ইলমে দ্বীনের বিচক্ষণ খাদেম আল­ামা বালাউটি ছাহেব (রহ.)

প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত আল­ামা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব (রহ.) কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় ইলমে শরিয়ত ও মারিফতের খেদমত করে গেছেন। এ লেখায় ইলমে দ্বীনের বিস্তার ঘটাতে তাঁর বিচক্ষণতার একটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি মাত্র। ইলম অর্জনের লক্ষ্য হলো মহান আল­াহর সন্তুষ্টি লাভ করা। এর উদ্দেশ্যই হলো, ইহকাল ও পরকালের সফলতা। শিক্ষার্থীদের ইলম অর্জনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি একনিষ্ঠ হতে স্বীয় শাগরেদদের দেয়া এক নসিহতে আল­ামা বালাউটি ছাহেব (রহ.) বলেন-‘সব কাজের আগেই থাকে নিয়ত। যথাযথ নিয়ত তোমাদের কর্মগুলিকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং তোমাদের ভিতরে যে বিরাট সম্ভাবনা ও শক্তি লুকিয়ে আছে তা বিকশিত হতে সাহায্য করবে। ফলে তোমরা যেমন চাও, তেমনভাবেই তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তুলতে পারবে। এ প্রসঙ্গে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি বাস্তব গল্প তোমাদের অনুপ্রাণিত করবে ইনশাআল­াহ। গল্পটি হচ্ছে- বাগদাদ নগরীর নাম তোমরা নিশ্চয় শুনেছো। সেই বাদশাহ হারুনুর রশীদের বাগদাদ। রূপে আর রঙ্গে ঝলোমলো বাগদাদ নগরী। বাগদাদের কতো কাহিনীও শুনে থাকবে দাদী-নানীর মুখে। সেই বাগদাদের আরেক মজার কাহিনী আজ তোমাদের শুনাবো। বাগদাদের শুধু রূপই ছিল না, গুণও ছিল। লেখাপড়ার চর্চা হতো ঘরে ঘরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে ছিল সবখানেই।
সেই শহরের বাদশাহ জ্ঞানের বড় কদর করতেন। তাঁর মন্ত্রীরাও ছিলেন ঠিক তাঁরই মতো। তবে প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মূলক এ ব্যাপারে সবার আগে। বহুদিন থেকে তাঁর মনের মধ্যে প্রায়ই একটি ইচ্ছা জাগতো। তাঁর প্রবল ইচ্ছা ছিল তিনি কিছু সৎ, আদর্শ ও চরিত্রবান ছাত্র গড়ে তুলবেন। এ ছাত্ররা দেশ ও জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখাবে। এজন্য বহুদিনের সাধনায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
এক রাতে ছাত্রদের অবস্থা দেখার জন্য তিনি ছদ্মবেশে বের হলেন। দেখলেন, ছাত্রাবাসের সব কামরায় বাতি জ্বলছে। ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। তিনি মনে মনে খুশি হলেন। তিনি ভাবলেন, হয়তো এসব ছাত্রই একদিন দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে এবং ইহকাল ও পরকালে সফলতা অর্জন করবে।
তিনি একটি কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন, চারজন ছাত্র একটি বাতির চারদিকে গোল হয়ে বসে কিতাব মুতায়ালা করছে। তিনি সালাম দিলেন। ছাত্ররা তাঁর সালামের জবাব দিলো। একজন বিদেশী দেখে ছাত্ররা তাকে ভিতরে আসতে ডাকলো। প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মূলক বললেন-এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ছাত্রদের সম্পর্কে আমার মনে বড়ই কৌতূহল। বহুদূর থেকে আমি এর খ্যাতি শুনে আসছি। তাই তোমাদের কাছ থেকে আমি একটি কথা জানতে চাই। ছাত্ররা বললো-আপনি যা জানতে চান বলুন। আমরা তার সঠিক জবাব দেবো।
-আচ্ছা, এখানে লেখাপড়া করে তোমরা কী হতে চাও?
-আমার পিতা নগর কোতোয়াল। আমি লেখাপড়া শিখে নগর কোতোয়াল হতে চাই।
আরেকজন জবাবে বললেন-আমি প্রধান বিচারপতি হতে চাই। আরেকজনের জবাব হলো-আমি চিকিৎসক হতে চাই।
নিজাম-উল-মূলক একের পর এক কামরা ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য জেনে নিচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি একটি ক্ষুদ্র কামরায় এসে পৌঁছলেন। সেখানে একটি ছোট্ট ছেলে একাই বসে একমনে পড়াশোনা করছে। তিনি বললেন-তুমি অতোটুকু ছেলে, রাত জেগে পড়াশোনা করছো। এতো কষ্ট করে লেখাপড়া করে জীবনে তুমি কী হতে চাও?


নিজাম-উল-মূলক সেই একই প্রশ্ন আওড়ালেন। ছোট্ট ছেলেটি একেবারে সরলভাবে জবাবে বললেন-আমার মা বলেছেন, আল­াহ পাক আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের উপর তাঁর অনেক হক্ব আছে। আমি লেখাপড়া করে আল­াহর সেই হক্ব জানতে চাই এবং তা পুরোপুরি আদায় করতে ইচ্ছা রাখি।
এবার নিজাম-উল-মূলক আনন্দে উল­সিত হয়ে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন-একমাত্র তুমিই আমার আশা পূর্ণ করেছো। এতোক্ষণধরে সব ছাত্রের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য শুনে আমি হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এ বিশ্ববিদ্যালয় এখনই ভেঙ্গে গুড়ো করে দেই। আমি দেখলাম, এখানে সব লালসার বান্দা তৈরি হচ্ছে। একটাও আল­াহর খাঁটি বান্দা তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার মনে আশা জেগেছে। মনে হচ্ছে, কমপক্ষে একজন আল­াহর খাঁটি বান্দাতো এখান থেকে তৈরি হবে।
নিজাম-উল-মূলক ছোট ছেলেটিকে অনেক দোয়া দিয়ে চলে গেলেন। প্রিয় ছাত্রগণ, তোমরা কী জানো, এই ছোট্ট ছেলেটি কে ছিল? এই ছেলেটিই হলেন শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.)। তাহলে এসো, সবাই ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর মতো জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্র হয়ে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছার পথ সুগম করি। আল­াহ পাক তোমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন, আ-মীন। (গ্রন্থ- শিক্ষার্থীদের প্রতি বালাউটি ছাহেবের অমূল্য নসিহত, পৃষ্ঠা-২৫ ও ২৬)
প্রিন্সিপাল আল­ামা বালাউটি ছাহেব (রহ.) দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের কালে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মহান আল­াহর রাহে নিবেদিত করতে পেরেছিলেন। একারণেই সমস্ত শিক্ষা জীবন কাটিয়েছেন স্বীয় ওস্তাদগণের একান্ত স্নেহভালোবাসা পেয়ে। জ্ঞানের প্রখরতা ও দূরদর্শিতা তাঁর শিক্ষা জীবনকে সাফল্যে ভরে তুলেছিলো। আল­াহর কাছে তাঁর আত্মসমর্পণ এবং ইলম অর্জনের লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্যের প্রতি একাগ্রতা তাকে বাস্তব জীবনে করেছে মহিমান্বিত। তিনি ইলমে দ্বীনের খেদমতে ছিলেন একনিষ্ঠ খাদেম। তাঁর অসংখ্য শাগরেদ আজ আলিমে দ্বীন। কর্মক্ষেত্রে সেই আলেমগণের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতী ও প্রতিষ্ঠান প্রধান, ক্বারী এবং শিক্ষক।
আল­ামা বালাউটি ছাহেব (রহ.) ১৯৪০ সালের ১৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম. এ) মাদরাসায় ১৯৬২ সালের ১ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে ইলমে দ্বীনের খেদমতে চাকুরী জীবনের সূচনা করেন। এর আগে উক্ত মাদরাসায় ১৯৬০ সালে কয়েক মাস অনারারী হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বরের পর থেকে সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসায় (মুহাদ্দিস হিসেবে) আরবী প্রভাষক পদে, ১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৬ থেকে ৩০ অক্টোবর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আটগ্রাম আমজদিয়া দাখিল মাদরাসায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে এবং ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জালালপুর জালালিয়া কামিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে থেকে এ মহান খাদেম ইলমে দ্বীনের খেদমত সুচারুরূপে বিচক্ষণতার সাথে আঞ্জাম দেন। ‘বালাউটি ছাহেব’ নামে পরিচিত ইলমে শরিয়ত ও ইলমে মারিফতের খেদমতগার এ প্রিয় ব্যক্তিত্ব ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর বেলা ৩টা ৪০ মিনিটের সময় ইন্তেকাল করেন। তাকে বাড়ির সম্মুখে অবস্থিত তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘বালাউট দারুল কোরআন মাদরাসার’ আঙিনায় ৪ অক্টোবর সমাহিত করা হয়।
হযরত আল­ামা বালাউটি ছাহেব (রহ.) সদগায়ে জারিয়া হিসেবে দীন ইসলামের যে বাগানগুলো তৈরি করে গেছেন তা কিয়ামত পযন্ত তরক্ষির সাথে জারি থাকুক, এই প্রার্থনা মহান আল­াহর দরবারে।
আ-মীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *