সমাজবিজ্ঞানী বদরুল মাহমুদ এবং মৌলভী শিক্ষক আহমেদ জুবায়েরের মধ্যে মাঝেমাঝে বেশ উপভোগ্য বাকযুদ্ধ হয়ে থাকে। সেই যুদ্ধ যেকোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও হতে পারে। আসলে এই দুই শিক্ষক বেশ রসিক ও প্রাণখোলা স্বভাবী। যেদিন বাকযুদ্ধের কোনো ইস্যু থাকে না সেদিন অন্যান্য সহকর্মী শিক্ষকবৃন্দ ‘কি যেন নেই, কি যেন নেই’ এমন একটা শূন্যতা অনুভব করেন। তাই কখনো কখনো বদরুল মাহমুদ স্যার এবং আহমেদ জুবায়ের হুজুরকে বাকযুদ্ধের মাঠে ঠেলে দিতে কোনো না কোনো উসকানো প্রসঙ্গ টেনে আনেন মাওলানা আমীন। এতে দেখা যায় একটি চর্বিতচর্বণ গল্প বারবার ফিরে আসে অফিস কক্ষে। দুপুরে টিফিনের পর ক্লাস শুরুর সামান্য সময় যখন অবশিষ্ট থাকে তখন ‘লবণের প্যাকেটে চিনি’ রাখার সেই বিখ্যাত গল্পটি সবাই একবার স্মরণ করাটা যেন নিত্য দিনের কাজ।
বদরুল মাহমুদ স্যার যখন দাবী করেন এই গল্পটি তার বন্ধু আহমেদ জুবায়েরের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনা তখন আহমেদ জুবায়ের তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। তীব্র প্রতিবাদ করে বলতে থাকেন- ‘এটা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো বাস্তব ঘটনা নয়। এটা আমার বলা একটি কৌতুক মাত্র।’ কিন্তু তার এই কঠোর প্রতিবাদ শুনার মতো ধৈর্য যেন কারো আর হয় না। সবাই যেন এই প্রথম শুনেছেন এমন ভঙ্গিতে একবাক্যে সমস্বরে হাসতে হাসতে ঢলতে ঢলতে বলতে থাকেন- ‘তাই নাকি জুবায়ের সাহেব! দারুণ-তো আপনার জীবনের ঘটনা! অসাধারণ, অ-সা-ধা-র-ণ!’। এদিকে আড়ালে মুখটিপে হাসেন বদরুল মাহমুদ স্যার। আহমেদ জুবায়ের আবার বলেন- ‘এই কৌতুকের সাথে আমি আরেকটি কৌতুক বলেছিলাম, সেটি না বলে শুধু এই চিনি ও লবণের কৌতুক বলার মানে কি বুঝি না।’
এই সুযোগই বদরুল স্যার খুজছিলেন। তাই ফোকর পেয়ে দেরি না করেই তিনি বলেন- ‘কোন কৌতুকের কথা বলছো বন্ধু? দেখি আজ আবার সেটা বলোতো।’ একটু আশ্বস্তের আশায় প্রায় নিরুপায় হয়ে কৌতুকটি আবার বলতে শুরু করেন জুবায়ের সাহেব। তিনি বলতে থাকেন- ‘একদিন স্কুলে এক পরিদর্শক এসে ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলতো- সবচেয়ে চালাক প্রাণী কোনটি?’ ঝন্টু ঝট করে উত্তর দিলো- ‘গরু স্যার’
পরিদর্শক আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘সেটা কিভাবে?’
ঝন্টু বললো- ‘ঐ যে বলা হয়, অতি চালাকের গলায় দড়ি। গরুর গলায় সবসময় দড়ি থাকে স্যার, তাই-তো সে চালাক প্রাণী। ‘কৌতুকটি আবার শুনালেও চিনি-লবণের গল্পকে ঢাকতে বা ভুলাতে পারলেন না আহমেদ জুবায়ের। সবাই হু-হু হি-হি করে হেসে উঠে বদরুল মাহমুদ স্যারকে সাধতে থাকেন সেই গল্পটি বলতে।
আহমেদ জুবায়ের সাহেবের মূল গল্পটি বদরুল মাহমুদ স্যারের কাছে শুনলে বেশ আকর্ষণীয় হয়। তিনি কথার মাঝে আলপনা আঁকতে বেশ জাত শিল্পীর নৈপুণ্য দেখান। তাই সবার অনুরোধ তার দিকেই বরাবর থাকে। সুতরাং স্যারের ভাষ্যেই এবার শুনা যাক গল্পটি।
খরচের তালিকায় চিনি লিখতে ভুলে গেছেন বন্ধু জুবায়েরের স্ত্রী। বাড়িতে খরচ আসার অনেক পর হঠাৎ স্ত্রীর মনে চিনির কথা উদয় হলো। সকালের নাস্তায় চিনি নেই এই অজুহাতে চা দিতে না পারলে শ্বশুর শাশুড়ি বেশ বকাঝকা করবেন। উপায় না দেখে স্বামীকে কথাটি বলতেই তিনি ভালোবাসার মানুষটির কথা ফেলতে পারলেন না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা তখন। আষাঢ়মাসের রাত। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘেরডাক ও কারেন্টবিহীন বিদঘুটে অন্ধকার পথ। বাজারে দোকান খোলা পাবে কি-না এই সংশয় নিয়ে আরামের বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। নিজের লেডী ছাতা রেখে পিতার পুরুষালি মজবুত হাতল ও শক্ত শিখের ছাতাটি হাতে নিলেন। বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।
বাজারে একটিও দোকান খোলা নেই। মোড়ের এক দোকানী রাতেও দোকানে থাকেন। বিছানা প্রস্তুত করে পেশাব করতে বাইরে আসায় বন্ধু জুবায়ের দোকানীকে পেয়ে গেলেন। তাকে চিনির কথা বললে সে এখন বেচতে অস্বীকৃতি জানালো। অনেক মিনতির পর যখন রাজি হলো তখন ‘লবণ’ লেখা এক বস্তা থেকে চিনি মেপে প্যাকেট করতে লাগলেন দোকানী। আমার বন্ধু বললেন- এ বস্তায় দেখছি লবণ লেখা! আমি-তো চিনি নিতে চাই।’ দোকানি টুকটুকে লাল ফোকলা দাঁত বের করে হেসে হেসে বললো- ‘আসলে পিপঁড়ার খুব উপদ্রব বেড়েছে, চিনি নিরাপদে রাখা বেশ মুশকিল। তাই লবণ লেখা বস্তাতেই চিনি রেখেছি, যাতে পিপঁড়ার দল লবণ লেখা দেখে বস্তায় না ঢুকে।’ কথা না বাড়িয়ে চিনি নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন আমার বন্ধু।
ভোরে শ্বশুর শাশুড়ির রোমে চা দিয়ে এলেন তার স্ত্রী। এতো কষ্ট স্বীকার করে ঝড়তুফানের ভয় উপেক্ষা করে বাজার থেকে চিনি এনে দেয়ায় আমার বন্ধুর প্রতি তার স্ত্রীর মহব্বত একটু বেড়েছে বলে তিনি ভাবলেন। ভাবার কারণও আছে। রাতে চিনি আনার পর তার স্ত্রী বলেছেন- ‘তুমি আমাকে রক্ষা করলে। মনে হচ্ছে বুক থেকে বিশাল একখণ্ড পাথর নেমেছে। ভাগ্যিস তুমি বাড়িতে ছিলে। তা না হলে সকালে আব্বা আম্মা খুব বকাঝকা করতেন।’ আমার বন্ধু মুচকি হেসে বললেন- ‘কি যে বলো তুমি, এ আবার একটা কাজ হলো নাকি! তুমি বললে আকাশের চাঁদও এনে দিতে পারি। সমুদ্রে ঝাপ দিতে পারি।’
লবণ লেখা বস্তা থেকে চিনি এনে ভেতরে ভেতরে আমার বন্ধু বেশ সংশয়ের মধ্যেই ছিলেন। হাসাহাসি করার ভয়ে তিনি স্ত্রীর কাছে ঘটনাটি বললেন না। কিন্তু সকালে ঘটলো বিপত্তি। চা মুখে দিয়ে সবার চোখ চড়কগাছ। সবাই চেঁচাতে চেঁচাতে তার রুমে হাজির। তার ছোটবোন বলেই ফেললো- ‘ভাবী, মনে হয় রাত জেগে মাথাটা খারাপ করে ফেলেছো! চিনির বদলে চা’য়ে লবণ দেয়া মাথা খারাপের লক্ষণ-ই-তো।’ শাশুড়ি বললেন- ‘বৌমার শরীর কি খারাপ? এমন উল্টাপাল্টা কাজ কোনো দিন-তো করোনি!’ শ্বশুর বললেন-‘কইরে জুবায়ের, বউমাকে ডাক্তার দেখাচ্ছিস না কেন? অসুখ বেড়ে গেলে পরে সহজে কী রোগ সারানো যায়!’ বন্ধুর স্ত্রী কাকে কি বলে উত্তর দেবে ভেবে পায় না। সে বিস্ফোরিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আর আমার বন্ধু পিপড়াকে ধোকা দিতে লবণ লেখা বস্তায় চিনি রাখা-যে বাস্তবিক-ই যুক্তিসংগত নয় এটা জোর করে মনকে বুঝাতে থাকেন। আর একটু পর স্ত্রীর দেয়া শাস্তি থেকে কিভাবে নিস্তার পেতে পারেন তা ভাবতে ভাবতে লবণ দেয়া তেতো চায়ের কাপ কখন-যে পান করে শেষ করে ফেলেছেন তা বুঝতেই পারেননি।
Check Also
বিদায়বেলা
জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …