মৌমাছি

এই গ্রিষ্মের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি, বেড়াবার জন্য। বাড়িতে আসলে সাধারনত যা হয়। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, পাখির বাসা খোঁজা, ঢিল ছুড়ে মৌমাছির তাড়া খাওয়া, কিছু করার না থাকলেও রাস্তায় থাকা।
রাস্তার পাশে গাছে ঘেরা বাগানের মধ্য একটা বড় গাছে বাসা বেঁধেছে মৌমাছিরা। আমরা যেই সময় যাই, একটা ঢিল ছুড়ে যাই। তা না পারলেও তীক্ষè একটা চাহনি দিয়ে যাই। ঢিল ছুড়লেই পিছন পিছন অনেক তাড়া করে, কিন্তু কোন আক্রমন করতে পারে না। দেখতাম হাজার হাজার মৌমাছি মিলে ঘিরে থাকে বাসাটিকে। কারও হিংসা বিদ্বেষ নাই। সবাই কাজ করে মিলে মিশে। এক দল আসে আরেক দল ছুটে যায় মধু আহরনে। প্রতিটা ফুল খুঁজে খুঁজে বিন্দু বিন্দু জমা করতে করতে সেরে সেরে জমা করে মধু। ওদের প্রত্যেককে আমরা পাঁচ বন্ধু চিনি। ওদের জীবনটা কেড়ে নেওয়া আমাদের দুষ্টমি। যখন তিল গাছের ফুলে ঢুকত, ফুলের এমাথা চেপে ধরে মেরে আমাদের তাড়ানোর স্বাদটা শুধরে নিতাম। এভাবে ওদের আর আমাদের মাঝে গড়ে উঠে ভয়ানক শত্রুতা।
আমাদের ব্যতিত পথিককে জিজ্ঞাসা করে অনেক কলাকৌশল। কোথায় যাচ্ছেন, বোঝা নিতে কষ্ট হচ্ছে? আমাদের সবার যদি বয়ে নিবার সাধ্য থাকত, তবে তা বয়ে নিতাম। আর আমাদের বিশেষত পাঁচ জনকে দেখলে আর চোখে তাকিয়ে থাকে, ঢিল ছুঁড়লেই তাড়াবে। এমনি করে ঘোর থেকে ঘোরতর হয় শত্রুতা। আমরা যুদ্ধ করতে আসি প্রত্যহ দুপুরে। একার লড়ার সাহস নাই। তাই ওদের সাথে থেকে মাঝে মাঝে ঢিল ছুড়ি। কিন্তু ওরা ঢিল ছুুড়া ব্যতিত আমাদের আক্রমন করে না। ওরা চালাচ্ছে ওদের সর্বাত্বক চেষ্টা। অনেক ফিরে আসে না, মারা পড়ে, সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। প্রাণ বিসর্জন দিয়েও মধু সংগ্রহ করতে দ্বিধা করে না।
একদিন তিলের ফুলে মধু সংগ্রহ করতে ঢুকে পড়েছে একটা মৌমাছি। আমিও সাথে সাথে চেপে ধরেছি ফুলের মাথা। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। বন্ধু দুটো ঢিল দিয়ে চাপা দেওয়ার পূর্বে ফুলটি ছিড়ে এলো হাতে। আর অপর মাথা দিয়ে বেরিয়ে গেল মৌমাছিটা। ভেবেছি এই মৃত্যুর ভয়ে উড়ে যাবে বাসায়। কিন্তু না, একটু দূরে তিলের ফুলে ঢুকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। আমি দেখলেও বন্ধুকে বললাম না, ভাবলাম থাক ও বেঁচে থাক।

একদিন রাতে বাড়ি ফিরছি দ্রুত পদে। কেমন ভয় ভয় করছে। কিন্তু ওরা আমাকে না চিনতে পেরে গুণ গুণ করে বলছে। এখানে আমরা আছি ভয় নাই। এবার আমি আরও বেশি ভয় পেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। কারণ আমাকে চিনতে পারলে আর রক্ষা পাবনা এ যাত্রায়। কিন্তু ওরা বলে উঠল, আমরা চিনতে পারছি তোমাকে, তুমি আমাদের শত্রু। তবুও আমরা আক্রমণ করব না। কারণ আমাদের কেউ আক্রমণ না করলে, তাকে তাড়াই না। তোমার ভয় নাই। আক্রমণ করতে আসতে চেয়েছিল অনেকটি ভয়ংকর জানোয়ার। কিন্তু সামনে আসল না, কারণ অনুরোধের সুরে বারণ করছিল মৌমাছিরা। তবে বলাবলি চলছে। তোমরা এখন আক্রমণ করলে ওর বন্ধুরা ভাববে, আমরা তোমাদের ক্ষেপিয়ে দিছি। এতে আমাদের বদনাম, থাকে না আমাদের সম্মান। তোমাদের বন্ধু হয়ে বলছি আজকে রাত্রের জন্য ওকে ছেড়ে দাও। ওদের এ সব কথা শুনে আমার ভরসা হল। কোন ক্ষতি করবে না আজকের রাত্রে। তাই নিশ্চিন্তে প্রত্যাবর্তন করতেছি বাড়িতে। কিছু দূর এসে পিছন চেয়ে দেখি, আমার পিছনে এসেছে একটি মৌমাছির দল। বললাম কি রে প্রতিশোধ নিবি, তো আজকে তোদের ক্ষোভ পূরণ কর মন মত। গুন গুন করে বলল, না। তোমার ভয় ভয় করছে, তাই আসলাম এগিয়ে দিতে। আমি মনে মনে ভাবলাম করতে আসছে বন্ধুত। তাই বলে উঠলাম, আস বন্ধুকে পৌছাতে সাহায্য কর। এখন পথ চলা ও কিছু কথা বলা। বার বার অনুরোধের সুরে বলছে, বন্ধু তোমরা তো ঢিল ছুঁড়ে পাও আনন্দ, আর আমাদের তো চলে যায় জীবন। আমাদেরও আছে বাঁচার অধিকার। আর করো না আমাদের আক্রমণ। মধু সংগ্রহ করি তো তোমাদের জন্যই। তবুও কেন কর আক্রমণ। আজ আমরা প্রতিশোধ নিলে, আমাদের শক্তি সামর্থ দিয়ে তোমাকে খতম করে দিতে পারি। কিন্তু তা করি নি, তবুও হাতে পায়ে ধরে বলছি, তোমরা আমাদের আর করো না আক্রমণ। তোমাদের সাথে গড়ে উঠুক বন্ধুত্ব। আরও অনেক কথা বলতে বলতে পৌছে গেলাম বাড়িতে। উঠানে পৌছতেই বলল, আমরা যাই।
না, ভিতরে আস। আজ তোমাদের আপ্যায়ন করাব অতিথি হিসাবে।
না অন্য একদিন বলে উড়ে গেল ওরা। আমি ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ওদের নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমের জগতে প্রবেশ করে স্বপ্নে ওদেরকে বললাম আর করবনা তোমদের আক্রমণ।
পরবর্তী দিন বন্ধুদের পাল্লায় পরে, সেই বাগানে আবার ঢিল ছুঁড়লাম, হে মৌমাছি শত্রুরা, তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ। ওরা বলল দেখ কে বুঝবে হালচাল। কালকে বন্ধু হয়ে নিমন্ত্রণ করল, আর আজকে শত্রু হয়ে ঘোষণা করছে যুদ্ধ। বলছে আর আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে।
আমি ভয় পেয়ে যাই। আজকে ওদের না তাড়ালেও আমাকে ছাড়া ছাড়ি নাই। তাই কাজের কথা বলে, বন্ধুদের ও মৌমাছিদের কাছ থেকে নিলাম বিদায়। আমাকে যেতে দেখে বলল, বেঁচে গেছো বাছা বেঁচে গেছো। থাকলে আজকে খবর বারোটা বাজিয়ে দিতাম। বুঝে নিতা, কত ধানে কত চাল।
পরবর্তীতে বন্ধুরা এসে জানাল যে আজকে ভেংগে দিয়েছি বাসাটার এক ডালি। হয়েছে বেশ আনন্দ এবং তাড়িয়েছে অনেক দূর।
আমি অনুমান করলাম, ওদের কালকে আক্রমন করলে ওরা স্থানান্তর হয়ে চলে যাবে অন্যত্র।
তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা কিছু দিন আক্রমন করব না যুদ্ধ থেকে থাকব বিরতি। এরপর অনেক দিন আক্রমন করি নি। কথার মর্যাদা কেউ লঙ্গন করে নি। মাঝে মাঝে দেখে আসি ও বলে আসি বাসা ঠিক কর, আবার পুনরায় শুরু করব শত্রুতা।
ঐদিকে কিন্তু বসে নাই মৌমাছিরা ওরা ওদের সর্বাত্ত্বক চেষ্টার পাশাপাশি । ভিমরুলকে পাশাপাশি থাকতে আপ্রাণ অনুরোধ করল। কিন্তু ওরা আপত্তি করল, গুরুতর আপত্তি। আমাদের বিপদ আসলে তোমরা কোন মতেই বসে থাকতে পারবেনা। আরও অনেক শর্ত মেনে বন্ধুত্ব রূপে খুব কাছাকাছি গাছের মাঝে বরাবর বাস করে দুই পরিবার। আমাদের শত্রুতার কোন আনাগোনা নাই। আমাদের প্রায়ই ভুলে গেছে মৌমাছিরা। দুই পরিবারের সদস্যরা নির্বিকার চিত্তে যার যার কাজ সে সে করে। পরিবারের সদস্যদের জন্য যেমনি মায়া, দুই পরিবারেরও তেমনি মায়া। অতএব কষ্ট অসহ্য বলতে কিছু নাই। সবই যে আনন্দ, এদিকে আমাদের আনন্দ উপবাস, না পেয়ে প্রবল আকর্ষণ হয়েছে ঐ বাসার উপরে। মৌমাছি যত আমাদের ভুলেছে। ততই বেড়েছে আমাদের আকর্ষণ।
দুপুরে ধীরে ধীরে বড় শক্ত ঢিলা নিয়ে এগুচ্ছি, সবাইকে বলে দিলাম, হামলা করতে হবে এক যোগে।
নইলে পরে ঢিল ছুড়ার চান্স থাকে না। দেখলাম আমাদের দেখে ওরাও তাড়াবার জন্য রেডি প্রথমে। কিছু কলাকৌশাল জিজ্ঞেস করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আজকে শুধু মৌমাছির বাসা উদ্দেশ্য করে এসেছি। কিন্তু পাশের গাছে ফ্যাকাসে রঙ্গের বাসাটা আসে নি আমাদের নজরে। তাহলে হয়তো সাবধান হতাম।
অনেক কলাকৌশাল করে তাড়া দিতেই দৌঁড়াবার প্রস্তুতি নিয়ে রেডি অন টু থ্রি বলা হয়েছে, গো বললেই ঢিল ছুড়ে দৌড়ে পালাব। গো বলা হল আমরাও ছুড়লাম ঢিল। তার থেকে মাত্র একটা মৌমাছির বাসায় ও একটা ফ্যাকাসে রং এর বাসায় ঢিল পড়ে, দুটো বাসা পণ্ড হয়ে গেল।
কিছু ভাবতে পারলাম না। সময়ও পেলাম না। দুই পরিবারের সদস্যরা চারপাশে হাজির, কি করছিল কেমন করছিল কেমনে ধরছিল জানি না। আমি বিষের যন্ত্রণার কারণে গড়াগড়ি খাচ্ছি। ওরা কেন শুয়ে গুজো দিয়ে ছটফট করছে জানি না। হঠাৎ দেখতে পেলাম, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খাল, প্রাণ পনে চেষ্টা করে ডুব দিলাম। কিন্তু তবুও পেলাম না নিস্তার, তবে হয়েছে কিছুটা উপশম। বন্ধুরা পালিয়ে গেছে না গড়াগড়ি করছে, না ধরফড় করছে জানি না। ডুব দিয়ে হায়রে কত কষ্ট করে, কয়েক টাকে পিশে মেরে কত অনুনয় বিনয় করে, অনেক দূরে গিয়ে উঠে শুয়ে পড়লাম। অমনি হাত পা থরথর করে কাঁপন্ত অবস্থায় চক্ষু বুজে আসল। প্রবেশ করলাম ঘুম বা অন্য কোন জগতে। ঘুম থেকে উঠে দেখি হাসপাতাল। জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে ক্যা রে। এখানে কেমন করে এলাম? গায়ে ট্যাম ট্যাম করে গা বিষ করছে কেনরে ওরে উহহু রে যন্ত্রনা, যন্ত্রণায় আর থাকা যাচ্ছে না। পাশ থেকে বলে উঠল এই চুপ কর। তুই বেঁচে আছিস শুনলেও লোকজন এসে মেরে দিবে।
কেন? কেন? আমি কি করলাম!
ডাক্তার এসে দিল একটা সুঁচ। অমনি দুচোখ জুড়ে গভীর ঘুম আর ঘুম।
পরে শুনতে পেলাম সেইদিন ওরা রাস্তায় ১৪৪ ধারা হরতাল দিছে। যেই ভংগ করেছে তাকেই করেছে একদম শায়েস্তা।
ওদের কী অবস্থা?
ওরা কারা?
একে একে ভেসে উঠতেছে সব স্মৃতি। মনে পড়তেছে বন্ধুদের গড়াগড়ি। একটু নজর করতেই দেখেতে পেলাম যুদ্ধ করতে ওরা কয়েকটা মারা পড়ছে। জামাটার সাথে পিশে আছে। চিকিৎসা দেয়া হল। অনেক সুস্থতা এল। বাড়িতে বিশ্রাম করতে বলা হল। আমার অসুস্থতা শুনে বন্ধুরা আসলেও ঐ বন্ধুরা আসল না। ওদের কথা জিজ্ঞাসা করলে, কেউ কিছু বলে না। অনেকের অনেক হুমকি পেলাম। আরে সুস্থ হোক না পুরো হিসাবটা তুলে নিব। মনে হচ্ছে গ্রামে ঢুকলেই……..কী হবে জানি না। এদিকে গ্রীষ্মের ছুটিও শেষ।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *