সম্পর্ক সমাধি

‘ধর্মীয় রীতিতে সম্পর্ক জোড়ে দিলেই তা পরিপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায় না। সম্পর্ক গড়ে নিতে হয়। ঠিক একটি চারাগাছকে যেভাবে বড় বা গড়ে তুলতে হয়। পানি দিয়ে, সার দিয়ে, আগাছা পরিস্কার করে, খুঁটিতে বেঁধে রেখে, গরু-ছাগলের কবল থেকে রক্ষা করে তিলে তিলে পরিশ্রমে, যতেœ। সম্পর্ক গড়া বা টিকিয়ে রাখা অনুরূপ পরিশ্রমের কাজ। বিয়ের মাধ্যমে একটি সম্পর্কের বীজ বপন করা হয় মাত্র। পরিপূর্ণ সম্পর্ক দুটি মানুষের সঠিক ইচ্ছা ও মানসিকতার উপর নির্ভর করে। জোর করে ভালোবাসা হয় না। জোর করে সম্পর্ক টিকে থাকে না। জোর করে সম্পর্ক থেকে বের হওয়াও যায় না।’
সম্পর্ক বিষয়ক দীর্ঘ বক্তব্য শুনে পরীর চোখ দিয়ে ঝরে পড়লো দুফোঁটা উষ্ণ জল। বুঝা গেলো না, এটা তাঁর কষ্টের নাকি আনন্দাশ্রু।
অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল সে। চোখের জল মুছার কথাও এ মূহুর্তে ভুলে গেছে। ‘অন্যের অনুভুতিকে বুঝতে পারা আয়ত্ত করুন। এতে সম্পর্কের ভেতর ঘটে যাওয়া সংঘাতের সমাধান হয়ে যাবে। অন্যজন কী ভুল করছে সেটা না ভেবে বরং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি কি ভুল করছি এবং আমি কিভাবে নিজের মানসিকতা বদলাতে পারি। ভুল বুঝাবুঝির কারণে অনেক তর্কাতর্কি হয়ে থাকে। তাই এই বিরক্তিকর, অপ্রত্যাশিত হতাশা, ঝগড়াকে এড়াতে নিজের পক্ষ থেকে যা কিছু বলার আছে তা সহজ ও স্পষ্টভাবে বলে বিষয়টি পরিষ্কার করে ফেলুন। দুজনের ভুল বুঝাবুঝি না ঘটতে একটা এসএমএস বা চিঠি পাঠানোর আগে কয়েকবার পড়ে নিন। আপনি যা বলতে চান তা কি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে? দেখে নিন। আর সন্দেহ থাকলে মুখোমুখি কথা বলুন। সম্ভব না হলে স্কাইপ বা ফেসটাইম ব্যবহার করুন।’
পরীর ইচ্ছা করছে না সেমিনার হলে আর এক মূহুর্ত বসে থাকতে। তাঁর ভুলের কারণে নাকি নাহিদের ভুলের কারণে দুজনের জীবন আজ ভীষণ বিষিয়ে উঠেছে। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও কেউ কারো মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে কথা বলেনি আজ দুবছর হলো। সম্পর্ক বিষয়ক সেমিনারের বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ এখন তাঁর হৃদয়ে তীরের ফলার মতো বিঁধছে। এসব নানাকিছু ভাবার অবসর না পেতেই আবার কানে আসে বক্তৃতার শব্দাবলী।
‘স্বামী বা স্ত্রী বা জীবনসঙ্গী – নিশ্চয়ই একজনের মূল সম্পর্ক, কিন্ত ‘একমাত্র’ সম্পর্ক নয়। খুব ভালো করে বুঝা প্রয়োজন- কখন আপনি একজন বন্ধুর কাছে যাবেন, কখন পরিবারের কারো কাছে যাবেন। অনুধাবন করতে হবে- কোনো কারণে কাঁদতে হলে কার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবেন। সবকিছুর জন্যে পার্টনারকে কাজে লাগাবেন- এমন আশা করবেন না। মনে রাখবেন, জীবন সব সময়ই আনন্দের থাকে না, কঠিন মুহূর্তও সবার জীবনে আসে। কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হলে নিজেকে উন্মুক্ত করতে হয়। নিজেকে সহজভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরতে না পারলে সম্পর্ক গড়া বা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আপনি যদি আপনার দুর্বলতা, ভয়, দুশ্চিন্তাগুলো অপরজনকে জানতে দেন, তার সহায়তা চান, তাহলে অন্যজনও তাই করবে। গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, পরস্পরের দুর্বলতাগুলো বিনিময় না করলে কখনো শারীরিক-মানসিক-আত্মিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় না। আর কথায় বলে- আলো সবসময়ই ঢোকে ফাটল দিয়ে। অন্যের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা দেখালে একদিন আপনিও অন্যের দয়া ও সহমর্মিতা প্রাপ্ত হবেন। মনে রাখবেন- আমরা অনেক সময়ই নিজের প্রিয়জনকে এমনভাবে নিই যেন ‘ও তো আছেই’। এটা খুবই গর্হিত বিবেচনা। এসব না করে তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিন, অন্যজনের প্রতি সদয় হোন, এবং অন্যজন যখন সেটা করছে তখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। আপনি যখন কারো কথা ভাবছেন, তখন এসএমএস বা ইমেল করে এই অপূর্ব ভাবনাটা তাকে জানিয়ে দিন। সত্যি কথা হচ্ছে যে, অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কল্পনার বা স্বপ্নের সেই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ বলে কেউ নেই। এখানে আছে একজনই, যাকে আপনি বেছে নিয়েছেন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। তাঁর সাথে কেমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছেন সেটার মূল্যায়ন করুন। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, আপনি কি মধুর সম্পর্কের সাথে তাকে নিয়ে মানিয়ে চলতে পারছেন? আপনি কি সম্পর্কটি রক্ষা এবং বিকাশের জন্য বিশেষ কিছু কাজ করে যেতে পারছেন?’


