নামাজ এবং তুমি

মানুষটাকে আমি প্রায়ই বলি, এই,শুনো না…নামাজ টা তো ঠিক মতো পড়…! মৃত্যু কার দুয়ারে কখন এসে যায় তা তো বলা যায় না…!
আমার মুখে এই মৃত্যুর কথা শুনে মানুষটা মন খারাপ করে ফেলে। বলে যে, দিলা তো মন টা খারাপ বানিয়ে…! আচ্ছা,তুমি এত মৃত্যু মৃত্যু কর কেন? আমি মরে গেলে বুঝি খুশি হবে খুব…?
তার এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। এটা কেমন কথা…? তার মৃত্যুতে আমি খুশি হব এটা সে বলতে পারলো? ইশ,তার মনটা কি সত্যিই খারাপ করে দিলাম…? কিন্তু আমি কখনোই চাই না যে আমার জন্য তার কখনো বিন্দুমাত্র মন খারাপ হোক। তাই তাকে আর সেদিন এটা নিয়ে বেশি ঘাটালাম না।
ভাবলাম,আজ যেভাবে কথাটা বলেছি সেভাবে হয়তো বলা ঠিক হয় নি। তাই আকস্মিক মৃত্যুর কথাটা একটু অন্যভাবে ওকে মনে করিয়ে দিতে হবে। দুই-তিনদিন পর তার ইনবক্সে দুই-তিনটা ৮-১০ মিনিটের ছোট ছোট মোটিভেশনাল ইসলামিক ভিডিও সেন্ড করে বললাম, যখন একদম ফ্রি থাকবা ভিডিও গুলা খুব মনোযোগ দিয়ে জাস্ট একটাবার দেখো প্লিজ। জাস্ট একটাবার…! খুব মনোযোগ দিয়ে। হুম…?
আমাকে এত অনুনয় করতে দেখে সে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে যে,সে দেখবে..। খুব খুশি হই আমি তার কথা শুনে। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস,ভিডিও গুলা একবার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে মরণের ভয় একটু হলেও আসবে মনে। আখিরাত নিয়ে একটু হলেও চিন্তা করা শুরু করবে সে। অন্তত নামাজ টা নিয়মিত পড়তে ইচ্ছে করবেই ওর এবং পড়বেও ইন-শা-আল্লাহ।
কিন্তু আমার সব আশায় গুড়ে বালি…! তার সবকিছুর সময় হয়। শুধু আমার সাজেস্ট করা অই ছোট্ট ছোট্ট ভিডিও দেখারই সময় হয় না…! কোনোভাবেই সে অই ভিডিও গুলা দেখার সময় বের করতে পারে না, কোনোভাবেই না…!
একদিন, দুদিন, তিনদিন তারপর তিনমাস তাকে আমি জিজ্ঞেস করি…জিজ্ঞেস করতেই থাকি, করতেই থাকি, দেখছিলা ভিডিও গুলা? দেখছিলা?
বরাবরই প্রায় একই উত্তর আসে, ‘নাহ…দেখি নাই সময় পাই নাই।’
‘উফফ সুমু আমি কত ব্যস্ত থাকি জানো তুমি ?’
‘ইশ, সরি সুমু মনেই ছিল না। যাও, এরপর সময় বের করে দেখবই আমি।’
সত্যিই তার সেই সময় আর আসে না। আমিও হতাশ হয়ে ভিডিও দেখার কথা বলা বাদ দেই। একটা মানুষকে ঠিক কতবার একটা জিনিস নিয়েই তাগাদা দেয়া যায়? ঠিক কতবার? আর জোর করে কি কিছু করানো যায় কাউকে?
কিন্তু আমার মন যে সত্যিই মানে না। যে মানুষটাকে আমি এত ভালোবাসি তার নামাজের প্রতি এত উদাসীনতা মেনে নিতে ইচ্ছে যে মোটেও করে না! আমি হাল ছেড়ে দিতে চেয়েও ছেড়ে দিতে পারি না। আমাকে আরো হাজার বার চেষ্টা করতেই হবে করতেই হবে,করতেই হবে।
কোনো এক জৈষ্ঠ্যমাসের প্রচণ্ড গরমের রাতে সে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফেরার পর আমি খুব যতœ করে একগ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত তার দিকে এগিয়ে দেই। খুব যতœ করে রাতের খাবার খাওয়াই। তারপর বারান্দার ফ্লোরে একটা মাদুর পেতে অনেক দিন পর ওর গা ঘেঁষে বসি আমি। বাইরে ঘন অন্ধকার, মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। আমি তাকে আমার কোলে শুইয়ে দিয়ে তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছি। সেই সাথে হাজারো রকমের গল্প…! কথায় কথায় গল্পের কোনো এক ফাকে সেই প্রসঙ্গ আবার এসে যায়। আমি তাকে বলি, দেখেছ? তোমার ক্লাসমেট আরিফ ভাইয়া কিভাবে বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেলো…? সে কি ২ মিনিট আগেও ভেবেছিল যে ২ মিনিট পর আমি মারা যাবো…?’
সে আমার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে যায়। আমার সাথে তাল মিলিয়ে বললো, হুম…সেইটাই। মৃত্যু কখন কিভাবে এসে যায় বলা যায় না। ওকে খুব মিস করি জানো? কত্ত মজা করতাম ওর সাথে…! কত্ত মেমোরি আছে ওর সাথে আমার…!
তার কথা শুনে আমি তার দৃষ্টি লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতাম। আবারো বললাম যে, হ্যা….তারপর আমার রিতু আপুর কথাই ভাবো। ২০ বছরের সুস্থ একটা মেয়ে…বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমালো। অথচ আর উঠার নাম নেই। চিরনিদ্রায় চলে গেলো একবারে…!
সে এবারো গম্ভীর হয়ে বললো, হ্যা…সত্যিই খুবই খারাপ লাগে এদের কথা ভাবলে।
-জানো তো..? ওরা খুবই দুনিয়াবি মানুষ ছিল..! ঠিক তোমার মত। দুনিয়া নিয়েই মেতে থাকতো। পরকালের জন্য কোনো সঞ্চয় ছিল না ওদের। ওরাও তোমার মতো ভাবতো যে,আস্তে ধীরেই পরকালের জন্য সঞ্চয় করা শুরু করবো। কিন্তু সেই সুযোগ আর হলই না ওদের…!


আমার কথা শুনে ফট করে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলো। আমি আবারো বলতে শুরু করলাম, তোমাকে কত করে বলি….অন্তত ৫ ওয়াক্ত নামাজ টা নিয়মিত পড়। কিন্তু শত শত দুনিয়াবি কাজের ভীড়ে নামাজ পড়ার সময়ও পাও না তুমি। অথচ নামাজ তোমার উপর ফরজ। আর নামাজ না পড়লে মানুষ কাফের হয়ে যায় কথাটা সহিহ হাদিস দ্বারাই প্রমানিত। তারপর,কাফের অবস্থায় মরে যাওয়া মানেই সরাসরি জাহান্নাম…!! ভাবতে পারো…? ভাবতে পারো তুমি…?
সে আমার দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে মৃদু ধমকের সুরে বলল, সুমু…!
আমি সেইটাকে উপেক্ষা করে বললাম, আচ্ছা,২ মিনিট পরও যে তুমি জীবিত থাকবে তার গ্যারান্টি কি? তোমাকে নামাজ শুরু করতে বললে আজ না কাল,কাল না পরশু এভাবে আমাকে এড়িতে যেতে থাকো। একটুও মরণের ভয় হয় না তোমার…? নাকি আল্লাহ তোমার কানে কানে এসে বলে গেছেন যে,এখনই তুমি মারা যাবে না…?
সে এবার একটু রেগে গিয়েই বলল, দিলা তো মুড টা অফ করে..!! আসলে তুমি…! তুমি সবসময়ই আমার মৃত্যু কামনা কর…! ধেত, থাকো তুমি…আমি গেলাম। ভাল্লাগতাছে না..!
সে চলে যায়। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। এভাবে একবার,দুইবার,দু’শ বার,দু’হাজার বার আমি তাকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করি যে,মৃত্যু খুব কাছে…..খুউউউউব….!! অন্তত নামাজ টা নিয়মিত পড়া শুরু কর। একটানা কষ্ট করে ১৫-২০ দিন নিয়মিত নামাজ পড়লেই তো নামাজের অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন নামাজ বাদ দিতেই কষ্ট লাগবে। মৃত্যু যে খুব কাছে…! মরতে তো হবেই। তাহলে অন্তত মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মরো। নামাজ না পরে মারা গেলে তো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মরতে হবে….!
সে বুঝে নাহ….সে আমার কথার উল্টো বুঝে!
হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় সূরা কাসাসের সেই ৫৬ নাম্বার আয়াতটা। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে ইচ্ছে করলেই হেদায়েত করতে পারবে না। তবে,আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করে থাকেন। এবং তিনিই হেদায়েতপ্রাপ্ত লোকদের সম্পর্কে ভালো জানেন।
আমি বুঝতে পারি যে দুয়া’ই এখন সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মানুষের সব চেষ্টা যেখানে শেষ দুয়া’র কেরামতি সেখান থেকে শুরু। আমি তার হেদায়েতের জন্য দুয়া করতে থাকি।
ইশ…! আর কত…? আর কত বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকবে তুমি..? শত ব্যস্ততার মাঝে অন্তত চার রাকাত ফরজ টা আদায় করারও সময় কি হয় না তোমার…? তোমাকে তোমার মরণের কথা মনে করিয়ে দিলে কেনই বা তোমার মুড খারাপ হয়ে যায়…? অথচ, মৃত্যুই যে সবচেয়ে বড় সত্যি। বুঝো না…?
হ্যা, সে নিজেও জানে যে,মৃত্যু খুব কাছে। তবুও মানতে চায় না…! কিছুতেই মানতে চায় না…!
ইশ….! যদি একবার মানতো…! এই একটাবার…!

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *