অসিলাই মুক্তির পথ

আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময়ে মরু আরবের পাহাড়িয়া বন জঙ্গলে অনেক লোক জীব-জানোয়ার শিকারে যেতো। এই জীব-জন্তুর মধ্যে হরিণ শিকার ছিলো, খুব আনন্দদায়ক ও কৌতুহলপূর্ণ শিকার। একদিন এক কাফের ব্যক্তি হরিণ শিকারের উদ্দেশ্যে বের হয়। সঙ্গে ছিলো একটি জাল। একটি সরু গলিতে জালটি পাতল। অতঃপর একটি হরিণকে পিছন দিক থেকে তাড়া করল। তখন হরিণটি প্রাণের ভয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। এক পর্যায় পালাতে গিয়ে উক্ত জালে আটকা পড়ে গেলো। শিকারী লোকটি দৌড়ে এসে হরিণটি ধরে ফেলল। হরিণটি ছিলো নব প্রসূতি। কয়েকদিন পূর্বে দু’টি বাচ্চা প্রসব করেছে। বাচ্চা দু’টি গভীর জঙ্গলে রেখে আহার সংগ্রহে বের হয়েছে। ধরা পড়ে গেছে। ভাবল আর বুঝি রক্ষা নাই। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চক্ষু দিয়ে বয়ে চলল অশ্র“র স্রোতধারা। বিলাপ ক্রন্দনে যেন হরিণটির কলিজা ফেটে চৌচির।
এদিকে শিকারী লোকটি একটি মোটা তাজা মাদি হরিণ পেয়ে খুবই উৎফুল্ল। কিন্তু সে যে একা। চিন্তায় পড়ে গেল কিভাবে এটা নেওয়া যায় ? শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না পেয়ে হরিণটির হাত পা শক্ত করে বেধে টানতে শুরু করল। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল। পথিমধ্যে বিশ্রাম করতে বসল। এমন সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন দো’জাহানের বাদশা বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম। হরিণটি তাঁকে দেখে বেদনার আনন্দে ক্রন্দন করতে লাগল। মনে মনে ভাবল, আমার জীবন ধন্য, আমি আখেরি নবী মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সাক্ষাত পেয়েছি। যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ঐ শিকারীর কাছে আগমন করলেন, আল্লাহ’র হুকুমে হরিণের জবান খুলে গেল। তখন হরিণটি বলল, আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম! আমাকে এই শিকারী ধরে এনেছে। কিছুদিন আগে আমি দু’টি বাচ্চা প্রসব করেছি। বাচ্চা দুটি আমার বাসায় রয়েছে। অনেক সময় হয়েছে তাদের কাছ থেকে এসেছি। তারা দুগ্ধের তৃষ্ণায় ছটফট করে কাঁদছে। হে দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম! আপনি আমাকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি দিন। আমার বাচ্চা দু’টিকে জনমের মত একবার দুধ পান করিয়ে আবার চলে আসব।
হরিণর এরূপ আকুতি শুনে দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর হৃদয় সাগরে দয়ার তুফান উঠল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম শিকারিকে বললেন, হে শিকারী! এই হরিণটি বাসায় দুটি অবোধ বাচ্চা রেখে আসছে। এটা ছেড়ে দাও। সে বাচ্চা দুটিকে দুধ পান করিয়ে আবার চলে আসবে। শিকারী বলল, হে পথিক। যদি এই হরিণকে ছেড়ে দেই, তবে সে আবার ফিরে আসবে তা কোনো বোকা লোকও বিশ্বাস করবে না। সুতরাং আমি এটা ছাড়তে পারি না।
সুলতানে দো’জাহান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বললেন, আমি এটার জামিনদার। এটা ফিরে না আসলে আমি তার সমুদয় ক্ষতিপূরণ দেব। এই কথায়ও পাপিষ্ট রাজি হলো না।
অতঃপর রাসূলদের সিপাহ সালার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বললেন, হে শিকারী! হরিণটি ছেড়ে আমাকে বেঁধে রেখ, যতক্ষণ হরিণটি না আসবে, ততক্ষণ আমি তোমার দড়ির বাঁধনে দণ্ডায়মান থাকব। তখন শিকারী সম্মত হয়ে হরিণটি ছেড়ে দিল। হরিণটি ছাড়া পেল। দৌঁড়ে গিয়ে বাচ্চা দু’টিকে দুগ্ধ পান করাল। বাচ্চাদের তৃষ্ণা নিবারণ হল। এবার হরিণটি বাচ্চাদেরকে বলল, আমাকে তোমরা শেষ বারের মতো দেখে নেও। আমি শিকারের জালে বন্ধি হয়েছিলাম। মহান আল্লাহ’র প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম-এর অসিলায় ছাড়া পেয়েছি। নিষ্টুর শিকারী আমাকে ছেড়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে বন্ধি করে রেখেছে। আমার জন্য উভয়জগতের সুলতান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কষ্ট পাচ্ছেন। আমি তোমাদেরকে মহান শক্তিময় আল্লাহ’র নিকট সোপর্দ করলাম। এ কথা বলেই হরিণটি আবার দৌঁড়ে চলল। আর কচি বাচ্চা দু’টি অপলক নেত্রে মায়ের পানে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। হরিণটি এসে দেখল, আল্লাহ’র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এখনো দণ্ডায়মান। বলল, আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম, আমি উপস্থিত। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি।
শিকারী লোকটি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর প্রতি হরিণটির এতো ভালোবাসা ও পুনরায় মৃত্যুর দুয়ারে ফিরে আসা দেখে অবাক হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর নবীদের সরদার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল। হরিণটিকেও মুক্ত করে দিল। হরিণটি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পবিত্র কদম মুবারকে আনন্দ অশ্রু বহায়ে বলল, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম! আমি আপনার অসিলায় আজ নাজাত পেয়েছি। আপনি না হলে আমার নাজাত পাওয়ার কোনো পথ ছিলো না। শাহানশাহে কাওন মাকান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বললেন, তুমি পেলে জাল থেকে নাজাত, আর শিকারী পেল জাহান্নাম থেকে নাজাত। অতঃপর সকলে যার যার নিজ গন্তব্যে চলে গেল। (শেফা শরীফ ২/৭১)

Comments

comments

About

Check Also

কারবালার শিক্ষা

শাফীর বয়স বারো পেরুলো। ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা ওকে সব সময় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *