সুখের স্মৃতি

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বাবা বেড়াতে যেতেন পিসিমার ওখানে। পিসেমশায় বাড়ি করেছিলেন অপার আসামে ।
বাবার সাথে বেড়ানোর জন্য আমাদের কারো না কারো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো। খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম, ডানপিটেও। ভ্রমণ করার শখ তার থেকেও বেশি। অথচ জন্মের পর প্রচ্ছন্ন আশা নিয়ে বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সুকুমার।
শীতের শিশিরভেজা কুয়াশাচছন্ন প্রত্যুষে মায়ের বানানো বাসি ভাপাপুলি খেয়ে রওনা দিলাম আমরা। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছাতেই ঐদিনের মত সূর্যের অন্তিম শয়ান। বাবার হাত ধরে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন চলছে।
ঝম ঝম ঝম একটানা গতি সুরের স্বচ্ছন্দ লহরি তুলে। শাঁ শাঁ শব্দই শুধু। এ যেন রকেট। আড়াই ইঞ্চি পুরু কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য স্পষ্ট অবলোকন করছি। বানর অথবা অন্যান্য জীবজন্তু লাফদিয়ে ট্রেন থেকে যাতে মানুষ ধরে নিয়ে না যায় তাই এ সুরক্ষা ব্যবস্থা। বন্য পশুদল কতক লেজ উঁচিয়ে, কেউ শিং নেড়ে, কেউ থমথম পা ফেলে, কেউবা চুপিচুপি এ ঝোঁপ ছেড়ে অন্য ঝোঁপে লুকোচুরি খেলছে। অবাধ চলাচল ওদের স্রষ্টার চিড়িয়াখানায় পৃথক খাঁচা নেই কারো জন্যে। বাবা গল্প করছিলেন। ভাবছি গল্প শেয হলে সমস্ত ট্রেন ঘুরে আসবো। শুধু গল্পে মন ভরে নাকি! আর স্থিরতা সেতো আমার সাধ্যের বাইরে। বাবা আমার মনোভাব বুঝে বললেন,

“একবার ভিতরটা ঘুরে আয় খোকা। কিছু খাসনে যেন।” এই আদেশটুকুর জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম আমি। “ঠিক আছে বাবা” মাথানেড়ে দে ছুট।
ট্রেন এসে ইন করল ফকিরাগ্রাম স্টেশনে। মিনিট পাঁচেকের বেশি থামেনা ফেরিওয়ালারা ট্রেনের মধ্যে ডাক ছাড়ছে বিচিত্র ওদের পোশাক, জিনিসও বিচিত্র। বাবা বললেন -চা নাও। বাবার উদ্দেশ্য ছিল জীবন সম্বন্ধে আমাকে সচেতন করা। হয়ত: তিনি চান আমরা স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে শিখি কিংবা উপলব্ধি করি সাধারণ জীবনযাত্রার মান।
বাবার শেষ হলো আমারও। পেয়ালাটা মালিকের কাছে জমা দিতে গেছি গেটে,অমনি ঘটাং করে ট্রেনের দরজা বন্ধ হলো। আমি বাইরে, বাবা আমার হাতখানা প্রাণপণে আঁকরে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন ট্রেন থামানো হলো। ততক্ষণে বাবা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছেন । আকস্মিক রক্তসঞ্চালন বন্ধ হওয়ায় বাবার দশাসই অবস্থা। হতভম্ব হয়ে আমি দাঁড়িয়ে। সহৃদয় যাত্রীরা বাবাকে যথাসাধ্য সেবাযতœ করলেন। পিতৃ পিতৃ করে দৃষ্টি মেলে বাবা বললেন,
-খোকা কোথায়?
-এইযে আপনার পুত্ররতœ,কেউ বলল, এই ছেলে তুমি এত চঞ্চল কেন? বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। হাউমাউ করে কেঁদে বলি, আমি কখনো তোমার অবাধ্য হবনা বাবা।

বাবার কোল ঘেঁষে বসে মায়ের দেওয়া চিড়ে আর নাড়ু সাবাড় করছি। ট্রেনের রঙবেরঙের খাদ্য মায়ের রাতজেগে তৈরি করা খাদ্যের শতাংশও নয়।
চারপাশে গভীর জঙ্গল কেটে রেলপথ করা হয়েছে। বাবা বললেন, ইংরেজরা আমাদের দেশের মানুষগুলোকে পশুর মতো খাটিয়েছে। এই রেলপথ করতে কত মানুষ যে বাঘ -ভালুকের পেটে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। পাথর আর মাটি চাপা পরেও মারা গেছে অনেকে। মনেমনে ভাবলাম ভালই করেছে নাহলে পিসিমার ওখানে যেতাম কি করে।
একশ গজ নিচে বয়ে চলেছে প্রবল জলস্রোত। ট্রেন থেকে শোনা যাচ্ছে খরস্রোতা পার্বত্য নদীর গর্জন। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন খসে পড়ছে গলিত রৌপ্যের রূপালিস্রোত।
সন্ধার ধূসর আলোয় পৌঁছালাম আসামে। ভোরের সোনালি আলোয় আমরা ভ্রমণে বেরোলাম।
বাবার কাছে জানলাম বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর -পূর্ব সীমান্ত জুড়ে রয়েছে আসাম। ভূটানের সাথে আছে এর সীমান্ত। ভারতের সেভেন সিস্টার্স এর একটি আসাম। আসাম চা উৎপাদনে পৃথিবীর শীর্ষে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আসামে রয়েছে নীলপাহাড় সবুজ উপত্যকা আর লাল নদী। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ঐতিহাসিক সিটি শিবসাগরে রয়েছে কাজীরঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। বাবার সাথে দেখতে গেলাম। এই পার্ক জাতিসংঘের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। পাখিদের অভয়ারণ্য। জীবজন্তুর নিরাপদ বিচরণস্থল।
ব্রহ্মপুত্র নদে রয়েছে মাজুরী নামে বড়
আয়তনের দ্বীপ। শিবসাগর সিটি খুব সুন্দর। রেলওয়ে স্টেশন অনেক মনোমুগ্ধকর। লোয়ার আসামে রয়েছে গোয়াহাটি বিমানবন্দর,কামাক্ষা মন্দির, উমানন্দ মন্দির, বারাকভ্যালী, রাষ্ট্রীয় চিড়িয়াখানা। পিসিমার বাড়ি বেড়ানো হলো, এবার দেশে ফেরার আকুতি।

সকালেই আমরা রওনা হলাম।
সারাদিনের পথ শেষে ফাগুনের পড়ন্ত
বিকেলে বাবার হাতধরে বাড়ি ফিরে এলাম। ঋতুরাজ বসন্ত বাংলার ঘরে ঘরে এভাবেই হাসিমুখ নিয়ে আগমন করে। পরমস্নেহে মা আমার মাথায় হাত রাখলেন। গোধূলির সোনালি আলোর স্বলাজ হাসিটুকু আমার মায়ের মুখকে আরোও আলোকিত করেছে। আমি শুধু অলসভাবে চেয়েছিলাম সোনালি আভার দিকে। মনে হলো —

‘জননী আমার, আমার দেশ
রূপে যে তোমার নেইকো শেষ।’

বাবা বললেন, ও আমার সেই ছেলে যাকে দুইবার জন্ম দিয়েছি।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *