯-৫৩

(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *