কোন পরিবেশে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম-এর আগমন ঘটেছিল?

সাইয়্যিদুল কাউনাইন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পবিত্র সীরাত আলোচনার প্রারম্ভে মোটাদাগে দুটি প্রশ্ন সামনে আসে। একটি হলো- আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিব (স.)-কে পৃথিবীর মানবকুলে প্রেরণ করার জন্য কেন খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীকে বেছে নিলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে-কেনইবা জাজিরাতুল আরবে আল্লাহ তাঁর নবী (স.)-কে প্রেরণ করলেন?
দুটি প্রশ্নই অত্যন্ত যৌক্তিক এবং এগুলোর উত্তর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সীরাত আলোচনা ভূমিকাহীন থেকে যায়।
উলামায়ে কেরাম এ প্রশ্নদুটির উত্তর খুঁজে বের করেছেন।
৬ষ্ঠ খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে নবী করিমের (স.) শুভাগমনের পেছনে যে খোদায়ী প্রজ্ঞা নিহিত, তা বুঝতে হলে সে-সময়কার মানবসভ্যতা ব্যাপ্তিত চলমান জীবনধারা সম্বন্ধে একবার দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। কী ছিল তৎকালীন পৃথিবীর ধর্মীয় অবস্থা? কোথায় ছিল সামাজিক মূল্যবোধ? কিভাবে চলছিল রাজনীতির আগাগোড়া? আসুন একটু জানি।
ঐ শতাব্দীতে এসে ইবরাহিমী ধর্মগুলো কেন যেন নিজেদের নামের প্রতি স্পষ্ট অবিচার করা শুরু করল। মানবজাতিকে সুপথ প্রদর্শনের গুরুদায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। বিকৃতির বেড়াজালে আটকে ধুকতে থাকা ‘তাওহিদ’ যখন ইনকিলাবের আহ্বান করছিল, পৃথিবীতে তাওহিদের প্রচারক ইবরাহিমী ধর্মসমূহ তখন প্রাণহীন পাথরের মূর্তি সেজে নিথর দর্শক সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছিল।
ইহুদি ধর্ম :
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এককালের ইহুদি ধর্ম সেসময় কতেক মৃত প্রথা-পার্বণ আর নিছক কল্পনা সর্বস্ব রীতিনীতির মিশ্রণে দীপ্তিহীন হয়ে গিয়েছিল। নবী ইবরাহিম (আ.) থেকে প্রাপ্ত তাওহিদের যে সুমহান শিক্ষা নবী ইয়াকুব (আ.) তাদের দায়িত্বে ছেড়ে গিয়েছিলেন, তার হেফাজত করতে সম্পুর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল ইহুদিরা। শক্তিশালী প্রতিবেশী আর বিজয়ী প্রতিপক্ষের সরব পদচারণায় ইহুদিরা মূল ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ইহুদিদের ফিকহের কিতাব “তালমূদে” এমন কতিপয় রীতিনীতি প্রবেশ করেছিল যা ছিল স্বয়ং ইবরাহিমী দ্বীনের বিরোধী। বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি খোদ তাওরাতও। এছাড়া ইহুদি ধর্মটি ছিল অতিমাত্রায় রক্ষণশীল। তারা একে বনী ইসরাইলের নিজস্ব ধর্ম মনে করতো এবং অন্যদেরকে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকত।
কোন পরিবেশে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম-এর আগমন ঘটেছিল?
খ্রিস্ট ধর্ম :
খ্রিস্ট ধর্মের পোড়াকপালে শতজনের বদনজর লেগেছিল। সোনালি শৈশব নির্ঝঞ্ঝাটে পেরুতেই মূর্খ পাদ্রী-পুরোহিত এবং নব-খ্রিষ্টান রোমানদের আগ্রাসনে ধর্মটি চরম বিকৃতি লাভ করেছিল। নবী ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) এবং তাঁর হাওয়ারিনদের আদর্শ ধারণ করা লর্ড এরিয়াসকে বিতাড়িত করে সম্রাট কন্সটেনটাইন এই বিকৃতির ষোলকলা পূর্ণ করেছিলেন। তিনিই খ্রিস্ট ধর্মে তাওহিদ-পরিপন্থী Trinity-র ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর গির্জায় প্রবেশ করে অহংকারী পুরোহিতদের হাতে জনমের মতো বন্দী হয়ে যায় ধর্মটি। কিছু লোক আবার সন্যাস গ্রহন করে।
মাজুসী বা জরাথ্রুস্টবাদ :
জরাথ্রুস্টের প্রতিষ্ঠিত Zoroastrianism (মাজুসী) সর্বদাই কুসংস্কারের চাদরে আচ্ছাদিত ছিল। তারা ছিল আগুন, সূর্য ও প্রকৃতির পূজারী এবং দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। মাজুসীরা একদিকে সৃষ্টির উপাসনা করে নিজেদের অসহায়ত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছিল। অপরদিকে যুগে যুগে দুই খোদার অস্তিত্ব তাদের অবস্থানকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। Zoroastrianism-এ ‘আহুরা মাযদা’ নামে একজন ভাল খোদা এবং ‘আহুরা মানয়ু’ নামক একজন দুষ্টু খোদা রয়েছেন।
বৌদ্ধ ধর্ম :
ভারত থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভকারী বৌদ্ধধর্মও পৌত্তলিকতায় মজেছিল। যে ধর্মের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ খোদার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছিলেন, সেই বৌদ্ধধর্মের অনুসারীগণ বুদ্ধকেই খোদা বানিয়ে দিল। তারা যেখানে যেত, সেখানেই বুদ্ধের মূর্তি নিয়ে যেত।
হিন্দু ধর্ম :
ভারতের সুপ্রাচীন লোকপ্রিয় হিন্দু ধর্মে দেব-দেবীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তেত্রিশ কোটিতে গিয়ে ঠেকেছিল। প্রত্যেক চমকপ্রদ, ভীতিকর কিংবা নান্দনিক বস্তুকেই তারা খোদার আসনে বসিয়েছিল। হিন্দু ঐতিহাসিক ) O’Malley এর ভাষায়, যুগেযুগে খোদার সংযোজন হতে হতে সেখানে এক বিশাল খোদার বাজার জমে উঠে।
আরবের পৌত্তলিকতা :
আরবরা, যারা ছিল নবী ইবরাহিমের (আ.) হাতেগড়া তাওহিদী কাফেলা, তারাও এতোদিনে পৌত্তলিকতায় মজে উঠেছিল। বনু খুযায়া বংশের জনৈক আমর ইবনে আমের ইবনে লুহাই আল খুযায়ী নবী ইসমাইলের (আ.) দ্বীনের মধ্যে সর্বপ্রথম কুসংস্কার এবং শিরকের বীজ বপন করেছিল (সূত্র : সহিহ মুসলিম)। ইতিহাস মতে, সম্ভবত সে কুরাইশদের পূর্বপুরুষ ফিহরের সমসাময়িক অর্থাৎ ১ম খ্রিস্টীয় শতাব্দীর লোক ছিল।
সে একদা সিরিয়ার আমালিকা সম্প্রদায়ের বাসস্থানে ভ্রমণ করেছিল। সেখানে সে ঐ সম্প্রদায়কে মূর্তিপূজা করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী? তারা বলল, এগুলো আমাদের শক্তি ও ক্ষমতার উৎস। তখন আমর ইবনে লুহাই এগুলোর মধ্য থেকে একটি মূর্তি আরবে নিয়ে আসল যার নাম ছিল হোবল। হোবলই হচ্ছে ইবরাহিম (আ.) পরবর্তী আরবের পবিত্র ভূমিতে প্রবেশকারী প্রথম মূর্তি। সে হজের তালবিয়া পর্যন্ত পরিবর্তন করল। ধীরেধীরে আসে লাত, মানাত, উযযাসহ কয়েকশত মূর্তি। শুরু হয় মূর্তিপূজা, উলঙ্গ হয়ে কা’বার চক্কর কাটা, বলী দেয়াসহ নানাবিদ নষ্টামি। তাওহিদের তীর্থস্থল মক্কা মুকাররামায় স্থায়ীভাবে শিরকের কালিমা লেপন করা হয়।
এভাবেই চলছিল খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রধান ধর্মগুলো। বানোয়াট খোদাদের ভিড়ে সমগ্র জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নাম নেয়ার মানুষ ছিল হাতেগোণা কয়েকজন। আর এমনই পরিবেশে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেছিলেন।

Comments

comments

About

Check Also

আল-কুরআনের আলোকে একনজরে মহানবি স.-এর পরিচয় ও অধিকার

মহানবি স.-এর গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়-০১আল-কুরআন অনুসারে তিনি ছিলেন একাধারেÑ১. নবি২. রাসুল৩. উম্মি বা অক্ষরজ্ঞান অর্জন না …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *