গুনাহ; কাফিররা করে না। কোন বিধর্মীরা করে না। মুশরিকরাও করে না। ওরা আদতেই জাহান্নামী। এখানে তাদের দুখূল (প্রবেশ) হবে স্থায়ীভাবে। তাহলে কারা করে?হুম, মুমিনরা গুনাহ করে। মুিমন মানে হলো সর্বপ্রথম আল্লাহতে বিশ্বাসী- কোন শরীক ছাড়াই। আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী-রাসুলে বিশ্বাসী। তারপর ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, মৃত্যু, কবর, হাশর-নাশর, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি অকাট্য প্রমাণিত সকল বিষয় যা কুরআনে বিধৃত হয়েছে, তার প্রতি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসী।
এ সংজ্ঞার আলোকে যারা মুমিন, তাদেরকে শুধু ইবাদত বা আমলের কাজই দেওয়া হয়েছে। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তাই ঈমান আনার পর বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে বারবার তিনি আমাদেরকে আমল করার কথা বলেছেন। (হুকুমের শব্দে) একটি বারের জন্য কোথাও বলা হয়নি, গুনাহ করো, মাফ চাইলে মাফ করে দেবো। (নাউজুবিল্লাহ) বরং এভাবে বলা আছে, ‘(হে নবী) আমার বান্দাদের আপনি জানিয়ে দিন, নিশ্চয় আমি, হ্যাঁ আমিই পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ তবে বান্দা প্রবৃত্তির জন্য দূর্বল ঈমানের কারণে পাপ করবেই, তবে এটা আল্লাহর আদেশ নয়। তাই আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, (গুনাহ করতে করতে মন পাথর কিংবা সংকুচিত হলেও) ‘তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না…
অতএব যখনই মুমিন আমল থেকে পিছিয়ে পড়ে, তার জন্য গুনাহের দ্বার আরো নিকৃষ্ট ভালোভাবে ও সহজভাবেই উন্মুক্ত হয়ে যায়। একারণে যুগেযুগে প্রিয় বান্দারা সে উপায়গুলো তাদের কিতাবে বর্ণনা করে গেছেন। তো গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার যে উপায় তারা বাতলে গিয়েছেন, সেগুলো তো আছেই; সময়ের বিবর্তনে, ফেতনার বৃদ্ধিতে বর্তমান যুগে আরো শক্ত উপায় করে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ফেতনা দ্বার যত সহজে উন্মুক্ত হবে, উপায় নির্ধারণের দ্বার তত কঠিন হবে।
১. প্রথম কর্তব্য আল্লাহর সেই আয়াতের বাস্তবায়ন। যে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সত্যবাদীদের সাথী হও।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই সবচে কঠিন উপায়, তবে মানসিকতা প্রস্তুত থাকলে এটির বাস্তবায়ন সবচে সহজ। আল্লাহর প্রিয় বন্ধুদের সোহবতে যেতে হবে। তাদের সাথী হতে হবে। কারণ হাদীসে এসেছে, যে যাকে ভালোবাসে, তার সাথেই তার কিয়ামত হবে।’ তাহলে ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। তাদের সাথী হতে হবে। তারাই তো আমাদেরকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের পথে এগিয়ে নিতে নিষ্ঠার সাথে সাহায্য করবে। নিকৃষ্ট মানুষের সোহবত কখনোই এটা করে দেবে না। আবার ভালো মানুষদের সাথে থাকলে দুনিয়াবী খাহেশ খুব সহজেই লোপ পায়, প্রবৃত্তির আগুন সহজেই নির্বাপন করা যায়। আর আল্লাহ ও নবীজীর কথা ক্ষণেক্ষণে মনে উকিঁ দেয়, ইশকে হৃদয়ে দোলা জাগে। হাদীসে এসেছে, আল্লাহর বন্ধু (অলী) তো সেই, যাকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।
অতএব আমাদের উচিত, খুব উচিত, যাদেরকে দেখলে মনে হয় তারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের সোহবতে যেতে হবে। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। সম্পর্ক ক্রমে ক্রমে গভীর করতে হবে। আমাদের ভাবনা যেন আমাদেরকে বাধ্য করে এটা মানতে যে, আল্লাহর বন্ধু বা ভালো মানুষ যারা হয়, তাদের অনেক দাম, অনেক সম্মান। অতএব আমাদের কর্মের দ্বারা কোনভাবেই যেন তাদের সম্মান ক্ষুণœ না হয়।
২.দ্বিতীয় কর্তব্যটাও সহজ। কিন্তু অন্তর পাথর হয়ে থাকলে তা কঠিন। আমাদের কর্তব্য কাঠিন্যকে সহজে পরিণত করা। এরজন্য উপায় হলো, তা বারবার করতে থাকা। সে কর্তব্যটা হলো, ইস্তেগফার করা। আল্লাহু আকবর! আল্লাহর দয়া আমাদেরকে ইস্তেগফারের মতো নিয়ামত দিয়েছে। এ নেয়ামত না থাকলে আমরা ক্ষমা চাইতে পারতাম না বা সুযোগ থাকতো না, কিন্তু গুনাহগুলো থেকে যেতো।
আল্লাহ গুনাহ করার আদেশ করেননি, কিন্তু বান্দার গুনাহ হয়ে গেলে ইস্তেগফারের আদেশ করেছেন। কারণ বান্দার প্রবৃত্তি, লোভ গুনাহের দিকে ধাবিত করবেই। শুধু নবী-রাসুলগণ মাছুম বা নিষ্পাপ। আর আল্লাহর অলীরা মাহফুজ (গুনাহ থেকে হেফাজতে রাখা হয়)। সাহাবীরা হলেন জগতের ভিতর সবচে বড় আল্লাহর অলী।
আল্লাহর রাসুল আমাদের ইস্তেগফারের জন্য কি দারুণ দুআ শিখায়ে দিলেন। পড়লেই হৃদয়ে অনুশোচনা জাগে। তাহলো দুআয়ে মাছুরা। প্রতিদিন নামাজের শেষ বৈঠকে তা পাঠ করি। দুআটা সবার মুখস্থ, তাই অর্থ তুলে ধরছি শুধু চিন্তা করার স্বার্থে
ইয়া আল্লাহ!
আমি আমার নফসকে বড়ই অত্যাচার করেছি (তোমার নাফরমানের বশীভূত করেছি বারবার)- আর সে কৃত পাপগুলো তুমি ছাড়া কেউই ক্ষমা করে দেবে না। তাই তুমি আমাকে (একেবারে) ক্ষমা করে দাও। তোমার তরফ থেকে পাপীকে এমনি ক্ষমা ভিক্ষা দাও। আর আমার প্রতি সদয় হও, করুণা করো। নিশ্চয়ই তুমি হে আল্লাহ! প-র-ম ক্ষমাশীল ও কোমল দয়াময়।
প্রতিযোগিতা নেকআমলে না হোক, ক্ষমাপ্রার্থনায় তো হতেই হবে
যদি তুমি নেককার বান্দাদের সাথে আমল করে প্রতিযোগিতা না করতে পারো, তাহলে গোনাহগার বান্দাদের সাথে ইসতিগফার অর্থাৎ ক্ষমা প্রার্থনায় প্রতিযোগিতা করো। কারণ এটি তুমি পারবে। দয়াময় আল্লাহ এটা সহজ করে দিয়েছেন। এবং তিনি এটাই চান। আল্লাহর মাগফিরাত বা ক্ষমা আমাদেরকে কি ব্যাকুলভাবে ডাকছে! ইরশাদ হয়েছে,
১. ‘তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি হচ্ছে আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৩)
২. ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার উপর সীমালংঘন করেছো, আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার, ৫৩নং আয়াত)
৩. তৃতীয় কর্তব্য হলো, আল্লাহর জিকির করা। আল্লাহ তাআলা সকাল সন্ধ্যা, বসে-শুয়ে-দাড়ানো সর্ববস্থায় সর্বসময়ে জিকিরের আদেশ করেছেন, তা কি রবের আদেশ মনে হয় না আমাদের কাছে? তাহলে কেন আমরা ভুলে যাই?নিশ্চয় পাপের কারণে! কিন্তু ইস্তেগফারও তো করি না। নিশ্চয় পাপ করতে করতে হৃদয় পাথর! সেজন্যই প্রথম কর্তব্যটা আমাদের পালন করতেই হবে। অলীদের সোহবত, তাদের সাথে বন্ধুত্ব।
তবে একটি সত্য কথা এই যে, জিকিরের অন্যতম ফায়েদা হলো- জিন্দেগীর সময়গুলো চলে যাওয়ার- চলেই যাচ্ছে, সাথে যারা ধ্বংস হওয়ার- তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রভুকে যারা উত্তম স্মরণকারী বা অধিক জিকিরকারী, তারাই ধুলির এ ধরায় টিকে থাকছে। (‘দীওয়ান’ খুজে ফিরি হৃদয়ের সুখ)
৪. সাধ্যমতো নেক আমল করতে হবে। যে যত নেক আমল করবে, গুনাহের থেকে তার দূরত্ব ততই বাড়বে। প্রথমেই বলেছি, আমল যত কমবে, গুনাহের পথ তত সহজে উন্মুক্ত হবে। এজন্য আল্লাহর বারংবার আদেশ- নেক আমল করো। এটার প্রতি আমরা যত যতœবান হবো, ততই গুনাহকে ঘৃণা করতে পারবো।
৫. বেশি বেশি নামাজ পড়তে হবে। কারণ কুরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অপছন্দনীয় বিষয় থেকে বিরত রাখে। যত বেশী নামাজ পড়বো, ততই হৃদয় আল্লাহর প্রেমে বিভোর হতে থাকবে। দেহমন সমুজ্জল হবে। কপাল থেকে বিচ্ছুরিত হবে নূর, কারণ নামাজে যে সেজদা আছে! আহ্ সেজদা! মহিয়ান রবের আরেক করুণা আমাদের প্রতি! তাহলে বলুন, হৃদয় এ নূরে মুনাওয়ার হলে গুনাহ কিভাবে সেখানে স্থান পেতে পারে?
৬. এ সংখ্যায় সর্বশেষ যেটা বর্ণনা করে লেখাটির ইতি টানতে চাই, তা হলো- কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে বেশি বেশি, যখন তখন। কুরআনের কারিশমা কোনকালে কোন কাফির বিধর্মী মুশরিকরাও অস্বীকার করতে পারেনি। তারাও নিভৃতে কুরআনের পাগল ছিলো। আর কুরআনের আশিকদের যে হাল ও হালত, আল্লাহু আকবর! তা কমপক্ষে একটি আলাদা প্রবন্ধের দাবী রাখে।
হযরত আমর বিন মুররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, আমর! তুমি একটু কুরআন পড়ে শুনাও। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কুরআন তো আপনার উপর নাজিল হয়েছে, আমি কি আপনাকেও কুরআন পড়ে শুনাবো!? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমর, আমি অন্যের থেকে তেলাওয়াত শুনতে খুব পছন্দ করি। অত:পর সুরা নিসা তেলাওয়াত করতে লাগলাম। করতে করতে যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত আসলাম, আয়াতটি হলো
Ñ“সুতরাং সেই দিন কি অবস্থা হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং হে নবী, আমি আপনাকেও ওইসব লোকদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরুপে উপস্থিত করবো! ”
নবীজী তখন বললেন, আমর! হয়েছে, এবার থামো। চক্ষু তুলে তখন দেখি, নবীজীর নূরময় আঁখি মোবারক থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে! নবীজী কাঁদছেন!
ইসলামের জয় এখানেই। কুরআন নিজেকে, অপরকে, এককথায় সবাইকে পাগল করে দেয়। কুরআন হৃদয়ে ভালোবাসার ঝড় তোলে। সত্যের পক্ষে বাতিলের বিরুদ্ধে কম্পন সৃষ্টি করে। কুরআন মানুষকে ভালো থাকতে খুব সাহায্য করে। হৃদয়ের কোমলতায় গুনাহের জন্য বান্দার প্রবৃত্তি হার মানতে বাধ্য হয়।