স্মৃতি

রাতের কালো আধার ভেদ করে সূর্য উঠে। ধীরেধীরে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। তখন বাইরে ঠিকে থাকা দায়। তেমনি এক রগচটা গম্ভীর স্বভাবের জিলান। তার বয়স আর কতই বা হবে? সবেমাত্র ষোলতে পা দিয়েছে। রগচটা স্বভাবের কারণে গ্রামের অনেকেই তাকে ‘জিওল’ বলে ডাকে। এমনকি তার একেবারে প্রিয় বন্ধু আবিদও-
কিরে দোস্ত, তোকে সবাই জিওল বলে ডাকে, তুই রাগ করিস না?
আবিদের প্রশ্ন শুনে জিলান হাসে।
আরে না দোস্ত, সব কথায় রাগলে কি আর চলে?
ঠিক আছে, তাহলে আর কখনো রাগ করবি না, কেমন?
জিলান সায় দেয়।-হুম।
জিলানের রাগ বেশি হলে কি হবে, পড়ালেখা করে প্রচুর। স্কুল ফাঁকি সে তো অনেক দূরের কথা। তাছাড়া কারো কোন ক্ষতি করেছে কিংবা কারো সাথে বেয়াদবি করেছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না।
শুধু রাগ উঠলেই একটু ঝামেলা হয় আরকি!
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বিকেলবেলা তেমন একটা খেলাধুলো করে না। বন্ধু আবিদকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর তীরে। সেখানে বসে দুজন গল্প কিংবা পড়ালেখা নিয়ে সময় পার করে। কখনো কখনো ওরা বড়শী নিয়ে যায় নদীতে মাছ ধরতে, হঠাৎ বড় বড় মাছ পেয়েও যায়। মাছ পেলে তখন দুজনের কি যে খুশি!…

দুই
প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম থেকে ওঠে জিলান। সকালের সব কাজ শেষ করে স্কুলে যাওয়ার জন্য পড়ার টেবিল থেকে উঠতে যাবে ঠিক তখনি জিলানের বাড়িতে প্রবেশ করে আবিদের ছোট ভাই ইমরান। ইমরানকে দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জিলান।
আরে ইমরান যে! কি মনে করে এতো সকালে, বস বস।
ইমরান কোন কথা বলে না। ওর মুখটা বিমর্ষ দেখে ভয় পেয়ে যায় জিলান। ইমরান কিছু বলার আগেই আবারো প্রশ্ন করে-
ইমরান কি হয়েছে? কিছু বলছ না যে, খারাপ কিছু হয়েছে?
জিলানের চোখে দুশ্চিন্তার ছোঁয়া। কোন কথা না বলেই ইমরান জিলানের হাত ধরে তাদের বাড়ির দিকে পথ ধরে। ইমরান এর কর্মকাণ্ডে এবার ‘থ’ হয়ে যায় জিলান। মনের মধ্যে ভয়টা আরো বাড়তে থাকে।
জিলান আবিদের বাড়ি পৌঁছে বাড়িভর্তি মানুষের ভীড় লক্ষ করে। ঘর থেকে ভেসে আসছে করুণ সুরে মহিলাদের আহাজারি।
কিছুই বুঝতে পারছে না জিলান। এদিক সেদিক তাকাতেই হঠাৎ চোখ পড়ে উঠোনের মধ্যখানে সাদা কাপড় মোড়ানো খাটিয়ার দিকে। ব্যস, এক দৌড়ে আবিদের ঘরে প্রবেশ করে জিলান। তাকে দেখে আবিদের বাবা এনাম সাহেব কাঁদোকাঁদো কন্ঠে কাছে ডাকলেন। অতঃপর উঠোনে রাখা খাটিয়ার কাছে নিয়ে লাশের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখালেন। লাশে চোখ রাখতেই ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসে। আরে! এ যে তার প্রাণাধিক বন্ধু আবিদ।
বন্ধুর বিয়োগে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। পাশে থাকা আবিদের বাবাও কেঁদে দিলেন। ঘরের ভেতরের কান্নার আওয়াজ যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। জিলান অঝোরে কাঁদছে। হঠাৎ সেও মূর্ছা গেলো।

তিন
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে জিলান। চোখ মেলতেই দেখল তার পাশে বাবা-মা আর একজন ভদ্রলোক। এছাড়াও আরো অনেক আত্মীয় দেখতে এসেছেন তাকে। সবাইকে চিনলেও এই ভদ্রলোকটাকে সে চিনতে পারছেনা। কে হতে পারে? এমন চিন্তা করছিলো। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক বললেন –
বাবা জিলান, কেমন আছো তুমি? কেমন লাগছে এখন?
কিছু বলতে পারেনা, অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর ফের চোখ খুলে দেখে পাশে কেউ নেই, শুধুমাত্র সেই ভদ্রলোক বসা। আবারো একই প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। জিলান কোনরকম উত্তর দেয়। তারপর ভদ্রলোক তার পরিচয় খুলে বলতেই সে চিনতে পারে। এ যে তার সুমন মামা! সেই ছোটবেলায় দেখেছিলো। তাকে তিনি কতো ভালবাসতেন। মামার পিঠে চড়ে ঘোড়া চড়ার স্বাদ মিটিয়েছিল কতবার। কিন্তু মামা বিদেশে চলে যাওয়াতে আর দেখা বা যোগাযোগ হয় নি। আর মামা যে দেশে ফিরেছেন সে কথা তো কেউ তাকে বলেনি। হয়তো সারপ্রাইজ দেবার জন্য। কিন্তু তার আগে অনেক বড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেছে সে। প্রাণপ্রিয় বন্ধু আবিদ তাকে একা ফেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে। আবিদের কথা মনে পড়তেই মনটা তার বিষিয়ে উঠলো। মামাকে তখন বন্ধুর কথা জানালো। সব শুনে মামা তাকে শান্তনা দিলেন- ‘এই দুনিয়াতে আমরা কেউ ই চিরস্থায়ী নয়, সবাইকে একদিন না একদিন চলে যেতে হবে।’
মামার কথা শুনে দুঃখ কিছুটা কমলো। মামার সাথে বাড়ি ফিরে অনেক খেলা করলো জিলান।
মন অনেকটা হালকা হয়ে গেলো। রাগী স্বভাবটা তার মাঝ থেকে চলে গেছে। জিলান এখন নিজেকে নিয়ে ভাবে আর বলে, কতটা বদলে গেছি আমি।

চার
আবিদ চলে যাওয়ার আজ চার বছর হতে চলল। প্রতিদিনকার মতো আজও নদীর ধারে একাকী বসে আছে জিলান। তার মনে পড়ে, এইতো সেই বিকেল, দুবন্ধু একসাথে এখানে বসে গল্প করা বড়শী দিয়ে মাছ শিকার, আরো কতো কিছুই না করতো। আজ এসব কেবলই স্মৃতি। এরকম হাজারো স্মৃতি এসে তাকে নাড়া দিয়ে যায়। তবুও নিজেকে পরিবর্তন করেছে এটা ভেবে তার মনটা হালকা হয়। আগে কতই না রাগী ছিল, আর এখন…?
এসব ভাবতে গিয়ে নিজের অজান্তে হেসে দেয়। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য হেলে পড়েছে।
উঠে দাঁড়ায় জিলান। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে। সূর্যের লাল রঙে ছেয়ে গেছে নদীর বুক। পানিগুলোকে মনে হচ্ছে রক্তের তরঙ্গ। নদী তীরের পাখিগুলো সব মেঘহীন আকাশে ওড়ে ওড়ে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো তিমির রাত। রাতের আঁধারে চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় জিলান…।

Comments

comments

About

Check Also

ইমাম সাব

ইমাম সাবের চেহারা দেখে টাসকি খেয়ে গেল হাসান। ‘ইহাও দেখার বাকি ছিল!’ ঝরে যাওয়া ঝাড়–র …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *