বিজয় দিবস : একটি পর্যবেক্ষণ

নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় নির্ধারণ করেছি। এতে করে আল্লাহ তোমাকে তোমার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ত্রুটিসমূহ মাফ করে দিবেন। তোমার প্রতি তার নিআমত পূর্ণ করবেন, তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করবেন, এবং আল্লাহ তোমাকে বলিষ্ঠ সহযোগিতা দান করবেন। (আল ফাতহ : ১-৩)
শাব্দিক অর্থে বিজয় ও বিজয় দিবস : বিজয় (চবি+জি+অ) শব্দটি বিশেষভাবে জয় অর্থে জয়লাভ করা, অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার, অন্যকে পরাস্ত করতে সক্ষম হওয়া ইত্যাদি বুঝায়। আর দিবস (চদিব+অস্) দিন অর্থে বিজয় লাভের ক্ষণ, ঘটনা, পরিস্থিতি, দিন, তারিখ ইত্যাদি বুঝায়।
ব্যাপক অর্থে বিজয় : ব্যাপক অর্থে বিজয় কথাটি যে কোন ধরনের সফলতা, প্রাপ্তি, অধিকারপ্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার স্বীকৃতি লাভ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। আরেকটু খোলাসা করে বলতে গেলে আমরা বলতে পারি –
উদাহরণ স্বরূপ : আদমকে সাজদা করতে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় শয়তানের পরাজয় এবং আদমের জয় স্বীকৃত হল। হাবিলের হত্যার ঘটনায় কাবিলের ওপর হস্ত-প্রসারিত না করার মাধ্যমে হাবিলের বিজয় স্বীকৃত হল। এ ভাবে নমরূদ বাহিনীর ওপর ইবরাহীমের আ. বিজয়, ফিরআউন বাহিনীর ওপর মূসা আ.-এর বিজয়, স্বীয় ভ্রাতাগণের উপর ইউসুফ আ.-এর বিজয়, ইয়াহুদীজাতির ওপর ঈসার আ. এর বিজয়, এবং মক্কার কাফির মুশরিকদের ওপর মহানবীর বিভিন্ন বিজয়, রোম পারস্য সা¤্রাজ্যের ওপর মুসলিম বিজয়, তাতার বাহিনীর ওপর আইউবী শক্তির বিজয়, ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর পাক-ভারতীয়গণের বিজয়, পাক-বহিনীর ওপর বাংলাদেশের বিজয়, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে নব্বই-এ জনতার বিজয় ইত্যাদি অসংখ্য বিজয়ের ঘটনার আংশিক নমুনা।
বিজয় দিবস ও উহার গুরুত্ব : এতক্ষণে বিজয়ের যে সব ফিরিস্তি আমরা উল্লেখ করলাম সেগুলোর বেশির ভাগেরই কোন দিন তারিখ নির্ধারিত নাই। আবার পরবর্তী কালের যেগুলোর দিন-তারিখ নির্ধারিত আছে সেগুলোর অনেকটিই স্মৃতির পাতায় গুরুত্ব না থাকায় বিস্মৃত হয়ে গেছে।
এক দিক দিয়া বলা যায় : বিজয়ের কোন দিন তারিখ উল্লেখিত ও নির্ধারিত না থাকা বিজয় দিবসের গুরুত্বহীনতার প্রতি ইংগিত বহন করে। অপর দিকে কোন কোন বিজয়ের ও সফলতার দিন ক্ষণ বিভিন্ন ভাবে পালনের দ্বারা উহার গুরুত্বের প্রতি ইংগিত করে। তবে সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়-যেসব সফলতা ও বিজয়ের ব্যাপারটি দেশ-জাতি অথবা ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে উহা কোনভাবে উদযাপনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে সেগুলোই উদযাপন করা হয়ে থাকে। যেমন-ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয় ইত্যাকার ঘটনাকে বিজয় বলা হলেও তা পালনের ব্যাপারে কোন কথা বা সংস্কৃতি বর্ণিত হয়নি। আবার আরাফার দিবসকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণা দেওয়ায় ওই দিনকে উদযাপন করার রীতি বর্ণিত হয়েছে। তাহলে যে দিবস পালনের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে সেটিই পালনীয়, যদিও তা বিজয় ও সফলতা বহন করে আনেনি। আবার যে দিবস পালনে বর্ণনা আসেনি তা পালনীয় নয়, যদিও তাতে বিজয় ও সফলতা অর্জিত হয়েছিল। এটা ইসলামী দৃষ্টিকোণ হলেও সাধারণ দৃষ্টিকোণও এর ব্যতিক্রম নয়। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের ষোলই ডিসেম্বর পালনকৃত হলেও ব্রিটিশ বাহিনির বিরুদ্ধে বিজয়ের চৌদ্দই আগস্ট পালন করা হয়না। সুতরাং দিবস পালনের বিষয়টি একেবারেই আপেক্ষিক।
বিজয় দিবসে করণীয় : দিবস পালন প্রথাগত না হয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলে দেশ ও জাতি দুনিয়া আখিরাতে উহার সুফল লাভ করতে সক্ষম হবে। তাৎপর্যের বিষয়টি পুরোটাই শরীয়াতের ওপর ছেড়ে দিলে এক্ষেত্রে লাভ শতভাগ। অবশ্য পার্থিব দৃষ্টিকোণ ও কিছু কিছু লাভ দেখাতে সক্ষম হয়। কমপক্ষে আনন্দ-ফূর্তি উৎসাহ-উদ্দীপনা, কর্মব্যস্ততা, সম্প্রীতি-সৌহার্দ ইত্যাদির পরশ লাভ করা যায়। পার্থিব ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিজয় দিবস পালন যে সকল কর্মের মাধ্যমে হতে পারে
ক্স দিবসটিতে সাওম পালন করা।
ক্স কুরআন তিলাওয়াত করা।
ক্স অতি প্রত্যুষে জাগরিত হওয়া।
ক্স আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো।
ক্স গরীব দুঃখীদের দান সদকা প্রদান করা।
ক্স বিজয় ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতে আরো বিজয়ের জন্য হিম্মত করা।
ক্স বিজয়দাতা মহান আল্লাহ পাকের শোকরগোজারী বাড়িয়ে দেওয়া, গুণকীর্তন করা।
ক্স বিজয়ে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান ও ভূমিকা রয়েছে তাদের জন্য দুআ করা।
ক্স আল্লাহর নিকট নিজের জন্য ও জাতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।

বিজয় দিবস পালনের বাস্তব চিত্র
আমাদের সমাজে বিজয় দিবস পালনের যে সকল বাস্তব চিত্র অবলোকিত হচ্ছে তা রীতিমত ইসলাম ও বিবেকবর্জিত এবং দেশের উন্নয়ন ও জাতিগঠনের পথে অন্তরায় না হলেও সহায়ক নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আমাদের সমাজে বিজয় দিবস পালনের চিত্রের মধ্যে থাকে রাত ১২:০১ ঘটিকায় বন্দুকের গুলি, পটকাবাঁজি ইত্যাদি ফুটানো, জাতীয় স্মৃতি সৌধে রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধান থেকে শুরু করে পর্যায় ক্রমে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিভিন্ন দলের পুষ্পস্তবক অর্পণ করা, সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, সেমিনার করা, পত্রিকায় বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা, টিভি রেডিওতে আলোচনা অনুষ্ঠান- নাটক ইত্যাদির আয়োজন করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা, জেলের মধ্যে আটক কাউকে মুক্তি দেওয়া, কারো শাস্তি কমিয়ে দেওয়া, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে ক্ষমা করে দেওয়া, মেলার আয়োজন করা, আনন্দ র‌্যালী বের করা ইত্যাদি আরো কত কিছু।
এগুলোর কোনটি ইসলামী কালচার না, তবে কিছু কিছু আছে ইসলামে সেগুলো নিষিদ্ধ নয়, আবার কোন কোনটি সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিপন্থী। তাই এসমস্ত ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের মেনে চলা উচিৎ যার কিছু নমুনা পূর্বে তুলে ধরা হয়েছে।

বিজয় দিবস ও কিছু কথা
বাংলাদেশের বিজয় দিবস ষোল (১৬)-ই ডিসেম্বর। এটি দেশের জাতীয় দিবস ও বটে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান যা বর্তমানে পাকিস্তান নামে পরিচিত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করে। স্বভাবতই বিভিন্ন দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। যার সুবাদে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। তাদের এহেন নিপীড়ন-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে তাদেরকে এদেশের কর্তৃত্ব হতে বিদায়ের মাধ্যমে এদেশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ২৬ শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল এ বিজয়। তাই এ বিজয় জাতি ধর্ম-বর্ণ দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রাপ্তি। সকলেই প্রত্যেক নাগরিক এর সুফল ভোগের ভাগিদার। কিন্তু আফসোসজনক হলেও সত্য যে, দেশের একটি শ্রেণিকে শাসক ও জনতা এ সুফল নিজেদের একান্ত সম্পদ বলে দাবি না করলেও অবস্থা দৃষ্টে বোঝা যায়। বিশেষ করে ইসলামের ধারক ও বাহকদেরকে দেশের বিপক্ষশক্তি বানিয়ে নানা ভাবে তাদেরকে বঞ্চিত করে আসছে। ফলে বিজয় দিবসের যাবতীয় চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে ইসলামকে একপাশে রেখেই সকল কাজের আঞ্জাম দেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি যে সকল আয়োজন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় সেগুলোর অনেকটারই উদ্দেশ্য ইসলাম ও মুসলিমকে ঘায়েল করা। এ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের সাথে কখনও সামঞ্জস্যশীল নয়। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামে যেভাবে সকলে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে অংশ গ্রহণ করেছিল ঠিক তেমনি স্বাধীনতার সুফল ভোগের ক্ষেত্রেও সকলেরই সমান ও সাম্যের মাধ্যমে অংশ গ্রহণ থাকবে। বিজয় দিবস উদযাপনে সেটিই সকলের কাছে প্রস্ফুটিত হওয়া দেশ ও নীতির একান্ত দাবি। বিজ্ঞাপন সর্বস্ব বিজয়, মোড়ক সর্বস্ব অনুষ্ঠান, প্রদর্শন সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা আমরা চাই না। আমরা চাই বিজয়ের প্রকৃত রূপ, রস, গন্ধ ও ছন্দ। স্বাধীনতার বিজয়কে কেন্দ্র করে প্রতিটি নাগরিক যেন পায় স্বাধীনতার যথার্থ স্বাদ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *