আরিফ ও তার জীবনাবসান

রাত ১০;৩০ বাজে, ঘুড়ি ঘুড়ি বৃষ্টির সাথে ধমকা হাওয়া বইছে। সারাদিনের আবহাওয়া এরকমই। আজকে আরিফ যাবে বার আউলিয়ার শহরে কয়েকজন আল্লাহর ওলীর জিয়ারতে যা পূর্বে ঠিক করা ছিল। রেল স্টেশনে এসে থমকে দাঁড়ালো আরিফ। স্টেশন মাস্টার বললো চট্টগ্রামের ট্রেন পরদিন সকালে আসবে। এক ধরণের হতাশায় ডুবল আরিফ। কমলাপুর থেকে বাসায় যাওয়া তার জন্য কষ্টকর। এইদিকে বাহিরে আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না। প্রবল বাতাস দিচ্ছে, স্টেশনের ভিতর ভিজে গেছে, বসার মতো জায়গা নেই। বাহিরে ঝড় ও বৃষ্টি বেড়ে গেছে, আকাশে বিজলী ও বজ্রপাত কিছুক্ষণ পর পর আসমান কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো আরিফ। স্মৃতিপটে তার করুণ জীবন কাহিনী মনে পড়ছে। বাবা মারা যাবার পর ২ বছরের মাথায় মা মারা গেলেন। আরিফের বয়স তখন ছিল ৫/৬ বছর, ফ্যামিলিতে দাদাই তাকে স্নেহ আদর দিয়ে বড় করতে থাকলেন। কিন্তু কপালে যা লিখা ছিল তাই হলো। দাদাও মারা গেলেন ৪ বছর পর। দুনিয়াতে তার দাদার এক ছেলেই ছিলেন তার বাবার আর কোন ছেলেমেয়ে নেই। আরিফের জন্মের কয়েক বছর আগে দাদি মারা যান। আরিফের দূর সম্পর্কের এক আতœীয় তাকে ঢাকায় এক এতিমখানায় দিয়ে যান। দুর্ভাগ্যবশত তার ঠিকানা এতিমখানায় ভুল দেওয়া হলো এবং এটার পেছনে ছিল তাদের সকল সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা। অনেক চেষ্টা করেও আরিফ তার আসল পরিচয় ও ঠিকানা জানতে পারেনি।

এতিমখানায় বড় হতে লাগলো, পাশেই ছিলো পুরান ঢাকার চকবাজার। যেখানে মসজিদের ভিতর প্রখ্যাত জৌনপুরী সিলসিলার এক বুযুর্গের মাজার ছিল। একটু বড় হওয়ার পর কিছু দিন এখানে খেদমতে ছিল, জীবিকার তাগিতে বের হয়ে পড়ে। পড়ালেখাও তেমন করেনি ভালো চাকরি করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। আরিফের দ্বীনি ইলম ছিল ভালোই, চকবাজারের এই ওলীর খাস এক তায়াওজ্জু ও দুয়ার বরকতেই এই জ্ঞান হাসিল হয়। এখানে যতদিন ছিল নিঃস্বার্থভাবেই খেদমত করে গেছে, কোন বিনিময় চায়নি এর জন্যই বোধ হয় এই রকম দুয়া পেয়েছিল। আরিফের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন ব্যবস্থাই হয়নি, শুক্রবারে জুমার নামায আদায় করে বসে রইলো মসজিদের প্রধান ফটকের কাছেই। মসজিদের খাদিম এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছে হাল হাকিকত? আরিফ বললো, একটা চাকরি দরকার তার, নিজের কিছু করার দরকার। খাদিম সব শুনে মুচকি হেসে বললেন, এই মসজিদের মুয়াজ্জিন হবে? কোন কিছু না বলেই আরিফ হ্যাঁ বলে উত্তর দিলো, এবং উনি আরো বললেন মসজিদের নিচে উনার একটি লাইব্রেরি আছে, আরিফ চাইলে সেখানেও কাজ করতে পারবে।
কাজ শুরু করার আগে সে চট্রগ্রাম জিয়ারতে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি। এসব মনে করতে করতে তার আঁখিযোগল ভিজে গেলো। চারিদিকে ঝড় তুফান বৃষ্টি ও বজ্রপাত ও বিজলী। হঠাৎ তীব্র কঠিন আওয়াজ এলো আকাশ থেকে এবং এটা ছিল বজ্রপাত। সেই বজ্রপাত তার উপর এসে পড়ে, তাকে পুড়িয়ে ফেলে সেখানেই সে মারা যায়। এভাবেই এক অসহায় বনী আদমের জীবনের অধ্যায় শেষ হয়!

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *