কপাল

গ্রামের নাম বলঞ্চা। এখান থেকে অনেক দূরে। উত্তর বঙ্গের একটি গ্রাম। গ্রামের উত্তর পাড়ায় বাস করে হাতেম আলী খাদিমদার। তার পেশা খাদিমগিরি। কারো বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে তাকে ডাকা হয়। খাদিমদারি করার জন্যে। সৎ। সহজ সরল। নীতিবান লোক তিনি। আজ তাঁর গল্প তোমাদের শোনাবো। আগে এই গ্রামে প্রতি বাড়িতে কোন না কোন আচার-অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। মুসলমানি, বিয়ে-শাদি, বাৎসরিক মিলাদ, কুলখানি ইত্যাদি। বড় বড় গরু-খাসি জবাই হত। সেসব গরু-খাসির মাংস রান্না হত বড় বড় পাতিলে-ডেগ-ডেগচিতে। মানুষ আসত দল বেঁধে। রান্না করা মাংসের সুগন্ধে গাঁয়ের আকাশ-বাতাস মৌ মৌ করত। পেট পুর খেত সবাই আবার গামছায় বেঁধে নিয়ে যেত, বাড়ির বউ-ঝিদের জন্য। দিনে দিনে দিন চলে গেছে। পাল্টে গেছে আচার -অনুষ্ঠান। বদলে গেছে মানুষ। দিনের বেলা আর অনুষ্ঠান হয় না। রাতের আঁধারে যে যেভাবে পারে সেরে নেয়। হাতেম আলী খাদিমদারের আগের আর সে দিন নেই। তার কদর কমে গেছে। সংসারে অভাব-অনটন নিত্য সঙ্গি। পাঁচজন ছেলেমেয়ে। ভয়ে অনেকে দাওয়াত দেয়না। বড়লোক যারা ; তারা মাঝে মাঝে ডাকেন। অগ্রহায়ণ মাস। গ্রামে সবার ঘরে নতুন ধানের চাল। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের ঘরে ছোটখাট অনুষ্ঠান হবে। রশিদ মুহুরী গাঁয়ের নাম করা লোক। তারঁ বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে। হাতেম আলী খুব খুশি। ছেলেমেয়েদের মুখে ভালো খাবার তুলে দিতে পারবে। সেদিন নীতি আর সততাকে বিসর্জন দিয়ে সে বউকে ডাকল,
-বউ আগামি কাল মুহুরি বাড়িতে অনেক বড় অনুষ্ঠান !
– শুনেছি, আমাদের তো পাঁচজন পোলাপাইন।
– তাতে কি হয়েছে,
-মানুষে দেখলে কি বলবে ?
-মানুষ দেখবে না, আমি বুদ্ধি দিচ্ছি।
-তুমি আবার কি বুদ্ধি দিবে ?
-তুমি ওদের পাঁচজনকে, (হাতেম আলী আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল) লেবু গাছের আলো আঁধারিতে বসতে বলবে।
-তারপর, ফিসফিস করে বলল বউ ?
– তারপর। আমিই তো গোস্তের খাদিমদার, সেখানে বেশি করে দিবো। ছেলেমেয়েরা মনভরে খাবে।
-ঠিক আছে, বলল বউ। ছেলে মেয়েদের সেদিন সকাল থেকে উপোস রাখল বউ;যেন অনুষ্ঠানে বেশি খেতে পারে।
পরদিন;
অনুষ্ঠান শেষে হাতেম আলী গোস্তের বালতি নিয়ে পরিবেশন করতে লাগল। লেবু গাছের তলায় বসা ছেলেমেয়েদেরকে প্লেট ভরে গোস্ত দিয়ে বলল,
-ল, বাজানেরা পেটপুরে খা।
ছেলেমেয়েগুলো কোন শব্দ না করে নিরবে খেয়ে উঠে গেল। সবাইকে খাওয়ানো শেষে রশিদ মুহুরী হাতেম আলীকে খেতে ডাকল,
-হাতেম কাকা আপনিও খেয়ে নিন।
হাতেম আলী খেতে বসে অল্প খেয়ে উঠে পড়ল। ভাবটা এমন সে এসব বেশি খায় না। অবশ্য রশিদ মুহুরী জোরাজুরি অনেক করেছে। হাতেম আর খাবে কি ? ছেলেমেয়েরাই তো কেজি দশেক গোস্ত নিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে বাড়ি এলো খাদেমদার হাতেম আলী। বাড়ি এসে বউকে ডাকল,
-বউ, খাবার দাও,
মুখ কালা করে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেমেয়েরা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। হাতেম আলী ধমক দিয়ে বলল,
-কি হয়েছে, এঁ গোস্ত বুঝি ফেলে দিয়েছিস ?
– না, আমরা ঐ জায়গায় বসার আগেই কে যেন বসে ছিল।
-তারপর ?
-আমরা কাছে যেতেই আমাদেরকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যেখানে বসেছি, আপনি শুধু দুটো হাড় দিয়েছেন, বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল পোলাপানেরা।
হাতেম আলী বুঝতে পারল, কাল বউয়ের সাথে পরামর্শ করার সময় কেউ শুনে ফেলেছে। তারাই এই সুযোগ নিয়েছে।
খাদিমদার হাতেম আলী চোখের পানি মুছে ছেলেমেয়েদেরকে বলল, বাছাধনেরা;
কপালে যদি থাকে হাড়,
কী করবো আমি বাপ খাদেমদার।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *