সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী : তাসাউফের খানকায় বেড়ে উঠা এক বীর সেনানী

মৃত্যুশয্যায় শায়িত মহাবীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমার শরীরে তাকিয়ে দেখ। একটি আঙুলের সমান জায়গাও কি বাকি আছে যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই? আজ আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে বিছানায় শুয়ে। বড় স্বাদ ছিল আল্লাহর রাহে শহীদ হব।
উলামায়ে কেরাম বলেন, খালিদকে (রা.) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতেই হতো। কারণ সায়্যিদে কাউনাইন (স.) তাঁকে সাইফুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যদি খালিদ যুদ্ধাবস্থায় শত্র“ আঘাতে প্রাণ দিতেন, তবে মনে হতো আল্লাহর তরবারি ভেঙ্গে গেছে; এমনটি হতেই পারে না। কার্য সমাধা শেষে আল্লাহ তাঁর তরবারিটি নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
খালিদের (রা.) তিরোধানের ৪৯৫ বছর পর, ১১৩৭ সালে ইরাকের তিকরিতের এক কুর্দি পরিবারে নজমুদ্দীন আইয়ুবের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন আল্লাহর আরেক তরবারি। নজমুদ্দীন পুত্রের নাম রাখেন ইউসুফ। গভর্নর নিজামুল মুলকের মাদরাসায় পড়ালেখা করে কেটে যায় বাল্যকাল। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পাশাপাশি দামেস্কের আমীর সুলতান নুরউদ্দীন জংগীর (রহ.) নিকট সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ইউসুফ। এরপর চাচা আসাদুদ্দীন শিরকুহ’র তত্ত্বাবধানে ফাতেমী শাসক আল-আদীদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রসঙ্গত, আব্বাসি খেলাফতের ক্ষয়িষ্ণুতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম বিশ্বের নানাদিকে প্রচুর স্বতন্ত্র শাসন গড়ে উঠেছিল। ফাতেমীরা ছিল এর অন্যতম। শিরকুহ’র মৃত্যুর পর আল-আদীদ ইউসুফকে মিশরের গভর্নর পদে আসীন করেন। নুরউদ্দীন প্রতিবাদ করেননি। তিনি জানতেন, শিয়া শাসকের অধিনে উজির হলেও ইউসুফ একনিষ্ঠ সুন্নী এবং তাঁরই হাতে গড়া তাসাউফের একনিষ্ট খাদিম। ১১৬৯ সালে নুরউদ্দীন জংগীর নির্দেশনায় ইউসুফ প্রথমবার ক্রুসেডারদের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিজয় লাভ করেন। ইতোমধ্যে তাঁর ইউসুফ পরিচয়টি হারিয়ে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন আল্লাহর সিংহ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী। ইতিহাস আরেক খালিদের উপাখ্যান রচনা করবে বলে কলম-কালি প্রস্তুত করছে।
একটু পেছনে ফিরে যাই। ৬৩৭ সাল, উত্তপ্ত সাহারা পেরিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের পানে ছুটে চলেছেন আমিরুল মু’মিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। বহুদিন ধরে জেরুজালেম অবরোধ করে রেখেছে আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ (রা.) এবং খালিদের (রা.) নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী। খ্রিস্টানদের দাবি, তারা খলিফার হাতেই জেরুজালেম সোপর্দ করবে। অবশেষে উমর (রা.) জেরুজালেমে পদার্পণ করলেন। উম্মতে মুহাম্মাদির হাতে আল-কুদস বিজিত হল। মুসলমানদের প্রথম কিবলায় আযানের ধ্বনি শোনা গেল।
ইউরোপের খ্রিস্টানরা ক্রুশ ছুঁয়ে জেরুজালেম পুনর্দখলের শপথ করল। ১০৯৯ সালে আব্বাসি ও ফাতেমী খেলাফতের দৈন্যতা এবং কতিপয় স্বার্থপর মুসলিম শাসকের ভীরুতার সুযোগে সারা ইউরোপ একজোট হয়ে আক্রমণ করল সিরিয়া ও ফিলিস্তিন। রক্তের বন্যা বইয়ে জেরুজালেম দখল করল ক্রুসেড বাহিনী। প্রায় ৭০ হাজার মুসলিম নর-নারীকে চরম নির্মমতায় শহীদ করা হল। ক্রুসেডারদের ঘোড়ার পা মুসলমানদের রক্তে ডুবিয়ে সম্পন্ন হল খ্রিস্টানদের প্রথম ক্রুসেড। ৪৬২ বছর পর আল-কুদস আবার খ্রিস্টানদের দখলে চলে গেল।
শিশুকাল থেকেই সালাহুদ্দীন শুনে আসছিলেন প্রথম ক্রুসেডের সেই মর্মান্তিক পরাজয় গাঁথা। কেমন একটি অনুভূতি যেন নাড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁর শিশু-মন।

ঐতিহাসিক আল-মাকরিযি বলেন- সালাহুদ্দীনের বাল্যকাল গড়ে উঠেছিল তাসাউফের স্নিগ্ধ পরিবেশে। বাল্যকালেই তিনি কুরআনুল কারীম এবং ইমাম মালিকের (রহ.) মুয়াত্তা পাঠ করেছিলেন। কুরআন শরীফের তিলাওয়াত ছিল তাঁর হৃদয়ের খোরাক। শায়েখ কুতবুদ্দীন আবুল মা’আলী নিশাপুরীর (রহ.) নিকট থেকে সালাহুদ্দীন তাসাউফের সবক গ্রহন করেন। সালাহুদ্দীন ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। মিশরে অবস্থানকালে তিনি তথায় শাফেয়ী, মালিকি এবং হানাফি মাযহাবের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরব ইতিহাসবিদ ড. আলী সাল্লাবী তাঁর ঝঁষঃধহ ঝধষধযধফফরহ ধষ-অুুঁনর গ্রন্থে লিখেছেন- সালাহুদ্দীন মিশরের প্রথম খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অন্তত তিনশজন সুফি ঐ খানকায় বসবাস করতেন, যারা ইলম ও তাকওয়ার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। সালাহুদ্দীন তাঁদেরকে খাদ্য, বস্ত্র প্রদান করতেন। যে কোন অভিযানে তাঁর সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুফি অংশগ্রহণ করতেন। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) ও একই মত প্রকাশ করেন।
ইবনে আসীর আল-কামিল ফিততারিখ গ্রন্থে লিখেছেন- সালাহুদ্দীন ছিলেন মসজিদ, মাদরাসা ও দরগাহ সমূহের একনিষ্ঠ খাদিম। সুফিরা যখন মুরাকাবায় বসতেন, তাঁদের মুরাকাবা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সালাহুদ্দীন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইতেন। ইমাম যাহাবীর (রহ.) মতে- সুলতান নুরউদ্দীন জংগী এবং সালাহুদ্দীন আইয়ুবী উভয়ের আকীদা ছিল সুন্নি-আশ’আরী। আল-মাকরিযি সালাহুদ্দীনের একান্ত সহচর বাহাউদ্দীন ইবনে শাদ্দাদের বরাত দিয়ে লিখেছেন-সালাহুদ্দীনের সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন সুলতানুল আউলিয়া সায়্যিদ আব্দুল কাদির জিলানীর (রহ.) মাদরাসা থেকে আগত এবং তাঁর মুরিদান। কতিপয় সৈন্য ছিলেন ইমাম গাযালীর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা নিযামিয়ার ছাত্র। এরা বিভিন্ন মাযহাব এবং সুফি তরিকার অনুসারী ছিলেন। যখন সালাহুদ্দীন জেরুজালেম অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন, তখন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিখ্যাত ফকীহ ইবনে কুদামাহ হাম্বলি (রহ.)। (চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা ছাহেব কিবলার সামাজিক খেদমত

এম এ বাসিত আশরাফ ফার্সী কবি বলেছেন:তরীকত বজুয খেদমতে খালক্বে নেসতবসুজ্জাদা তাসবীহ ওয়া দালকে নেসত।ভাবানুবাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *