যুদ্ধের গেইম

ছেলেমেয়ে দুটি মোবাইলে যুদ্ধের গেইম খেলছে। তাদের এই খেলা দেখে লেচু মিয়া মাঝে মাঝে ছোট বেলায় হারিয়ে যান। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছেন। এর পর কৃষি কাজে লাগতে হয়েছে তাকে। তাঁর ছেলেমেয়ে দুটির বয়স বেশি নয়। মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। তাদের খেলার ধরণ দেখে তিনি বেশ আশ্চর্য হন। একটি ঘরে বসে বসে মোবাইলে আবার খেলা যায় নাকি! খেলার ছলে দৌঁড়ানো-লাফানোর মাধ্যমে ব্যায়াম করা হয়। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। শরীরে রোগবালাই কম আসে। এটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন এমন বদ্ধ ঘরে বসে বসে খেলা করা যায় তা ভাবতেই পারতেন না। তাও আবার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
তিনি ছোট বেলার সাথীদের নিয়ে যুদ্ধের খেলা করেছেন। তারা এই খেলার ধারণা পেয়েছিলেন স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে বিটিভিতে প্রচারিত চলচিত্র দেখে দেখে। যুদ্ধের খেলায় একদল পাকিস্তান, অন্য দল থাকতো ভারত। কখনো একদল হয়েছে বাংলাদেশ আবার অন্য দল হয়েছে পাকিস্তান। লেচু মিয়া খেলার প্রত্যেক দিনই বাংলাদেশ দলের ছিলেন। কারণ খেলার নিয়মই ছিল বাংলাদেশ দল এই যুদ্ধ খেলায় জিততেই হবে। যতক্ষণ-না প্রতিপক্ষ দল হার মেনে পালিয়ে না গেছে ততক্ষণ খেলা বাধ্যতামূলক। সুতরাং বাংলাদেশ দল সবদিন যুদ্ধ খেলায় বিজয়ী হতো। লেচু মিয়া হাল ছাড়তেন না। দশ বাড়ি দাপিয়ে বেড়াতেন হানাদার বাহিনীর খোঁজে। যেন বাস্তবেই তিনি যুদ্ধ করছেন। তাঁর একটি রাইফেলও ছিল। মেলা থেকে কিনেছিলেন। কাঠ ও প্লাস্টিকের তৈরি। তবে গুলি যে-নল দিয়ে বের হতো সেটা ছিল টিনের। ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি বরই-য়ের বিচিকে গুলি বানাতেন। টিন দিয়ে তৈরি স্টিগার চাপলেই শব্দ করে বরই বিচির গুলি বের হতো। প্রায় বিশ হাত দূর পর্যন্ত যেতে পারতো সেই গুলি। কারো উদোম গায়ে গুলি লাগলে হালকা ব্যথাও মিলতো। এই একটি বন্দুকে পুরো তিন বছর চলেছে লেচু মিয়ার। অতি যতেœ তিনি এটি রাখতেন। কাউকে স্পর্শ করতে দিতেন না। আর কেউ হাতে নিলেও বন্দুকের স্প্রিং স্টিগার টেনে গুলি ভরতে পারতো না। সেটি বেশ মজবুত ছিল।
যুবক হয়ে লেচু মিয়া ভাল করে জানতে পেরেছেন একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধের কথা। এর আগে জানলেও সেটা ছিল ভাসাভাসা। তিনি এখন পরিপূর্ণভাবে জানেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তখন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা শোষণ করতো বাংলাদেশের মানুষ-জনকে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে যুদ্ধের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাস চলে মুক্তির লড়াই। এই যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করে। তারা নিরস্ত্র মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ছিল বেশ নির্মম। ভাল করে শুনলে চোখে পানি জমে উঠে।

https://avijatrik.com/wp-content/uploads/Wargames-2.jpg


লেচু মিয়া রোমে ঢুকে দেখলেন আজও ছেলেমেয়ে দুটি মোবাইলে গেইম খেলছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা কী গেইম খেলছো এখন?
দুজনে সমকন্ঠে উত্তর দিলো-‘মুক্তিযুদ্ধের গেইম খেলছি বাবা।
-ভাল। গেইমে কে জিতে আর কে হারে?
মেয়েটি উত্তর দিল-আমি সবসময় জিততে পারি, কিন্তু তোমার ছেলে সবসময় হারে।
-তাই নাকি! আচ্ছা মা, বলো দেখি মুক্তিযুদ্ধ কত সালে হয়েছিল?
-১৯৭১ সালে হয়েছিল।
-ঠিক বলেছো। তোমরা বলো দেখি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কত তারিখ?
ছেলেটি সাথে সাথে বললো-১৬ ই ডিসেম্বর।
লেচু মিয়া বললেন-হয়নি বাবা। ১৬ ই ডিসেম্বর হলো বিজয় দিবস। স্বাধীনতা দিবস ২৬ শে মার্চ। সেদিন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত মানুষজনের উপর গুলি চালাতে থাকে। পরের দিন থেকে শুরু হয় পুরোদমে যুদ্ধ। তোমরা যদি স্বাধীনতার ইতিহাস ভালোভাবে না জানো তাহলে স্বাধীনতাকে চিনতে পারবে না। আর মোবাইলে মুক্তিযুদ্ধের গেইম খেলেও আনন্দ পাবে না।
লেচু মিয়ার ছেলে এবার বললো-বাবা রাগ করবেন না। আমি ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঠিকই জেনে নেব।
লেচু মিয়া মুখে হাসির রেখা টেনে মিষ্টি করে বললেন-ঠিক আছে বাবা, তুমি সেগুলো শিখে নিও। আর এতেই তোমার গেইম খেলা সার্থক হবে, মনে আনন্দ পাবে এবং দেখবে মুক্তিযুদ্ধে তুমিই জিতছো।

Comments

comments

About

Check Also

ছন্দ-গল্পে নতুন দিন

নতুন বছরের প্রথম দিন আজ। স্কুলে তেমন উপস্থিতি নেই। দশম শ্রেণিতে শিক্ষক ক্লাস নিতে এলেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *