রাবু-বিনু ও ঈদ

রাবেয়া! এই রাবু গেলি কই? সন্দার সোমায় একবার তালাশ কইররা গেলাম পাইলাম না। ও চাচি রাবু কই? রান্নাঘর থেকে বিরক্ত কণ্ঠে শোনা যায়-যাইবে আর ক্কোতায় দ্যাখ পোড়া কপালী মরছে কোতায় যাইয়া।
রাবেয়ার তালাশ পড়ে যায়। ঘরের মধ্যে কোথাও নেই। বাতি নিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে পাশের বাগানে। অনেকক্ষণ খোঁজখুঁজির পর আবিস্কার হয় রাবেয়া। ঝোপের আড়ালে মোটা দড়ি নিয়ে লুকিয়ে আছে সে। আরেকটু সময় পেলেই সব শেষ হয়ে যেতো। গাছের ডালে ঝুলে পড়ত সে। এবার নিয়ে এই তিনবার আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়েছে রাবু।
স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে সবার। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। শুধু বিনুকে জড়িয়ে ধরে একলা রাবেয়া কেঁদে উঠে হাউমাউ করে। তারপর আবার ঠিক আগের মতোই ঘরে ফিরায় তাকে।
আগামীকাল ঈদুল ফিতর। এখানের সমাজটা দারিদ্রপীড়নে মূহ্যমান হলেও ঈদকে ঘিরে সবার মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। দীর্ঘ মাস ধরে রোজা পালনের মধ্য দিয়ে এই আগ্রহের তৈরী। বিনু হাতের কাজ রেখে রাবেয়ার কাছে বসে থাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে নানা রকম কথা বলে দুঃখ ভোলাবার চেষ্টা করে। আগামীকাল ঈদ। লোকমুখে শোনা যায়, রমজানে দেশের অনেক নামিদামি তহবিল থেকে ত্রাণ এসেছে এখানে প্রচুর। তবে কানে শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় সবার। ত্রাণের খাদ্য অথবা কোন বস্ত্র সামগ্রী কারো হাতে এসে পৌঁছবার আগেই লা-পাত্তা হয়ে যায়।
রাবেয়ার বাবা জেলে। সমূদ্রে মাছ ধরে তার দিন কাটে। এখানে রয়েছে শুটকি পল্লী। মাছ ধরে শুটকি পল্লীতে বিক্রি করে যা আয় হয় তাতে সংসার চলে কোন রকম। বাড়তি আয়ের পথ নেই। জায়গাটা সমূদ্রের তীরে হবার কারণে বাতাসটা পরিশুদ্ধ। তবে সমাজপতিদের পেটে বেশী ক্ষুধা থাকার কারণে গরীবদের আর উন্নতি হয় না।
কাল ঈদ। এই পল্লীতে ছেলে মেয়ের সংখ্যা খুব বেশী। ওরা সন্ধ্যা থেকে হৈ হুল্লোড় করছে। সারা রাত ছেলেরা মাতামাতি করবে। রাবেয়া আর বিনুদের কানেও এসব আওয়াজ এসে লাগে। তবু ওদের কোন আনন্দ নেই। ওরা দু’জন এক সাথে বড় হয়েছে। একজন অন্যজন ছাড়া বাঁচেনা।
বিনু একের পর এক গল্প করেই যায়। বিনুর কথা রাবুর কানে লাগেনা। বারবার ভেসে ওঠে ওর মন জগতে সেই ভয়ংকর কালো রাতের কথা।
দুদিন হল রাবেয়ার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগে ছেলেটাকে মাত্র একবার একটি পলকের জন্য দেখেছে রাবু। আজ রাবেয়ার ফুল শয্যা। গরীবের ঘর হলেও ওর জীবনের এটাই সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত।
এদিকে সমূদ্রে পাঁচ নম্বর বিপদ সংকেত। পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে প্রলয়ংকারী ঝড় ‘মহাসেন’। ফুলশয্যার দিন ধার্য থাকাতে মুরব্বীরা আর পাল্টাতে দেয়নি। সমূদ্র পাড়ের লোক তারা। এসব ঝড়ের সাথে তাদের সখ্যতা না রাখলে চলে। প্রতি বছর এরকম কত ঝড় আসে আবার চলেও যায়। তাই অতশত চিন্তা করে মাথা ঘামায়নি কেউ।
গ্রীষ্মকাল বলে রাত ছোট। আনুসঙ্গিক কাজ ঘোচাতে রাত তিনটা বেজে যায়। বাসর ঘরে রাবেয়া অপেক্ষারত। সন্ধ্যার পরে হালকা বৃষ্টি থাকলেও ঝড় তেমন ছিল না। রাত গভীর হবার সাথে ঝড়ও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অবশেষে সকল প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে বর আসে বাসর ঘরে। রাবেয়া খাট থেকে নেমে স্বামীকে প্রথম কদমবুসি করে। তারপর জায়নামাজ বিছিয়ে দেয় দুটি। দু’রাকাত শুকরিয়া নামাজ আদায় করে দু’জনে। খোদার দরবারে আগামী দাম্পত্য জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে মোনাজাত করে। এরি মধ্যে শুরু হয় ঝড়ের তাণ্ডব। মুহূর্তে ঘরের চালা উড়িয়ে নেয়। জায়নামাজ গুছাবার সময় পায়না রাবেয়া। স্বামীকে সাথে করে ঘর ছেড়ে বেরোয়। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো ছুটতে থাকে সাইক্লোন শেল্টারের দিকে। প্রচণ্ড বাতাসে যেন উড়িয়ে নেবে ওদের। মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকায়। হঠাৎ পিছন ফিরে দেখে ধেয়ে আসছে পানি। বাঁধ ভেঙে গেছে। এখনি গ্রাস করবে নতুন বউ-জামাইকে। রাবেয়া দিশেহারা হয়। আর সময় দেয় না বানের পানি। ভাসিয়ে নেয় দু’জনকে।
রাবেয়ার জ্ঞান ছিল না। কারা তাকে উদ্ধার করে জানে না সে। সাইক্লোন শেল্টার থেকে হাসপাতালে। তারপর ভাঙা ঘরে। বন্যা বেশী সময় স্থায়ী ছিল না। একে একে পাড়ার সবাই ফিরে এসেছে। আসেনি কেবল রাবেয়ার স্বামী। শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা তার কোন সন্ধান দিতে পারেনি। বানের পানিতে কোথায় নিয়ে গেছে তার হদিস মেলেনি আজো।
সেই থেকে রাবেয়া জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলেছে। যে যতো শান্ত্বনা দেয় সব শান্ত্বনা বিফলে যায়। বারবার সে আত্মহত্যার পথ খোঁজে। বিনু তাকে বোঝায়, আত্মহত্যা কোন মুক্তির পথ নয়। আল্লার কাছে বল। সে যদি চায় তোর জীবন আবার সুন্দর করে দিতে পারে। আগামীকাল ঈদ। আমার হাতে হাত রেখে শপথ নে, আর কখনো এমন কাজ করবি না।
বিনুর কথায় বিগলিত হয় রাবেয়া। তার জীবনে যে অন্ধকার নেমে এসেছে সেই অন্ধকার দূরে ঠেলে আলোর পথ বেছে নেয়ার শপথ নিতে শক্ত করে ধরে বিনুর হাত।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *