ইমাম সাব

ইমাম সাবের চেহারা দেখে টাসকি খেয়ে গেল হাসান। ‘ইহাও দেখার বাকি ছিল!’ ঝরে যাওয়া ঝাড়–র শলাকার মতো ধারালো খোচা খোচা দাঁড়ি, মাথায় টুপি নেই, গ্যাবাডিং প্যান্ট আর সুন্নত পরিপন্থি জামা গায়। এই হল ইমাম সাবের চেহারা।
ইদিলপুর গ্রামে বেড়াতে এসেছে হাসান। আশপাশে দুএকটি মসজিদ থাকলেও বাড়ির কাছে একটা মক্তবের মতো ঘর ওঠানো আছে তার ওখানে দু’চারজন জামায়াতে নামাজ আদায় করে। মাগরিবের ওয়াক্তে হাসানকে দেখে ইমামসাব পিছনে সরে এসে নামাজের ইমামতি দেয় হাসানকে। নামাজ শেষে পরিচয় হয় ইমাম সাবের সাথে। ইমাম সাব এই মক্তবঅলা বাড়ির ছেলে। গ্রামে বেশ প্রতিপত্তির সাথে বসবাস করে আসছে তারা। তাদের ভুল ধরবে অথবা তাদের সাথে পাল্লা দেবে এমন লোক নেই এখানে। এসব কথা ইমামসাব সরাসরি না বললেও তার কথাবার্তায় এরই প্রমাণ বহন করে।
এশার নামাজ বাদ দেখা হল ইমাম সাবের বাবার সাথে। সে এক মহাপণ্ডিত লোক। মুখভর্তি সাদা দাঁড়ি, লম্বা জুব্বা আর লুঙ্গি পরা ভদ্র লোককে দেখলে অন্তরে ভক্তি এসে যায়। আলাপে বারবার নিজের পণ্ডিতি জাহির করবার প্রয়াস দেখে মনে হল লোকটা স্ব-শিক্ষিত। অর্থাৎ ওস্তাদ ছাড়াই তিনি কামেল হতে আগ্রহী। তিনি হাসানের সাথে সুন্দর ব্যবহার করলেন। খুটিয়ে তার পরিচয় জানলেন। হাসান একজন কিতাবী আলেম জেনে খুব কদর করলেন। চেহারা-সুরত দেখে অল্প বয়সী আলেম এবং আমলী ছেলে স্বীকৃতি দিলেন।
হাসান অবশ্য এতসব আলগা প্রশংসায় ভুলে যাবার ছেলে নয়। সে বুঝে নিয়েছে মুরব্বি তাকে ফোলাচ্ছে। পরদিন ফজর নামাজ বাদ মুরব্বি হাসানকে চায়ের দাওয়াত দিলেন বাসায়। অকপটে হাসান তা কবুল করল। কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। বেশ বড় এরিয়া নিয়ে বাড়িটি। নানান ফলের গাছ লাগানো ফাঁকা ফাঁকা। অনেক গাছে ফল ধরে আছে। ঘরের সামনে হরেক প্রজাতির ফুলের গাছে রং বেরঙের ফুল ফুটে আছে। দেখলে যে কারো প্রাণ ভরে যাবে। মুরব্বির সাজানো বাড়িটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল হাসান। জিজ্ঞেস করল, আপনার নিজের পছন্দে সাজিয়েছেন সব? মুরব্বি হেসে জবাব দিলেন, জি জনাব। সবই আমার পরিশ্রমের ফসল। আমার চারটি ছেলে। একটাকেও মানুষ করতে পারলাম না। বড়টা বারবার চেষ্টা করেও দাখিল পরীক্ষায় ফেল। তার হাবভাব মনে হবে ‘মুফতিয়ে আজম’। ছোট ছেলেটা দেখেছেন আপনি। এই ছোট ছেলেটা একটু যা লেখাপড়া করেছে। লেখাপড়া তো বলা যায় না সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। ও এখনো পড়ছে। এই ছোট ছেলেটাকে জাতে ওঠাতে কত চেষ্টাই যে করে যাচ্ছি তোমাকে বললে তো আর অসুবিধা নেই তুমি অন্য গ্রামের ছেলে। এই দেখো-তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম।
হাসান লজ্জা পাবার ভঙ্গি নিয়ে হেসে ফেলল-কি যে বলেন চাচা আপনি আমার বাবার বয়সী মুরব্বি। আমাকে তুমি করে বলাটাই বেশি মানান হয়।


-বেশ বেশ শোন তবে। কার কাছেই বা বলব মনের কষ্টের কথা। এই ছোট ছেলেটাকে একটু জাতে ওঠাতে, সমাজে একটু স্থান করে দেবার জন্য সবার সামনে মাওলানা মাওলানা বলে ডাকি। বাড়ির সামনে একটু কোন রকম কাচারি ঘরের মতো উঠিয়ে ‘মক্তব’ নাম দিয়ে মসজিদ কায়েম করার চেষ্টা করছি শুধু ঐ বেত্তমিজ ছেলেটার জন্য। ওখানে তাকে ইমাম বানিয়েছি। এতে যদি আমল আখলাক ঠিক হয়, চেহারা সুরতে সত্যিকারের ইমাম সাব হয়। এসব করেও তাকে বাগে আনতে পারিনি। ওর যে চেহারা থাকে ওর পেছনে কেউ নামাজ পড়বে কেন? এলাকার কিছু গরু-গাধা মার্কা লোক ছাড়া এখানে কেউ নামাজ পড়তে আসে না।
ড্রয়িংরুমে চা-নাস্তা দিয়ে গেছে কে যেন। মুরব্বির সাথে সোফায় গিয়ে বসল হাসান। দুটি আলমারিতে ঠাসা সব ইসলামী বইপত্র। চা খেতে খেতে হাসান বলল মুরব্বিকে-চাচা আপনার ঐ মক্তব বা মসজিদকে আমলের জিকিরের খানকা বানালে মনে হয় ফল ভালো পাবেন। কোন হক্কানী পীরের মুরীদ হয়েছেন কখনো? হাসানের কথায় চোখ কুচকে তাকালেন মুরব্বি। বললেন, এ দেশে হক্কানী আলেম তেমন চোখে পড়ে না। প্রায়ই ভণ্ড। লোভ মানুষকে গ্রাস করেছে। তাছাড়া পীরের দরকার কী? কোনো পীরের চেয়ে আমরা কম জানি নাকি?
মুরব্বির কথা শুনে হাসান মনে মনে হাসলো। বলে কি পাগলে! মুরব্বির কথা শেষ হলে হাসান বলল, আসলে চাচা বিষয়টা অমন নয়। ধরেন কোন ছেলে যদি এমএ পাশ করতে চায় তাকে প্রথমে অবশ্যই শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হতে হবে। বছরের পর বছর ক্লাশ করতে হবে। আদব কায়দা শিখতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে, পাশ করতে হবে। এভাবে করে করে একদিন সে এমএ পাশ করবে। অর্থাৎ নিয়ম মেনে প্রতিটি ধাপ সে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হতে পারলে তবেই সফল হবে। নতুবা কোন কালেই সে এমএ পাশ করতে পারবে না। এভাবে প্রতিটি সফলতার পেছনেই কিছু নিয়ম কিছু ধাপ এবং কিছু সাধনার প্রয়োজন আছে। এগুলো অস্বীকার করে কখনো কামিয়াবি আশা করা যায় না।
হাসানের এমন বক্তব্যে মুরব্বির মাথা হেট হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে কথা গিলে যাচ্ছে।
হাসান বলে গেল, শুনুন চাচা যে সময় গত হয়েছে তা আর ফিরে আসবে না। এদেশে অনেক লোভী, অনেক প্রতারক থাকলেও অনেক হক্কানী আলেম পীর বুজুর্গ আছে। ছারছীনার দরবার, ফুলতলী দরবার সহ আরো অনেক দরবার আছে যারা এখনো শিরিক-বিদয়াত থেকে পরহেজ থেকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে সাহায্য করে যাচ্ছে। এসব কোন হক্কানী পীরের হাতে হাত রেখে নতুন করে আমলী জিন্দেগী গড়ার শপথ নিন। আপনার ছেলেদের নিয়ে নেমে পড়–ন। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি আপনার বে-আমলী ছেলে আদবের সাথে নিজেকে পরিবর্তন করে আল্লাহওয়ালা হয়ে যাবে। জ্ঞান আর আমলের সমন্বয় ঘটাতে না পারলে জীবনের কোন সার্থকতা নেই।
হাসানের বক্তব্য মুরব্বি চাচার অন্তরে বুলেটের মতো বিধে গেল। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মুরব্বি। যেন জিহাদের জজবায় শহীদ হতে চলেছেন তিনি। জড়িয়ে ধরলেন তিনি হাসানকে। ‘বাবা, তুমি আজ আমার চোখ খুলে দিলে। এই অন্ধ চোখে তুমি আলো এনে দিলে। আমাকে আজই নিয়ে চলো কোনা হক্কানী পীরের কাছে। আজই আমি সবক নেব।’ মুরব্বির কথায় হাসানের অন্তরও আনন্দে নেচে উঠল।

Comments

comments

About

Check Also

আতশবাজি

তারিফ, আরশ, শাবান, রাওকী সহ ওদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব স্কুল মাঠে একত্রিত হয়েছে। এখন বিকেল। রাত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *