অহম বধ

দুশ্চিন্তার কালো মেঘ পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে আমাকে। ভাল হাতটি ধীরে ধীরে অবশ হতে চলেছে। পাঁচটি আঙুলের মাথা থেকে শিনশিন শুরু হযে়ছিল বেলা এগারটা থেকে। সন্ধ্যা ছ’টায় কনুই পর্যন্ত গ্রাস করে নিযে়ছে। আল্লাহর কাছে তওবা করেছি ইতো:মধ্যে আগুনতিবার। নানা ধরণের ঔষধ সেবন করেছি বিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ঘনকালো মেঘ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। কখন যে গর্জন শুরু হয় সে আশঙ্কায় বার বার প্লীহা কেঁপে উঠছে। সুজাত আলীর কাছে তবে কি ক্ষমা চাইতে হবে?
দশ গাঁযে় আমার নাম ডাক? আমার ভযে় গর্ভবতী মহিলার সন্তানও তটস্ত থাকে। বাঘে মহিষে একঘাটে জল খায়। দাদার দাপট না থাকলেও বাবার দাপটেই আমার ষোলকলা। অনেকে আড়ালে আবডালে বলেছিল বাবার ইন্তেকালের পর বিড়ালের লাথি আছে কপালে। হাতি খাদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে জানতাম। কিন্তু কখনো খাদে পড়তে হয়নি। বাবার ইন্তেকালের পাঁচ বছর হযে়ছে। বয়সের তুলনায় বেশ বুডি়যে় গেছি। দাপট বুডি়যে় যায়নি কখনো। বরং তির তির করে বেডে়ছে। সুজাত আলীর সাথে সুস্থ ও স্থির মাথায় যা করলাম তা গুলিযে় ফেলছে সমস্ত দেমাগ। চাওয়া ছাড়া কি কোনই গত্যন্তর নেই?
আল্লাহ আমার সৌভাগ্যের পক্ষেই ছিলেন সারাজীবন। সোনার চামচ মুখে নিযে় জন্ম আমার। অভাব অনটন কি কল্পনাই করতে পারি না। রমদ্বান মাসে রোজা রেখে রিপু দমন ও ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনুধাবনের চেযে় ডায়াবেটিসের স্থর নিযে় সন্তুষ্টিচিত্তে তৃপ্ত থাকতাম। সুজাত আলী আমার প্রতিবেশী। তার কিংবা অন্যান্য দরিদ্র প্রতিবেশী পরিবারের অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটতো জানলেও রোজার মাধ্যমে তাদের ক্ষুধা যন্ত্রণা অনুভবের শিক্ষা গ্রহণ আমার ধাতে কোনো দিন ছিল না। সুজাত আলীর প্রতি আল্লাহ দয়ার নজরে তাকিযে়ছেন। সে আজ গরু দিযে় কুরবানী করছে। এমনিতেই তার প্রতি বিদ্বেষ বেশ পুরনো। সুজাত আলী ধীরে ধীরে আমার দরিদ্র প্রতিবেশীর তালিকা থেকে ছিটকে পড়ছে। ক’বছর থেকে যাকাতের টাকা সে ফিরিযে় দিচ্ছে। বলে কিনা, সে নাকি আর যাকাত খাবার উপযুক্ত নয়। আল্লাহ বুঝি তার অভাব ঘুচিযে় দিযে়ছেন। তারপ্রতি সদয় হযে়ছেন। বলে কি ব্যাটা সুজাত আলী। আমার করুণাকে সে ফিরিযে় দিলো। এতো বড় স্পর্ধা দেখে গোপন অহমের গুড়ায় কম্প শুরু হযে়ছিল। তোষের আগুনের মতো অহমের আগুন আজ হঠাৎ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সুতরাং সুজাত আলীকে আমার প্রকৃত স্বরূপের প্রাথমিক দিকটা দেখিযে়ছিলাম মাত্র। তাই বলে এহেন অপরাধের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে? তা কি করে হয়?