হঠাৎ পরীর ভেতর একটা ভাবান্তর দেখা দিল। সে ভীষণভাবে অনুভব করলো জীবনসঙ্গী নাহিদের শূন্যতা। তাঁর মনে হলো, এই সেমিনারে নাহিদ যদি থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো। তাদের মাঝে ঘটে যাওয়া ভুল বুঝাবুঝির দিনগুলোর কথাগুলো তুলে একটা মীমাংসা করা যেতো। পরীর হৃদয় বেশ বিগলিত হলো। নাহিদের প্রতি সমস্ত রাগ,অভিমান,ক্ষোভ মোমের মতো গলে পরীর মনে অজানা ভাবাবেগ উদয় হলো। সে নাহিদকে কল দিতে বক্তৃতার উপসংহার অংশ শুনতে শুনতে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। সেমিনারের শেষ কথাগুলোও ছিল মোহাবিষ্ট হয়ে শুনার মতো। – ‘ভালো কাজ ভালো পন্থায় করাই যুক্তিপূর্ণ। ভালো কাজ খারাপ পন্থায় করা আরেক অপরাধ। ছোট ছোট ব্যাপার থেকে বড় বড় দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
কারো সাথে ভুল বুঝাবুঝি হলে বড় দূরত্ব সৃষ্টির আগেই সরাসরি কথা বলে সমাধান করা উচিত।
মনে রাখা ভালো যে, সুখের মাঝেই শুধু সৌভাগ্য নিহিত থাকে না। কখনো কখনো বিশাল সৌভাগ্য কষ্টের আড়ালেও লুকিয়ে থাকে। আর কাউকে বেশী ভালোবাসলে সে আঘাত দিলে বেশীই দুঃখ পাওয়ার কথা। কিন্তু এটা দুর্বলতা নয়। এমন ভালবাসায় ধৈর্যহীনতাই প্রকৃত দুর্বলতা। সাধারণত মানুষ ফাঁদে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এটা উচিত নয়। কোনো কোনো ফাঁদ ভবিষ্যতের পথ পরিস্কার করে দেয়। ভেবে দেখুন, লাফ দিয়ে যদি একটি খাদ পাড়ি দিতে চান তাহলে অবশ্যই পিছনে গিয়ে লাফ দিতে হয়।
সন্দেহ প্রবণতা হৃদয় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। সন্দেহ এমন এক রোগ যা একবার মনে দেখা দিলে ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। বাড়তে বাড়তে অন্তর গ্রাস করে নেয়। কিছুতেই সেটা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। কাউকে কিছু বলা বা লেখার আগে ভালোভাবে ভাবুন। কারণ, অস্ত্র দ্বারা যে জখম করা হয় সময়ের সাথে সাথে সে জখম নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে; কিন্তু কথা বা লেখার মাধ্যমে যে জখম করা হয় তার নিরাময় নেই। যুগ থেকে যুগান্তরে সে জখম থেকে রক্তক্ষরণ হতেই থাকে।’ ইতোমধ্যে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ফেলেছে পরী। নাহিদের মোবাইল নাম্বার ডায়ালে এনে ভাবছে, সে-ই না হয় আজ ক্ষমা চেয়ে দুজনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাবে। বিয়ের প্রথম তিন বছরের মতো মধুর সম্পর্কটা আবার ফিরিয়ে আনবে। বাকীটা জীবন এভাবেই প্রয়োজনে সে নিজেই অনেক ছাড় দিয়ে একটা হতাশা-মুক্ত জীবন তারা যাপন করবে। পরীর এমন ভাবনার ভেতরই হঠাৎ তাঁর মোবাইলে অপরিচিত নাম্বারের এক কল এলো। অপরিচিত কন্ঠ জানতে চাইলো- আপনি কি নাহিদ সাহেবের স্ত্রী? পরী বললো- জ্বি। অপরিচিত কন্ঠ বললো- রোড এক্সিডেন্টে তিনি নিহত হয়েছেন। ওসমানী মেডিকেলের মর্গে লাশ রাখা আছে। আপনারা আসুন। মোবাইলের অপরিচিত কন্ঠটা ঠিকমতো মিলিয়ে যায়নি। পরীর হাত থেকে মোবাইলটি মেঝেতে পড়ে গ্লাস ফেটে বন্ধ হয়ে গেলো। পরী মোবাইলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ‘সম্পক’ বিষয়ক সেমিনার শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সব শ্রোতা হল থেকে বেরিয়ে গেলো। বিশাল শূন্য হলের ভেতর একমাত্র পরীই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো পাথরের মূর্তির মতো।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *