তারিফ, আরশ, শাবান, রাওকী সহ ওদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব স্কুল মাঠে একত্রিত হয়েছে। এখন বিকেল। রাত পোহালেই ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে রাত বারোটা এক মিনিটে বিশেষ আয়োজন। এসব নিয়ে কথাবার্তা বলতেই সবার একত্র হওয়া। এবারের বিজয় দিবসের আয়োজনটা একটু ব্যতিক্রম। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে আমাদের দেশের বীর সৈনিকেরা ডিসেম্বরের এই দিনে সমস্ত অত্যাচারী পাক-বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিল লাল-সবুজের এক ঐতিহাসিক পতাকা। এই পতাকার বয়স আজ অর্ধশত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তাই বাংলার মানচিত্রে এবারের আয়োজন কিছুটা ভিন্ন। আয়োজনে যারা সর্বোচ্চ পরিশ্রম করবে তাদের বেশির ভাগই তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতির বয়সী। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। দাদা-কাকাদের মুখে শুনে, বই পড়ে আর টিভি দেখে এ সম্পর্কে ধারণা নিয়েছে।
এতেই বর্তমান প্রজন্মের ছেলেদের মধ্যে যে চেতনা তৈরি হয়েছে তা দেখার মতো। ওদের এটিটিউট দেখলে মনে হয়, সামনে পেলে পাক-হানাদারকে ওরা চিবিয়ে খাবে।
স্কুল মাঠে খোলা আকাশের নীচে ওরা দশ-বারোজন আলোচনায় বসল। নানাজনের নানামত থাকার পরেও এক পর্যায়ে একটি মতে সবাইকে স্থির হতে হল। জনপ্রতি দুশো টাকা করে চাঁদা তুলে তিনজন মটর সাইকেল যোগে তৎক্ষণাৎ রওনা হল ত্রিশ কিলোমিটার দূরের শহরে। বাজি আনতে হবে। ওদের এই বনরূপা গ্রামে আতশবাজি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা তেমন উন্নত নয়। তাই বাধ্য হয়ে শহরে যাওয়া।
সাধারণত উপজেলা শহরে এসব জাতীয় দিবস উপলক্ষে নানান আয়োজন করা হয়। তবে এবারেরটা ভিন্ন। বিজয়ের এই পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে অজপাড়া গাঁয়ের দামাল ছেলেরা আজ মেতে উঠেছে আনন্দে। ইউনিয়ন পরিষদের সামনে গড়ে তুলেছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। আজ রাত বারোটা এক মিনিটে ফুল দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হবে বিজয়ের উলাস।
বনরূপা গ্রামের কিশোর-যুবকরা আজ যেন ফিরে পেয়েছে নতুন এক প্রাণ। এলাকার চেয়ারম্যান সহ গণ্যমান্য অনেকেই চলে এসেছে স্বাধীনতা স্তম্ভের কাছাকাছি।
রাত বারোটা এক মিনিট। শুরু হল আমাদের চিরচেনা জাতীয় সংগীত। সাথে সাথে গ্রামের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা বরকত চাচার হাতে ওড়ানো হল জাতীয় পতাকা। তারপর খুবই শৃঙ্খলার সাথে চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যরা স্তম্ভে ফুল প্রদান করে গেল। এরপর শুরু হল চোখ ধাধানো আতশবাজি। তারিফ, আরশ, শাবান, রাওকী আর ওদের বন্ধুরা মাঠের মধ্যখানে প্রথম যে বাজিটা পোড়ালো এমনি কেঁপে উঠলো পুরো গ্রাম। মনে হল বড়সড় এক বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। চোখের পলকে বাজি প্রায় দুশো ফুট ওপরে উঠে গেলো। আর ওখানেই তা বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দিলো চারদিক। বিস্ফোরণের শব্দে ভয় লাগলেও এটা দেখার মতো দৃশ্য। মনে হয় মেঘের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে ওখানে সমানতালে চারদিকে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে দিচ্ছে। বনরূপা গ্রামের যারা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে এতক্ষণ শুয়েছিলো তারাও উঠে এসে এই বিস্ময়কর আতশবাজি দেখতে শুরু করেছে।
দু-তিনটা ফোটানোর পর এখন যেন গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে মাঠের চারদিকে। একের পর এক ফুটতে থাকে বাজি, আর হৈ হুলোড় করে ওঠে দর্শক। যেন বাজির উৎসব শুরু হয়েছে। এমন আতশবাজি এই গ্রামের কেউ আগে কখনো দেখেনি।
হঠাৎ মাঠের মধ্যে চিৎকার-চেচামেছি শুরু হল। চেয়ারম্যানসহ এলাকার মুরব্বিরা এগিয়ে গেল মাঠের মধ্যে। কি হল? বাজি পোড়াতে গিয়ে রাওকীর বুকের মধ্যে একটা বাজি বিস্ফোরণ ঘটেছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে রাওকী। এতো রাতে কোথায় পাবে গাড়ি। শেষে মটরসাইকেলে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হল রাওকীকে। সারা রাতে রাওকীর হুশ ফেরেনি। অবশেষে সকাল ছটার সময় মারা গেল সে।
বিজয়ের উলাস ছাপিয়ে বনরূপা গ্রামে নেমে এলো শোকের ছায়া। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার অন্তরে আজ শোকের ক্ষত। কে যে কাকে সান্ত্বনা দেবে তা বুঝে ওঠা দুস্কর।
বিকেল চারটা। পঞ্চাশতম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল সেই মঞ্চে এখন রাওকীর আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সবার মন কাঁদে। আফসোসে সবার অন্তর বারবার মনে করে গত রাতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার। এতো অল্প বয়সী রাওকী সবার চোখের সামনে এভাবে চলে যাবে এ যেন মন থেকে মানিয়ে নেবার নয়।
মঞ্চে উপবিষ্ট-স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব সহ অন্যান্য মুসলিবৃন্দ। মাঠভর্তি হাজারো মানুষের মাথায় মাথায় টুপি। যেন মাহফিল অনুষ্ঠান।
দোয়ার আগে চেয়ারম্যান সাহেব মাইক হাতে নিলেন। প্রিয় এলাকাবাসী, আসসালামু আলাইকুম। আজ এই দোয়ার আয়োজন সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। আমাদের দেশের ইতিহাসে আজ একটি স্মরণীয় দিন। এখানে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হবার কথা ছিল। আমাদের কাছে বিজয় আজ শোকে পরিণত হয়েছে। যুবকদের একটি কথা বলতে চাই। আমাদের দেশে আমরা যে উৎসবগুলো করি সেই উৎসব যেন উৎসবই থাকে। উৎসবের নামে আমরা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলি। এমন এক বাড়াবাড়ির ফল আজকের এই দুর্ঘটনা। তোমরা প্রত্যেকে অনুষ্ঠানেই এমন কিছু বাড়াবাড়ি করতে থাকে। যা না পারি কইতে আর না পারি সইতে। কিছুদিন আগে তোমাদের স্কুল-কলেজে বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষে তথাকথিত ‘র্যাগ ডে’ উদযাপন করেছ। এটা দিয়ে তোমরা প্রমাণ করেছ তোমরা কতোটা নোংরা তোমাদের মানসিকতা কতটা কলুষিত। পুরো পৃথিবীতে আমাদের বাংলাকে তোমরা একটা নিকৃষ্ট জাতি হিসেবে তুলে ধরেছ। এভাবে চলতে থাকলে এই বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠান করে লাভ কি?
সব সময় মনে রাখবে সর্বদা তোমাদের পিতামাতা তোমাদের দেখছে। আলাহ তোমাদের দেখছেন। অতএব কতোটা নোংরামিতে নামবে তা হিসেব করে নামবে। আমার কথায় রাগ হলে হতে পার। কিন্তু এটাই সত্য। সবাই সবার জন্য দোয়া করবে আর বুঝেশুনে চলবে। এবার সবাই দোয়ার জন্য হাত তুলুন।