অহম আমাকে অন্ধ করে রেখেছে। দুনিয়ার উত্তানপতনের মর্মন্তুক ঘটনাগুলো আমার চোখে ধরা দেয় না আমি সেই শিক্ষণীয় উপদেশগুলো শুনে বিস্মৃত হযে় যাই। যেন আমি কালাও বটে। কান দিযে় এসব কিছুই ঢুকেনি। আমি ভাল করেই বিশ্বাস করি অহংকার একদিন অহংকারীকে তার চোখের পানিতে ডুবিযে় থাকে। তাকে যথোপযুক্ত প্রতিফল প্রদান করে। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি ইবলিসের চেযে়ও জঘন্য। ইবলিস ফেরেস্তাকুলের ওস্তাদ ছিল। অহমের কারণে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সরাসরি তর্কে লিপ্ত হযে়ছিল। সৃষ্টিকর্তা তার অতীতের সবপুণ্য নষ্ট করে তাকে অভিসম্পাত করেছিলেন। সেই থেকে আজও সে অভিশপ্ত হযে় আছে। সুজাত আলীর জন্য কি আমিও অনুরূপ…?
অহংকার আল্লাহর ভূষণ। যে অহংকার করে সে ‘আল্লাহর ভূষণ বা চাদর নিযে় টানাটানি করে। আল্লাহ স্বীয় মর্জি মতো তাকে ধ্বংস করে দেন। এটা ধর্মের কথা। আমি গভীর বিশ্বাসে ধর্মের কথাকে শ্রদ্ধা করি। তবে অহম বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি, যেটা কেবলই বিস্তৃত হযে়ছে। সুজাত আলীর বাবা, চাচা এবং অসংখ্য দরিদ্র মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আমার সমস্ত রক্ত কণিকায় মিশে আছে। সে কথা বুঝলেও কখনো স্বীকার করি না। তখন বেশ ছোট ছিলাম। ধানের চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত। চারাগুলোও রোপণের উপযোগী হযে়ছে। হঠাৎ গ্রামে মহামারি কলেরা দেখা দিল। প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। বাবা আমাদের পরিবারের সবাইকে নিযে় শহরের বাসায় চলে এলেন। দু’মাস পর গ্রামে ফিরে দেখলাম জমিগুলো শুকিযে় কাঠ হযে় আছে। ধানের চারায় হলুদ রং ধরেছে। কোনো কোনো বীজতলার চারা মরে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। নিস্তব্ধ গ্রামের ঘরে ঘরে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস, আমাদের জমিগুলো যারা বর্গাচাষ করতো তাদের অনেকেই মারা গেছেন। চাষাবাদ না হওয়ায় সে বছর আমাদের গোলায় একটিও ধান উঠেনি। ঐ বছরে আমাদের পরিবারও বেশ টানাটানি করে অভাব অনটনের মাঝে চলেছে। তখন আমি হাডে় হাডে় টের পেযে়ছি। এসব গরীব কৃষকদের কাছে বিত্তবানরা কতটুকু মুখাপেক্ষী। তাদের গাম ঝরা শ্রম ছাড়া আমাদের ভাগ্যে রিজেক জোটে না। তবু বাস্তবতা হচ্ছে- শ্রমজীবী গরীবেরা আমাদের চরম অবহেলার পাত্র।
সুজাত আলীর বাবা আমাদের জমিগুলো বৃহৎভাগের বর্গাচাষী ছিলেন। বিকালে ধান মাড়াই করার সময় তার বাবার সাথে সুজাত আলী আসতো। তার সাথে অনেক খেলাধূলা করেছি। বিশেষ করে ধান কাটার ঋতুতে বিকেলে উঠানে যখন ধান মাড়াই হত তখন সুজাত আলীকে ছাড়া আমার খেলার কথা ভাবাই যেতো না। মধ্যাহ্নের খাবারের পর আকুল মনে তারই অপেক্ষায় বসে থাকতাম। সেই সুজাত আলী আমার কাছে অন্যায় কিছু কামনা করেনি। আমার কাছে সামান্য সৌজন্য আচরণ চেযে়ছিল। যা মানুষ মানুষের কাছেই নির্দ্বিধায় পেযে় থাকে। অহংকারের কাছে আমি পরাজিত হযে়ছি। তার সাথে পশুত্বের ব্যবহার করেছি। সুজাত আলী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেযে় অপমানিত হযে়ও মনুষ্যত্বের আদালতে জিতে গেছে।
সুজাত আলীর মনে যে আঘাত দিযে়ছি তার স্থাযি়ত্ব কতটুকু সে পরিমাপ অনুমান করতে পারছি না। তবে সে আঘাতের কষ্ঠে যে চেহারা নীলাভ হযে় গিযে়ছিল এবং অন্তরে রক্তক্ষরণ হযে়ছিল সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। সুজাত আলীর প্রতি এ অন্যাযে়র ভীত খোঁজতে থাকি। পেযে় যাই সহজে। তার বাবা বশির শেখকে বরাবরই আমার বাবার পা ধরে সালাম করতে দেখেছি। সুজাত আলীকেও তার বাবা শিখিযে় দিযে়ছেন গুরুজন মুরব্বীদের পাযে় সালাম করতে হয় কীভাবে। সুজাত আলী অনুগত সন্তানের মত আমার বাবাকে গুরুজন ভেবে পা ধরে সালাম করতো। কিন্তু আমার বাবা সে শিক্ষা কখনোই আমাকে দেননি। তাই আমি গুরুজন বৃদ্ধ বশির শেখের পা ছুঁযে় কখনো ছালাম করিনি। বরং আমি যখন অনেক বড় হযে় আমাদের জমিগুলো দেখাশুনার দাযি়ত্ব পাই তখন বৃদ্ধ বশির শেখ আমারও পা ছুঁযে় সালাম করতেন। আমি তার ছেলের বয়সী হযে়ও তাকে বাঁধা দেইনি। বশির শেখের মতো আরো অনেক বয়স্ক পুরনো বর্গাচাষী আমার পা ছুঁযে় সালাম করতেন। আমি কাউকেও মানা করিনি।
পাশ্ববর্তী গ্রামে অবস্থিত কওমী মাদ্রাসায় আমি লেখাপড়া করেছি। লেখাপড়ায় দুর্বল ছিলাম বলে মাঝপথে আটকে যাই। মাদ্রাসার ওস্তাদগণ পা ছুযে় সালাম করাকে নিষেধ করতেন। তাবলিগে যাই বলে শাযে়খে মুয়াল্লিম হিসেবে আমাকে নসিহতও করতে হয়। আমার বাবাও একজন শাযে়খে মুয়াল্লিম ছিলেন। পা ছুঁযে় সালাম করাকে কদমবুছি বলা হয়। কদম বুছি অর্থ- পাযে় চুমো খাওয়া। সরাসরি ঠোট দিযে় পাযে় চুমোখাওয়ার আদলে হাত দিযে় পা ছুঁযে় চুমো খাওয়ার রীতি হলো কদমবুছি।
বাবা যেমন তাবলীগ জামাতে দূরবর্তী কোনো মসজিদে অবস্থানকালে এটাকে কেবল নিষেধ করতেন আমি তদরূপ নিষেধ করে থাকি। কৌশলী হিসেবে স্বীয় একলা বা পাশের কোন এলাকায় কদমবুছি সম্পর্কে কিছুই বলি না। বরং নিরবে তা সমর্থন করি। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ঠিক আমার বাবার পথই আমি অনুসরণ করে থাকি। যদিও বাবার সৎগুণাবলীর অধিকাংশই আমার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়নি তা চরম সত্য।
আমি দৃঢ়ভাবে বুঝতাম না কদমবুছি আসলেই জাযে়জ কিনা। আমি আলেম নই। তবে আমাকে দেখলে আলেমেরও ওস্তাদ মনে হয়। আমার লেবাস আর মেকিপরহেজগারী মানুষের চোখে ধান্ধা লাগিযে় দেয়। একটু ছলচাতুরীর আশ্রয় নিলে ‘শামসুল ওলামা’ খেতাব বাগিযে় নেয়া আমার জন্য কঠিন ব্যাপার হতো না। আমি জানি, কদমবুছি যদি হাদীস দ্বারা জাযে়জ হযে় থাকে তা হলে নাজাযে়জ বলাটা বিরাট অন্যায় কাজ। ঠিকই বুঝতে পারি নাজাযে়জ কাজকে জাযে়জ বলাও অনুরূপ গর্হিত। কিন্তু এর অপব্যবহারের কুফল আমি পরিপূর্ণভাবে দেখেছি।
যখন আমার সমবয়সী বা ততোর্ধ বয়সী কিংবা বাবার বয়সের বৃদ্ধ দরিদ্র মানুষেরা আমার পা ছুঁযে় সালাম করে তখন গর্বে বুক ফুলে উঠে। নিজেকে অসীম গর্বিত ও প্রকৃত জমিদার বলে অনুভব করি। পা ছুঁযে় সালামকারীকে প্রকৃত অনুগত হিসেবে গণ্য করি। তার প্রতি স্বতন্ত্র মায়ার নজর রাখি। এটা আমার প্রভূত্বপ্রিয়তাকে বহুগুণে বাডি়যে় দেয়। তখনই গোপনে অনুধাবন করি শাযে়খ ও ওস্তাদগণ কেন কদমবুছিকে শিরকের ফতোয়া প্রদান করেন।
এককালে ফাসিক রাজা বাদশাদেরকে রাজ্যের সর্বস্থরের প্রজারা মাথা সামনের দিকে নুইযে় কুর্নিশ করতে বাধ্য থাকতো। তারও পূর্বে মুশরিক বাদশাদেরকে তার প্রজারা সেজদা করতে বাধ্য থাকতো। সে যুগ গত হযে়ছে। বর্তমান যুগে কদমবুছির অভিবাদন ও আনুগত্য সে যুগের সিজদা ও কুর্নিশের নব সংস্করণ কিনা সেটা মুজতাহিদগণ বলতে পারেন। আমি কেবল এটাই বুঝি, আমার ব্যক্তিগত প্রযে়াজনে এটা আমার প্রাপ্য। অপাত্রে মুক্তা রাখার ন্যায় অপাত্রে কদমবুছি করার ধ্বংসাত্মক কুফল আমার চেযে় অন্য কেউ বাস্তবে বুঝতে পেরেছে কিনা জানা নেই। তবে কদমবুছি প্রত্যাশী ধূর্ত কেউ বুঝতে পারলেও মুখে বলার দুঃসাহস দেখাতে অক্ষম থাকার সেটা নিশ্চিত। আনুগত্য হারানোর ভয় কিংবা আনুগত্য মাপার অদৃশ্য যন্ত্রণাকে তারা সহজে ছাড়তে হয়তো চায়না। যেমন আমি চাই না।
ঈদুল আযহার সকাল। মনটা বেশ ফুরফুরে। আমার বাডি়তে দশ গরু কুরবানী করা অনেক বছর ধরে রীতিতে পরিণত হযে়ছে। অত্র এলাকায় আর কেউ এমন ঢাকঢোল পিটিযে় কুরবানী করার সামর্থ রাখে না। এত পশু কোরবানী করেও কুরবানীর প্রকৃত শিক্ষা এবং প্রাপ্তি থেকে আমি যে বহু দূরে অবস্থান করছি তা ভালভাবেই বুঝতে পারি। কারণ প্রকৃত সেই পশুকে কোনদিনই কুরবানী দিতে আমি পারিনি। আমার ভেতরের সেই অধরা পশু গোপনে দিন দিন রিষ্টপুষ্ট হযে়ই চলেছে। এটা আমাকে নরকের দোরগড়ায় নিযে় যাচ্ছে দেখেও আমি তার গর্দানে ধারালো চাকু লাগিযে় কুরবানীর চেষ্টা তদবির করি না।
গ্রামের গোরস্থানে বাবার কবর যিয়ারত শেষ করে গোরস্থানের গেটে আসতেই সুজাত আলীর সম্মুখে পড়লাম। সেও গোরস্থানে ঢুকতে যাচ্ছিল। তার বাবা ও অন্যান্যদের কবর যিয়ারত করবে সে। সুজাত আলী আমাকে সালাম করে মুসাফা করবার জন্য মুখোমুখি হলো। তার হাত দু’খানা সামনের দিকে বাডি়যে় আমার হাতের কাছাকাছি নিযে় এলো। আমি বিদ্যুৎ গতিতে আমার হাত দু’খানা সরিযে় নিলাম। সে হাত মিলাতে ব্যর্থ হযে় ঠিক আমার সামনে দাঁডি়যে় কুলাকুলি করার জন্য উদ্যত হলো। আমি একটু অদিক সরে যেতে যেতে চার পাশে চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম আশেপাশের সবাই আমার দিকে তাকিযে় আছে। আমার কেন জানি মনে হলো-সকলেই বড় বড় চোখ করে গভীর মনোযোগে আমার আকষ্মিক আচরণকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছে। তাদের কাছে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি হালকা করতে সুজাত আলীর উদ্দেশ্যে আমার ডান হাত ও বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম আমার হাত ও বুকে খুব ব্যাথা। সুজাত আলী আগেই হতোদ্যম হযে়ছিল। এবার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখ দেখে আষাঢে়র ঘন মেঘ ভর করলো। তার অন্তরে কালবৈশাখীর ধমকা বাতাস বইতে থাকলো। আমি মনে মনে প্রতিশোধের মোক্ষম অস্ত্র সফল ব্যবহারে তৃপ্তির হাসি গোপন করতে করতে বাডি়র দিকে চললাম।
গোরস্থানে এলে মানুষের মন কোমল হয়। কবরবাসীর পরিণতি দেখে দুনিয়ার লোভ লালসা পশমিত হয়। ওলি আউলিয়াবৃন্দের এমন কথা উপদেশকালে আমিও বলে থাকি। অথচ গোরস্থানের দোড়গড়াতেই আমার পশুত্বের অবয়ব অকষ্মাৎ প্রকাশ হওয়ায় একটুও বিচলিত হইনা। বুঝতে পারি অঢেল বিত্ত বৈভব হৃদয়কে কবেই পাথর করে রেখেছে। অত্র এলাকায় এককালে যারা জমিদার ছিল কিন্তু এখন দরিদ্রতায় ডুবেছে এবং আমাদের বাবা দাদার মতো যারা ধীরে ধীরে সম্পদশালী হযে়ছে কেবল সে সব পরিবারের বৃদ্ধ যুবকদের সাথে আমি কোলাকোলি করে থাকি। যে কোনো অনুষ্ঠান বা ঈদে মুসাফা, মুয়ানাকা ও আতিথ্য প্রদানে চিহ্নিতকরণ এই রীতির ব্যত্যয় ঘটে না। অথচ সালাম, মুসাফা, মুয়ানাকা এবং আতিথিপরায়ণতার ক্ষেত্রে ধনী গরীব নির্বিশেষে সব মুসলমানের জন্য পরস্পর সমান আচরণের নির্দেশ ইসলামে স্পষ্টভাবে রযে়ছে।
আমি হাসপাতালের বেডে শুযে় নানান ভাবনায় ডুব দেই। ডাক্তার বলেছেন আমার রোগটা বেশ জটিল। প্যারালাইসিসের লক্ষণ। ডাক্তারের কথা শুনে আৎকে উঠি। স্থম্ভিত হযে় পডে় হৃদপিণ্ড। ঝডে়র কবলে পড়া পাখির মতো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি। চার দিকে বিপদ ভয়ঙ্কর সুর বেজে উঠে। এক জ্ঞাতি ভাইযে়র প্যারালাইসিস ছিল। তার জীবনের দুর্ভোগ দূর্দশা দু’ চোখে জীবন্ত চিত্রে রূপ নেয়, তার মুমূর্ষু অবস্থার স্বরূপে নিজেকে কল্পনা করি। একবার মিলিযে় দেখে কল্পিত যাতনার আর্তনাদে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকি। চিত্রটি খুবই ভয়ঙ্কর। আমার ডানপাশ হাত পা সমেত অবশ হযে় আছে। বাম হাত ও পা দিযে় কিছু করার চেষ্টা যুদ্ধের মতো কষ্ঠসাধ্য।
সেই যুদ্ধের মাঠে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত তখনই ঘটে শারীরিক অবনতির চরম অবস্থা। অন্যের বিরক্ত ও ঘৃণা মিশ্রিত সাহায্য নেওয়াটাও তিক্ততার প্রান্তে পৌঁছে। বিছানায় পেশাব পায়খানা করার মাঝে দিন অতিবাহিত হয়। অসহ্য বিকট দুর্গন্ধ ঘর ছাপিযে় সমস্ত বাডি়তে ছডি়যে় পডে়। আপন নাকও তুলো দিযে় বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়, এর মাঝে কাটে জীবন। এরই মাঝে মৃত্যুর প্রতীক্ষা। যত তাড়াতাডি় আজরাঈল আ. এসে রূহ উপডে় নেন ততোই সৌভাগ্য।
এসব বাস্তবতা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। আমার দৃষ্টি গোচরে কেবল তিনটি রাস্তা। প্রথমত: প্যারালাইসিস জীবন গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত: আত্মহত্যা করা। তৃতীয়ত: সুজাত আলীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ এখন সুজাত আলীর পক্ষেই আছেন। আমার গভীর বিশ্বাস, সুজাত আলী ক্ষমা না করলে আল্লাহ তায়ালাও আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমার আরোগ্য লাভের প্রার্থনা তিনি শুনবেন না। আমার সব সম্পত্তির বিনিমযে়ও আমি মুক্তি পাব না। নিরবে অবলোকন করে দেখি, আমার সন্তানদের চোখে মুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। কাকুতি মিনতির সাথে ডাক্তারদেরকে অনুরোধ করা ছড়া তাদের কিছুই যেন করার নেই। আমার জন্য চোখের পানি ঝরিযে় আল্লাহর কাছে দোয়া করার কথা তাদেরকে বলতে সাহস ও ভরসা পাচ্ছি। কেননা আমি সক্ষম অবস্থায় সে রকম যোগ্য করে তাদের গডে় তুলার চেষ্টা করিনি। সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালকের সম্পূর্ণ আনুগত্যের স্বরূপ তাদের গড্ডালিকা প্রবাহের শিক্ষায় কতটুকু তা পরখ করেও কোনো দিন দেখিনি। সর্বদিক নিরাশ আমি সুজাত আলীর পদধ্বনির আশায় উন্মুখ হযে় হাসপাতালের বেডে ছটফট করতে থাকি। সুজাত আলী তুমি কি শুধু একটিবার আসবে না আমাকে দেখতে? নাকি প্যারালাইসিস জীবন, নাকি আত্মহননের পথ কোনটি আমি বেছে নেব? সুজাত আলী, সুজাত আলী জপমালার অবয়ব আমার দু’চোখের কোণে নোনা জলের মাঝে গড়তে থাকে। আমি একবার ফাঁকা দরজার দিকে, একবার ধূসর ছাদের দিকে আশা নিরাশার রথে চডে় শূন্যে দোলতে থাকি।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *