ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকার

প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে। অধিকার ও কর্তব্যের দিক দিযে় সকল মানুষ এক ও অভিন্ন। এটিই হলো মানবাধিকারের মর্ম কথা। অন্য কথায় প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের নামই হচ্ছে মানবাধিকার। মানুষের ভাষা, গোত্র ও বর্ণে ভিন্নতা দেখা গেলেও সব মানুষ মূলত এক স্রষ্টার সৃষ্টি। এক আদমের সন্তান।
জাহেলী যুগে মানবাধিকারের প্রতি মানুষ যত্নশীল ছিল না। ফলে মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল অশান্তি, অনাচার, হানাহানি, হত্যা, ধর্ষণসহ একে অপরের অধিকার কেড়ে নেয়ার জঘন্য প্রবণতা। কিন্তু ইসলাম তার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের অধিকারের প্রতিটি বিষয় সমাজে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ফলে এক সময় যে জাতি ছিল জাহিল, কলহপ্রিয় বর্বর নামে পরিচিত, সে জাতিই ইসলামের সুশীতল ছায়ার নিচে আশ্রয় নিযে় ইসলামের শিক্ষার আলোকে দাযি়ত্ববান, সুনাগরিক, নীতিপরায়ণ ও বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বর্তমানে মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের প্রধান বিষয়গুলো হলো, মানুষের জীবন ও প্রাণের নিরাপত্তা, সম্পদও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা, ন্যায় বিচার প্রাপ্তির নিরাপত্তা, মত প্রকাশের নিরাপত্তা, সৃষ্ট সামাজিক জীবনযাপন ও অধিকার প্রাপ্তির নিরাপত্তা, ধর্ম ও জীবন বিধান গ্রহণ ও পালনের নিরাপত্তা। উল্লেখিত অধিকার সমূহের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম অসামান্য গুরুত্ব প্রদান করেছে। আজ থেকে দেড় হাজার বৎসর পূর্বে ইসলাম শুধু মানবাধিকারের ধারাগুলো ঘোষণা দিয়েই নিজ দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেনি বরং তার সুন্দর বাস্তবায়নার্থে প্রত্যেক মানুষের কি দাযি়ত্ব ও কর্তব্য রযে়ছে এবং কর্তব্য পালনে অবহেলার দরুণ তাকে কি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে সে বিষযে়ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

জীবনের নিরাপত্তা বিধান :
নর হত্যাকে সুস্পষ্টভাবে নিন্দিত ও নিরুৎসাহিত করে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হযে়ছে, ‘যে ব্যক্তি একজন মানুষকে হত্যা করে সে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করে, যে একজন মানবকে রক্ষা করে সে সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করে।’ (৫:৪)
আরাফাতের প্রান্তরে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-‘মনে রেখ আজকের এই শহর, এই মাস ও এই দিনটি যেমন তোমাদের কাছে পবিত্র, তদ্রুপ পবিত্র তোমাদের একজনের কাছে অপরজনের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম।

সম্পদের নিরাপত্তা বিধান :
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন-‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কোন মানুষের ধন, মালের কিয়দংশ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকের নিকট ঠেলে ফেলে দিওনা।’ (২:১৮৮)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন তোমরা আমানতসমূহ তার যোগ্য ও পাওনাদার ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছিযে় দাও।’

নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা বিধান :
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীকে বলা হত শয়তানের অঙ্গ। নারীর কোনো সামাজিক অর্থনৈতিক অধিকার ছিলনা। নারী ছিল সর্ব মহলে চরম অবজ্ঞার পাত্র। ঠিক তখনই ইসলামের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন- ‘স্ত্রী হচ্ছে পুরুষের অর্ধাঙ্গীনী। স্ত্রী হচ্ছে তার গৃহের রাণী।’
কোরআন মাজীদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- ‘নারীদের তেমনি ন্যায় সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের।’ (২-২৮৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন, মাতা পিতা উভয়কে শ্রদ্ধা করতে, উভযে়র আদেশ নির্দেশ পালন করতে। একই সঙ্গে একথাও তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ‘মাযে়র পদতলে সন্তানের বেহেশত।’
ইসলাম ঘোষণা করে কিয়ামতের দিন স্ত্রীর নিকট জিজ্ঞাসা করা হবে তার স্বামীর স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কে। স্ত্রীর সাক্ষ্য প্রদানের উপর স্বামীর বিচারের অনেক কিছুই নির্ভর করবে। ইসলাম নারী জাতিকে মর্যাদা ও অধিকার দিযে়ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অংশ ও অধিকার। অ্যানী বেসান্ত (ANNIE BESANT) তার বিখ্যাত Kamala Lectures উল্লেখ করেছেন-In Islam Men and Women are put perfectly on egual footings,Mussalman women have been fae batter treated then the western women by the law.By the laws of Islam her property is care fully guarded whereas Christen women into enjoy such absolute right according to the laws of Christen West.

সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান :
মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষ কে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে হয়ত সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। এবং কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে হয়ত সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হবে। তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকোনা। ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরণের আচরণ থেকে নিবৃত্ত না হয় তারাই জালিম।’
‘হে ঈমানদারগণ! অন্যের প্রতি কুধারণা পোষণ করার প্রবণতা থেকে বিরত থাকো। কোন কোন খারাপ ধারণা মারাত্মক পাপ। একে অন্যের দোষ অন্বেষণ করে বেড়াবে না। তোমাদের কেউ যেন অপরের গিবত না করে।’ (হুজরাত)

সুবিচার প্রাপ্তির নিরাপত্তা বিধান :
মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমাদারগণ তোমরা ন্যায় সাক্ষ্য দানে অবিচল থাকবে। কোন জনগোষ্ঠির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে কখনো সুবিচারের অন্যতা করতে প্ররোচিত না করে। সর্বদা সুবিচার করবে। এটিই তাকওয়ার নিকটতম ও সামঞ্জস্যশীল কাজ। আল্লাহ কে ভয় করবে। মনে রেখো আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় অবহিত।’ (মায়িদা)
অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করো তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সর্বশ্র“তা ও সর্বদ্রষ্টা।’ (নিসা)
উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ইসলামের আইন রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, শক্তিমান-দুর্বল, অভিজাত ও সাধারণ সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।

মতামত প্রকাশের নিরাপত্তা বিধান :
মহান আল্লাহ পাক নিজেই বাক স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে, ‘আমি মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দিযে়ছি। এখন হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ থাকবে।’
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর মহান আল্লাহ পাক কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশী গ্রন্থ আল কোরআনে মানবাধিকারের প্রতিটি বিষয় বিশদভাবে আলোচিত হযে়ছে। আর এগুলো বাস্তবায়ন করে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার সমাজ ও রাষ্ট্রকে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীর্ঘ ২৩ বছরের কর্মমুখর জীবনে তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি ছিলেন যত্নিশীল। জীবনের শেষ বিদায় হজ্বে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন সেটিই ছিল তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সর্বশেষ দীর্ঘ বক্তৃতা। এভাষণে তিনি জনতার সামনে মানবাধিকারের ধারাগুলোকেই প্রধানত আলোচনা করেন। এ ঐতিহাসিক ভাষণে নবীজির উদাত্ত ঘোষণা-
‘আমার কথাগুলো তোমরা মনোযোগ সহকারে শোন। শোন জাহেলী যুগের সকল প্রকার শ্রেণি ও গোত্রভেদ ব্যবস্থা বিলীন করে দেওয়া হল। জাহেলী যুগের সকল সুদ প্রথা নিষিদ্ধ করা হল, অবশ্য প্রদত্ত ঋণের মূলধন তোমাদের ফেরৎ পাওয়ার অধিকার আছে। তোমরা জুলুম করো না, জুলুমের শিকার হইওনা। মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। মুমিনের জন্য তার অপর ভাইয়ের সম্পদ তার সম্মতি ব্যতিরেকে গ্রহণ করা হারাম। এক আল্লাহ তোমাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তোমরা একই আদমের সন্তান ও মাটি থেকে সৃষ্টি। কাজেই কোন আজমীর উপর যেমন কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি কোন আরবের উপর কোন আজমীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া। যে সর্বাধিক মুত্তাকী সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত।’

Comments

comments

About

Check Also

বিজয় দিবস : একটি পর্যবেক্ষণ

নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় নির্ধারণ করেছি। এতে করে আল্লাহ তোমাকে তোমার পূর্ববর্তী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *