ধর্মীয় বক্তা ও ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে মানুষ

এক সময় এমন ছিল যে, মুসলমান মাত্রই কোনো না কোনো ধর্মীয় বক্তার ভক্ত বা কোনো ধর্মভিত্তিক দলের অনুস্বরণ করত। সাধারণ মুসলমানের দৃঢ় ধারনা ছিল ধর্ম পালন করতে হলে ধর্মীয় প্রাজ্ঞদের কথা মেনে চলতে হবে এবং ধর্মভিত্তিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে হবে। মহানবী (সা:) ও তাঁর সাহাবীদের যুগের পরে ও সারা বিশ্বের মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় পরিপূর্ণ আলেমদের উপর আস্থা রেখে ধর্ম-কর্ম পালন করত। বিশেষ করে মাযহাবের চার সম্মানীত ইমামদের কারো না কারো অনুসারী ছিল বিশ্বের সব মুসলিম। কিন্তু বর্তমান সময়ে সাধারণ মুসলমানরা ধর্মীয় ব্যাক্তিদের ও ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে। এখন বিশ্বের সব মুসলিম দেশ এবং অমুসলিম দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ও এশিয়ার সব মুসলিম দেশে বিভক্তি আর হিংসাত্মক বক্তব্য শুনে ধর্মীয় নেতাদের ও দলের প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আরবের বিভিন্ন দেশে “ধর্ম ও সম্প্রদায়কে না বল” শ্লোগান জোরগলায় শোনা যাচ্ছে।” ধর্ম কে না না বল; জাতির জন্য লড়াই কর” হুজুরেরা স্বার্থপর; নিজে বুঝে পথ ধর”।আমাদের বাংলাদেশে “ওয়াজ মানে গালাগালি; ওয়াজ মানে ফালাফালি” গানে গানে ওয়াজ;ওয়াজ নয় আওয়াজ” দ্বীনের জন্য ওয়াজ নয়;দলের জন্য সব কয়”ও”ইলিম আমল বুঝিনা;সুর ছাড়া ওয়াজ না” এখন এটাই বাস্তবতা।


আগেকার যুগে মানুষ বলত অমুক ছাব এই ওয়াজে আসবেন আর এখন বলে অমুক কমেডিয়ান হজুর, অমুখ গায়ক হুজুর, অমুক কাফির বলা হুজুর ও অমুক লাফানি হুজুর ওয়াজে আসবেন। আরব দেশগুলোর মধ্যে নিয়মিত জরিপ পরিচালনারারী সংস্থা ‘আরব ব্যারোমিটার ‘সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৮ -১৯ সালে এক-তৃতীয়াংশ নেমে এসেছে। অন্য এক জরিপে ২০১২-১৪ সালে ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষের আস্থা থাকলেও ২০১৮-১৯ সময়ে তা ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলত আরববিশ্বসহ সারা মুললিম জাহানে অনাস্থার হার দ্রুত বাড়ছে। নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দিতে চাননা, এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ধর্মীয় নেতাদের প্রতি। নেতাদের সংকীর্ণমনা বক্তব্য ও দ্বীনের স্বার্থ না দেখে দলের ও নিজের স্বার্থে বক্তব্য প্রদান করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিজ মতবাদ প্রচারে প্রায় সব নেতারা অঘোষিত প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। আজ সেই সব বক্তাদের বাজার গরম; যারা বক্তব্যে প্রমাণ করতে পারেন যেন,পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র হক্ব; আর বাকী সব বাতিল। যেখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী থাকার কথা, সেখানে অন্য ইসলামী দলকে হটিয়ে মসজিদ -মাদ্রাসা ও গদি দখল কিভাবে করা যায় তার কর্মসূচী দিচ্ছে সবকটি দল। এক ইসলামী দলকে তাড়িয়ে এসব দখল করে আত্মতৃপ্তিতে বলছে -ইসলামের অনেক বড় বিজয় করেছি, যা রীতিমত হাস্যকর ও ভন্ডামি বৈকি।
বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক যে অবস্থা বিরাজ করছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় যুব ও ছাত্র সমাজ যেভাবে নাস্তিক -মুরতাদ হচ্ছে, চলচ্ছিত্র ও নাটকের নামে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পৃষ্টপোষকতায় অশ্লীলতা, নাস্তিকতা ও ধর্মহীন কর্মকাণ্ড যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুক্তমনার নামে যে ভাবে ব্রেইন ওয়াশ করে ধর্ম থেকে মানুষকে সরানো হচ্ছে, এনজিওর নামে যেভাবে আমাদের ঈমান আকিদা ধ্বংস হচ্ছে, ধর্মীয় গুরুরা ও ইসলামী দলগুলো কি এসব রুখতে কোন যুগোপযোগী কর্মসূচী দিচ্ছেন! বরং আমাদের পণ্ডিতগণ তাঁদের জ্ঞানের ভাণ্ডার শুধু অন্য ইসলামী শক্তিকে গায়েল করতে খরচ করছেন।
আরেকদল উলামা হয়েছেন যারা সরকার থেকে বাহবা আর কিছু পকেট মানি পাওয়ার জন্য হক্ব কথা ভুলে সরকারের বন্ধনা গেয়ে যাচ্ছেন। প্রায় সময় শুনি “কোন দলে যাব? কোন হুজুরের সঙ্গ ধরব? এক হজুর বলে আরেক হজুরকে কাফির, বাতিল, ভণ্ড ও বেদাতী। বক্তাদের অবস্থা সাধারণ মানুষের কাছে সেই তিন ব্রাহ্মণের মতো যারা একে অন্যকে তুচ্ছ করে একেক জন বলেছিল -আমিই সব ওদের বাকী দু’জন গরু ও ছাগল। তাই প্রায় ৫০% মানুষ বর্তমানে বলে এসব হুজুরদের ছেড়ে একলা চলাই ভাল।
প্রিয় নবীজি ‘আল উলামাউ ওরাসাতুল আম্বিয়া’ বলে তাদের হাতে উম্মতকে বিভক্তির দায়িত্ব দিয়ে যাননি। সুতারাং ব্যক্তি ও নিজ মতবাদ প্রচারে অগ্রাধিকার না দিয়ে নবীজির রেখে যাওয়া দ্বীন প্রতিষ্ঠায় দলের কর্মসূচী ও বক্তব্য দেয়া সময়ের সেরা চাহিদা এখন। যদি হিংসাত্মক বক্তব্য ও কর্মসূচী থেকে এখন বেরিয়ে না আসা যায়;তাহলে আর বেশীদিন দূরে নয় বক্তা ও ইসলামী দলের প্রতি মানুষের আস্থা শূণ্যের কোটায় চলে যাবে। তাই আসুন মহান আল্লাহর নামে শপথ করে বলি আজ থেকে দ্বীনের বৃহৎ স্বার্থে বিভক্তির বক্তব্য ও কর্মসূচী পরিহার করি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *