মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,
কেমন আছেন? যাই হোক আশাকরি আপনি ভালোই আছেন। তবে আমি ও আমার মত অনেক অভিভাবক মোটেও ভালো নেই। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার
হাল হকিকত, শিক্ষা বানিজ্য আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই চিঠির শিরোনাম দেখে বুঝতে পারছেন আমি বই বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি। তা বলছি–
আমি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার একটা মেয়ে। বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মা গৃহিণী। আমরা দুই বোন দুই ভাই। সবার বড় আমার বোন সে ১৯৮৯ সালে, আমি ১৯৯১ সালে, বড় ভাই ১৯৯৫ সালে আর সবার ছোট জন ১৯৯৯ সালে এস এস সি পাশ করে। আমাদের ঘরে প্রাইমারি ক্লাসের জন্যে দুটা করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার বই ছিলো। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণির উপযুক্ত দুইটা করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার বই ছিলো। ৮ম শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণির জন্যে দুটো করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার ছিলো। একই ভাবে কলেজের জন্যেও দুটো করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার ছিলো। যা আমরা চার ভাই বোন পড়েছি। এই বইগুলোও আমরা নতুন কিনি নাই। পুরানোই কিনেছি, নতুন কেনার এত টাকা আমাদের ছিলো না। আর পুরানো বই পড়লেই হয়ে যেতো।
আমার বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স এ প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে। আমার বড় ভাই ডাক্তার, ছোট ভাই সিএ ও এফসিএ করে ব্যাংকের টপ পর্যায়ে আছে। আর আমার কথা থাক। সরকারি হিসাবে আমার মা একজন রতœগর্ভা।
আমার বড় সন্তান ২০১২ সালে এস এস সি পাশ করে, বর্তমানে সে সিএ পড়ে। আমার ছোট সন্তান ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে
শিক্ষার্থীদের, সবার সাথে আমার সন্তানরাও পেয়ে আসছে। প্রতিবছর সরকার ক্লাস উপযোগী একটা বাংলা ব্যাকরণ ও একটা ইংরেজি গ্রামার দিয়ে আসছে। প্রতি বছর স্কুল থেকে আমাদের কিছু বই কিনতে হয়। নতুন ক্লাসের বইয়ের সাথে প্রতিবছর আমাকে একটা করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার কিনতে হচ্ছে, যা বাধ্যতামূলক। একবছর পড়ার পর পরের বছর তার আর প্রয়োজন পড়ে না। এই ভাবে আমার ঘরে গ্রামার বইগুলো জমা হচ্ছে। বছরের প্রথম এত টাকা দিয়ে বইগুলো কিনে বছরের শেষে কেজি ধরে বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় নাই। বইগুলো কাউকে দিব তারও উপায় নেই। সবাইকে এই ভাবে বই কিনতে বাধ্য করছে স্কুলগুলো।
আমার কথা হলো সেই পুরানো বই গুলো পড়ে আমার ভাই বোনেরা যখন উপযুক্ত জায়গায় এসে আমার মাকে রতœগর্ভার সম্মান দিতে পেরেছে, তাহলে কেনো আমি ও আমার মতো অভিভাবকরা এই সমস্যায় পড়ছি। আমি জানিনা আমার চিঠি খানা আপনার নজরে আসবে কিনা। তারপরও আশা ভরসা করেই লেখা। হয়ত আপনার নজরে আসলেও আসতে পারে।
সবিনয় নিবেদন এই যে বিষয়টা দেখবেন।
মাননীয় মন্ত্রী, পহেলা জানুয়ারি সরকার স্কুলে স্কুলে পাঠ্যবই উৎসব পালন করে। নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীদের মনে আনন্দ দোলা দিয়ে যায়। তবে কিছু কিছু স্কুলে পহেলা জানুয়ারি বই উৎসব পালিত হয়নি। অবশ্য এটা স্কুল কর্তৃপক্ষের কারণেই। আমার আজকের এই লেখা বই উৎসব নিয়ে নয়। আজকের প্রসঙ্গ বই নিয়ে যে শিক্ষা বাণিজ্য হচ্ছে। তার কিছু কথা। পূর্বে নির্ধারিত তারিখে স্কুলে ভর্তি হয় নতুন পুরাতন শিক্ষার্থীরা। ভর্তির পর জানুয়ারির ৩/৪ তারিখে বইও পায়। শুরু হয় স্কুলের ক্লাস। প্রতি বছর বোর্ড পাঠ্য বই দেয়ার পর স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে একটা বই লিস্ট দিয়ে দেয়। সেখানে টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকে। প্রথম শ্রেণি থেকে নবম দশম শ্রেণি সবাইকেই টাকা উল্লেখ করা বইয়ের লিস্ট দেয়। ক্লাস যত উপরের দিক হয় টাকার পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। বোর্ড বইয়ের বাহিরে স্কুল থেকে যে বই গুলো নিতে হয় টাকা দিয়ে তার মাঝে থাকে বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, ডিকশেনারী আরো কিছু বই, তার সাথে স্কুলের নামকরণ করা কতগুলো খাতা। বোর্ড থেকে ১৩ টা বই দেয়া হয় ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। যথারীতি নিয়মে এবার ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জমা দিতে হয় ২৬৯০/ (ছাব্বিশ শত নব্বই) টাকা। টাকা জমা দেয়ার ৩/৪ দিন পর শিক্ষার্থীদের ৪ টা বই দেয়, বলে খাতাগুলো পরে দেয়া হবে। ৪ টা বইয়ের মাঝে থাকে, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, ফ্যান ইংলিশ আর অক্সফোর্ড এর একটা ডিকশেনারী।
অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের হাতে বই দেখে। বইয়ের সাথে ডিকশেনারী দেখে অনেকের মেজাজ চটে যায়। কারণ গত বছরও প্রতিটা শিক্ষার্থীদের এমন করে ডিকশেনারী দিয়েছিলো। শুধু ৭ম শ্রেণিতে নয়, অন্য ক্লাসগুলোতেও একই অবস্থা। বাধ্যগত ভাবে সবাইকে প্রতি বছর সব শিক্ষার্থীকে ডিকশেনারী কিনতে হচ্ছে। ৭ম শ্রেণির ৮০ টা শিক্ষার্থীর মাঝে আমার সন্তানও আছে। বই হাতে সে ক্লাস থেকে বের হয়েই বলে,,
— মা এটা দিয়ে কি করবো। গতবছরও একটা দিয়েছে, খুলেও দেখিনি। এর চেয়ে অনেক ভালোগুলো আছে আমাদের ঘরে।
ওর কথাটা শেষ হতেই ক্লাসের কয়েক শিক্ষার্থীও একই কথা বলে। শুরু হয় অভিভাবকদের মাঝে আলোচনা। সবার একই কথা প্রতিবছর কেনো টাকা দিয়ে ডিকশেনারী কিনতে হবে। বললাম অফিসে যাই, জিজ্ঞেস করি। কয়েকজন বলে একা গিয়ে কি করবেন। বললাম একাই যাবো।
সেভাবে অফিসে যাওয়া। প্রধান শিক্ষককে খুজছি, তিনি রুমে না থাকায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। রুমে ৩/৪ জন শিক্ষক ছিলেন। অনুমতি নিয়ে উনাদেরকে বিষয় টা বলি। আমার জানার বিষয় ছিলো বাধ্যগত ভাবে কেনো ডিকশেনারী দেয়া হচ্ছে। একজন শিক্ষক বললেন,
— জানিনা কেনো এটা সবাইকে দেয়া হলো। ডিকশেনারী তো যে কোনটা পড়লেই হয়। আর এটা তো পড়ার নয়, এটা সহায়ক বই, যে কোনটা পড়লেই হয়। এটা দেয়া ঠিক হয়নি।
এরই মাঝে প্রধান শিক্ষক এসেছেন রুমে। উনার অনুমতি নিয়ে বলছি,
আমার মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে, আজ স্কুল থেকে ওকে এই বইটি দেয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো এটা কেনো দেয়া হয়েছে। এরচেয়ে উন্নত মানের বই সবার ঘরে ঘরে আছে। আর যে বই গতবছর দেয়া হয়েছে, তা কেনো এবার আবার দেয়া হলো। এর চেয়ে উন্নত মানের বই থাকবে স্কুলের লাইব্রেরীতে, শিক্ষার্থীরা ঘরের বই দিয়ে সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করবে। না পারলে স্কুলের লাইব্রেরীর বইয়ের সহায়তা নিবে এটাই তো নিয়ম। অথচ তা না করে টাকার বিনিময়ে প্রতিবছর একই বই নিতে বাধ্য করা হচ্ছে কেনো।
একজন শিক্ষক উঠে বললেন,
— প্রতিবছর বই আপডেট হয়, তাই নতুন বই দেয়া দরকার।
আমি বলি,
— কোন বই নতুন হয় আর কোন বই একই থাকে তা আগে জানতে হবে।
আরেকজন উঠে বলেন,
— আপনি হয়তো সচেতন, তাই আপনার ঘরে আছে, সবার ঘরে তো থাকেনা। তাই দিতে হয়।
আমি বললাম, রাজধানীর কেন্দ্রবিন্ধুতে যে স্কুল, সে স্কুলের অভিভাবকরা সচেতন নয়, এটা কি আমায় বুঝাতে চাচ্ছেন। আপনার স্কুলের ১৫০০ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে অসচেতনের তালিকায় ১৫০ জনও পড়বেনা। সব মিলিয়ে হয়তো ৫০ জন অভিভাবক পেতে পারেন যারা সচেতন নয়। যদি ৫০ জন অসচেতন হয়ে থাকে তাহলে এই ৫০ জনের জন্যে বাকী ১৪৫০ জন অভিভাবক কেনো এই দায় বহন করবে।
প্রধান শিক্ষক তখন একজন শিক্ষককে জবাব দিতে বললেন, সেই শিক্ষক বললেন,
— আসলে কেনো দেয়া হয় জানিনা, তবে একবছর পরপর এক এক ক্লাসে দেয়া হয়।
আমি বললাম,
স্কুল থেকে আমাদের বইয়ের লিস্ট দিবে, কোন ক্লাসে কোয়ালিটির বই কিনতে হবে তা উল্লেখ করা থাকবে। অভিভাবকগণ বই কিনবেন, এটাই নিয়ম। তা না করে কেনো বাধ্যতামূলক ভাবে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমাদের বই নিতে হবে।
প্রধান শিক্ষক বললেন,
— আপনি যখন বলছেন বইটা আপনার আছে, তাহলে রেখে যান। এই বইয়ের জন্যে যে টাকা নেয়া হয়েছে তা ফেরত দিয়ে দিবে।
— আমি তো বই ফিরত দিতে আসিনি। আমি তো টাকা নিতে আসিনি। আমি জানতে এসেছি এই বইটা দেয়ার ফলে কে লাভবান হবে বা হচ্ছে? আমি? আমার সন্তান? স্কুল? নাকি কোম্পানি? প্রতিবাদ করতে আসিনি, এসেছি জবাব চাইতে। টাকা ফিরত দিয়ে আমার জবাব না দিয়ে থাকতে চাচ্ছেন। এই ভাবে কয় জনের জবাব বন্ধ করবেন।
— আপনি বই রেখে যান।
— আমি বই নিয়েই যাবো, স্কুল থেকে এই ভাবে বাধ্যতামূলক ভাবে যা ইচ্ছে তাই বই ধরিয়ে দিচ্ছেন আর মোটা টাকা নিচ্ছেন তার প্রমাণ রাখতে হবে তো। নিজেদের সংশোধন করেন। শিক্ষার্থীদের বই ধরিয়ে দিবেন না, বইয়ের লিস্ট দিন, বই নয়।
৭ম শ্রেণির একটা শিক্ষার্থীকে সরকার ফ্রি ১৩ টা বই দিয়েছে, এর বাহিরে স্কুল গুলো নিজেদের ইচ্ছে মতো বই ধরিয়ে দিয়ে টাকা কামাই করছে। যে কোন বই ধরিয়ে দিয়ে বইয়ের কমিশন এর টাকা স্কুলের ফান্ডে জমা করছে। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বানিজ্যের কেন্দ্র বানাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাধ্যতামূলক ভাবে কেনো স্কুল থেকেই খাতা কিনতে হবে। যে খাতা বাহির থেকে ২৫ টাকায় পাওয়া যায়, সেই খাতা স্কুল থেকে কেনো ৩০ টাকায় কিনতে হবে। স্কুল তো হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখানে ব্যবসা করবে কেনো?
অতঃপর আর কোন জবাব দেননি কেউ। সামনের দিকে যেনো বানিজ্য না করে, তাই বলে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন আপনিই বলুন, এই ভাবে আর কতদিন চলছে। শিক্ষার নামে ব্যবসা করে ওরা লাভবান হচ্ছে। আসলে শিক্ষার্থীর কতটা উপকার হচ্ছে তা আমার জানা নেই।
ইতি
এক অভিভাবক।

Comments

comments

About

Check Also

প্রযুক্তি কথন : ইন্টারনেট অব থিংস

এটা আবার কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়? নাকি গায়ে মাখে? হুরু মিয়া কী নিয়া …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *