পবিত্র লাইলাতুল কদর : নেক আমলের স্বরূপ

আরবিতে লাইলাতুল শব্দের অর্থ হলো রাত আর কদর শব্দের অর্থ হলো, সম্মান বা মর্যাদা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ ’র সমষ্টিগত অর্থ দাঁড়ায় সম্মানের রাত বা মর্যাদার রাত। কদর শব্দের আরো একটি অর্থ হলো সিদ্ধান্ত করা বা নির্ধারণ করা। এ হিসেবে ‘লাইলাতুল কদর অর্থ হবে সিদ্ধান্তের রাত বা নির্ধারণের রাত।
পবিত্র ‘লাইলাতুল কদর’ সকল রাতগুলোর রাজা। অসংখ্য অগণিত অলৌকিক ঘটনা এ রাতে সংগঠিত হওয়ায় এর মর্যাদা সীমাহীন। এ রাতের ফযিলত বর্ণনায় স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিপূর্ণ একটি সূরা (সূরা কদর) অবতীর্ণ করেছেন এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য সহীহ হাদীস রেখে গেছেন। এখানেই এ রাতের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দিবালোকের ন্যায় প্রস্ফুটিত। পবিত্র লাইলাতুল কদরের ফদ্বিলত সম্পর্কে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফের একখানা হাদীসের অনুবাদ নিুরূপ। হজরত আবু হুরায়রাহ (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-“যে ব্যক্তি শবে কদর ঈমান সহকারে সাওয়াবের নিয়মে ইবাদতে কাটিয়ে দেয়, তার পূর্ববর্তী জীবনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হয়।”
তাই এ গুরুত্বপূর্ণ রাতে নেক আমলের স্বরূপ সংক্ষিপ্তকারে নিুে উপস্থাপন করা হলো।

নফল নামাজ পড়া : নামাজ হলো সকল ইবাদতের মূল নির্যাস। নামাজের মাধ্যমেই বান্দাহ আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভ করে থাকে। নামাজের মাধ্যমেই বান্দাহ আল্লাহর দরবারে সার্বিকভাবে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে প্রকাশ করার প্রয়াস পায়। এ জন্য নামাজ আল্লাহর নিকট এত পছন্দনীয়। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত নামাজ আদায় করে যারা বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করেন তারাই আল্লাহর ওলীরূপে একদিন জগতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। এ রাতে নফল নামাজ পড়ার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যত রাকায়াত ইচ্ছা যে কোন সূরা বা আয়াত দ্বারা পড়া যায়। তবে বুঝুর্গানে কেরাম সূরা কদর ও সূরা এখলাছ দ্বারা বেশি বেশি পড়তেন।
কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা : নফল ইবাদতের মাঝে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত হলো বড় ইবাদাত। রাসূলে পাকের বাণীর অনুবাদ হলো-‘কুরআন তিলাওয়াত করা সর্বোত্তম (ফরজ বাদে) ইবাদত।’
কুরআন তিলাওয়াত দ্বারা মানুষের অন্তরের কালিমা দূরীভুত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলে পাকের বাণী-‘নিশ্চয় এই অন্তরসমূহে এমনভাবে মরিচিকায় ধরে, লোহাতে পানি লাগলে যেভাবে মরিচিকা ধরে।’ সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন-‘হে আল্লাহর রাসূল! এই মরিচিকা দূর করার উপায় কী? নবীজি এরশাদ করলেন, ‘বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা।’ রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন-‘যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার জন্য একটি হাসানাহ বা পূণ্য নির্ধারণ করা হবে। আর এই একটি হাসানাহ (নেকি) দশ নেকির সমান। আমি বলি না আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।’ অর্থাৎ-‘আলিফ লাম মীম’ পাঠ করলে তিন দশে ত্রিশ নেকি পাওয়া যায়। সুতরাং মর্যাদাশীল লাইলাতুল কদরে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত আমাদের জন্য বেশি উপকারী। ফজিলতপূর্ণ এ রাতে এ সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক নয়।

দরুদ শরীফ পাঠ করা : ইবাদত বন্দেগী আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুরুদ শরীফ একটি সেতু বন্ধন। আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের সন্তুষ্টি অর্জন করা এ দুরুদ দ্বারা সম্ভব। আল্লাহ পাকের নির্দেশ ও তাই-‘হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ কর।’ মুজামুল আওসাত গ্রন্থে বর্ণিত আছে, হজরত আলী (রাদ্বি). বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ও তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি দুরুদ শরীফ পড়া না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সকল প্রকার দোআ ঝুলন্ত থেকে থাকে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয় না। তিরমিজী শরীফের রেওয়াত হজরত ওমর (রাদ্বি.) বলেন, নবীর উপর দুরুদ শরীফ না পড়া পর্যন্ত বান্দার দোআ আসমান ও জমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।’ এছাড়া বিশ্বনবীর পাক দরবারে পরিচিতি লাভের প্রধান মাধ্যম হলো দুরুদ শরীফ। সুতরাং কদরের রাতে বেশি বেশি দুরুদ পড়া বাঞ্চনীয়।

কবর জিয়ারত করা : পবিত্র লাইলাতুল কদরে মুর্দাগণের কবর জিয়ারত করা এবং তাদের জন্য মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দি কামনা করা জীবিত ওয়ারিছদের উপর নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সব সময় পালন করা প্রয়োজন। তবে লাইলাতুল কদরের গুরুত্বের কারণে এ রাতে জিয়ারতের উপকারিতা অনেকগুণ বেশি। হাদীস থেকে জানা যায় কবরের মুর্দাগণ নদীতে নিমজ্জমান ব্যক্তির মতই বিপদগ্রন্থ। তারা জীবিত ওয়ারিছগণের নিকট সাহায্যপ্রার্থী। মহিমান্বিত সম্মানিত কদরের রাতে মুর্দাগণের উদ্দেশ্যে ঈসালে সাওয়াব করা উচিত।

ইস্তিগফার করা : মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে অনেক পাপ কাজ করে বসে। এ পাপ কাজ থেকে মুক্তি দানের জন্য আল্লাহ পাকের ঘোষণা-‘হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার ঐ বান্দাদেরকে বলে দিন, যারা নিজেদের জীবনের উপর অত্যাচার করেছে, তারা যেন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমতাশীল ও দয়ালু।’ (আল-কুরআন)
হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ হতে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-‘যেই ব্যক্তি গোনাহ হতে তাওবা করে, সে এমন ব্যক্তির মত হয়ে যায়, যার কোন গোনাহ নেই। (ইবনে মাজাহ)
গোনাগারের চোখের পানিতে আল্লাহ পাকের ক্রোধের আগুণ নিভে যায়। গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ পাক খুবই খুশী হন। তাই লাইলাতুল কদর বা মর্যাদাশীল রাত্রে আল্লাহর নিকট বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা আমাদের জন্যে অবশ্য করণীয়। আম্মাজান আয়শা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, যদি আমি শবে কদর সম্বন্ধে অবহিত হয়ে যাই যে, তা কোন রাত্রি, তাহলে আমি এ রাতে কি প্রার্থনা করব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি বলবে, হে আল্লাহ, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমাকে পছন্দ কর, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও।’(তিরমিযি শরীফ)
উপরিউক্ত নেক আমলগুলো যদি লাইলাতুল কদরে করা যায়, তবেই সার্থক হবে এ পবিত্র রাতের আগমন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে নেক কাজ করার তৌফিক দান করুন।

Comments

comments

About

Check Also

আমরা রোজাদার হই

আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রামাদ্বান। রহমত, মাগফিরাত, আর নাজাতের স্রোতদ্বারা বয়ে যাবে এ মাসে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *