মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সুফি চেতনা

লক্ষ লক্ষ দামাল সন্তানের তাজা রক্ত ঝরিয়ে, অগনিত মা বোনের ইজ্জত হারিয়ে, শাষক-শোষকের বিরুদ্ধে, দীর্ঘ নয় মাস আপোষহীন সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এই স্বাধীনতা অর্জনে যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার পেছনে ও ছিল কতগুলো চেতনা ও মূল্যবোধ, যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই অসংখ্য মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল।
দেশ শত্রুমুক্ত করে একটি শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা, খাদ্য বস্ত্রে স্বয়ংসম্পুর্ণতা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য সুষ্টভাবে গড়ে উঠা, মানুষের জান-মাল ইজ্জতের নিরাপত্তা ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্টিত করে একটি সুখী, স্বাধীন ও সর্বভৌম জাতি হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আর এই চেতনা তৈরির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মেধাসম্পন্ন একঝাঁক নবীন, প্রবীণ লোক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনবদ্য জীবনী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মূলত আমাদের মাপকাঠি হওয়া উচিত।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিতর্ক হয়। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজ্স্ব ফায়দা লাভের লক্ষ্যে এটাকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। কথায় কথায় অভিযোগ তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে !!কিন্তু আসলেই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ধারণ করে যারা জীবন দিয়েছিল তাদের অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশ হবে শোষক মুক্ত, সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়া একটি স্বাধীন সর্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিকতাই যেন আমাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন হয়ে গেছে আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কথা সর্বজনবিদিত যে দুর্নীতির কারণে আমাদের স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। তাই ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শোষক-শোষনমুক্ত করে সমতা ও ন্যায়ানুগ একটি সমাজ যদি প্রতিষ্টিত হয় তাহলেই রক্ষা পাবে বাংলাদেশ, সুরক্ষিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সুফি চেতনা
শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলাদেশের এই পবিত্র ভূখন্ডে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এদেশের মানুষ ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লাল সুর্য, গড়ে তুলেছে সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধারা স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিল ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধে থেকে । কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আমরা লক্ষ্য করছি, স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা ১৯৭১ নিয়ে কিছু মানুষ ইসলাম ও ইসলাম পন্থীদের ওপর ঢালাওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তথাকথিত সুশীল সমাজ মনে করে ইসলাম ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরস্পর বিরোধী। পরোক্ষ ভাবে বলতে চায়, ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, ইসলামের বিরুদ্ধে। বিষয়টা যেমন পীড়াদায়ক তেমনি হাস্যকরও বটে। যারা একাত্তরের চেতনার মূলভিত্তি থেকে ধর্ম বাদ দেওয়ার কথা বলেন, তাদেরকে দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, একাত্তরে ধর্মপ্রাণ জনতার বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে ভণ্ডামি করে যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, সেই জালিমরা ছিল ধর্মের নামে অতি ক্ষুদ্র গোষ্টী। একাত্তরে তাদের সংখ্যা দেশের মোট মুসলমানদের ০.৫%ও ছিল না। তাই তাদের দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলভিত্তি থেকে ধর্মকে বাদ দেয়া ধর্মবিদ্ধেষ ছাড়া আর কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধ কোন সামরিক যুদ্ধ ছিল না, এটা ছিল এক সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি নিরস্ত্র, ভূখা, মেহনতি জনতার এক অসম লড়াই। আর আল্লাহর রহমত না থাকলে এমন অসম লড়াইয়ে এই জাতির পক্ষে বিজয় লাভ সম্ভব হত না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাই তার বক্তব্যে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে বলেছিলেন, ’এই দেশকে হানাদারমুক্ত করবোই ইনশাআল্লাহ’।
মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়, এটা ধর্মপ্রাণ জনতার হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা, চেষ্টা ও মহান রবের অনুগ্রহের ফসল। তাইতো কবি শামসুর রহমান তার কবিতায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি পিতার জায়নামাজের উদার জমিন’
আরো সুস্পষ্ট করে বললে, এই দেশের ওলী আউলিয়া ভক্ত নবী প্রেমিক লক্ষ কোটি মুসলমান বরাবরই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। বাংলাদেশের অনেক ওলী আউলিয়ারা সে সময় বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য সংখ্যালঘু (হিন্দু/বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান) নিরীহ জনতাকে আশ্রয় দিয়ে লঙ্গরখানা খুলে দিয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইমাম-মুয়াজ্জিনরা শুধু মসজিদেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেন নাই, বরং এক হাতে তাসবিহ আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে দেশের লাল-সবুজ পতাকার জন্য যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন, এদের অনেকেই বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শহীদ হয়ে দেশের ইতিহাসে অমর হয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের মহান ওলীদের অবদান অনস্বীকার্য।
শুধু একাত্তরে নয়, একাত্তরের পরেও প্রকৃত মুসলমানরা স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই বলতে চাই-এই দেশে যতদিন ওলী আল্লাহদের অনুসারীরা জীবিত থাকবে, জীবনের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও লাল-সবুজের মান রক্ষায় সদা প্রস্তুত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

তথ্যসুত্র
(১) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন।
(২) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তবতা, গোলাম মোহাম্মদ কাদের
(৩) ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারায়, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
(৪) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, (রিশরঢ়বফরধ).
(৫) মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজ, মাওলানা মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *