বাবরের সংগ্রাম

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শেষ পর্ব
এরপর আর কিছু মনে নেই আমার।
এরপর আমি যখন চোখ মেলে তাকালাম, তখন পাশে দেখতে পেলাম ডাক্তার। চেয়ারে বসা জুনেদ। আমি চোখ মেলেই বলে উঠলাম, ‘ডাক্তার সাহেব, ডাক্তার সাহেব, আমরা স্বাধীন! তাই না?’
‘বাবর ! এসব নিযে় পরে আলাপ হবে।’
‘না ডাক্তার সাহেব, এখন আমার কিছু হবে না, প্রথমে বলেছিলাম না! যে অত্যন্ত খুশির খবর হলে সাথে সাথেই উপহার দিযে় দিবো। ঐটা ছিলো উপহার দেয়ার পর্ব। এখন আর কিছু হবে না। ডাক্তার সাহেব, আমাদের স্বপ্ন আজ বাস্তব। লক্ষ শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি। আমাদের যুদ্ধ করা, মাতা-পিতা হারানো, ভাই-বোন হারানো, প্রাণ ত্যাগ। রক্ত দান ! ঐ সব সব, ডাক্তার সাহেব ঐ সব স্বার্থক হযে়ছে। কিছুই বৃথা যায়নি। তাই না? আমার বুক আনন্দে ফেটে যাচ্ছে। আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব, আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য কোন দিন উদয় হযে়ছে?’
‘আজ থেকে একমাস চারদিন আগে। ১৬ই ডিসেম্বর।’
‘আজ থেকে একমাস চারদিন আগে! ১৬ই ডিসেম্বর!’
‘বন্ধু, আজ আমরা স্বাধীন।’ জুনেদ কথাগুলো বলল। আমি তার দিকে তাকিযে় বললাম-
‘জুনেদ! বন্ধু জুনেদ! আমরা স্বাধীন!’ বলে শুয়া থেকে উঠে বসলাম। ডাক্তার আমাকে ধরলেন।
‘হ্যাঁ, পাকিস্তানী বাহিনীর একটাও আর বাংলাদেশে নেই। ওরা লেজ গুটিযে় পালিযে়ছে।’
‘দেশে কবে যাচ্ছি জুনেদ?’
‘আজ থেকে বারদিন পর।’
শুনে তাকালাম আমি ডাক্তারের দিকে। ‘হ্যাঁ, জুনেদ ঠিক বলেছে।’ ডাক্তার বললেন।
‘তাই?’
‘হ্যাঁ, দেশ স্বাধীন হযে়ছে। কিন্তু দেশে গিযে়ও তুমি স্বাধীন হবে না।’
‘কি বলছেন!’
‘আট-নয় মাস তোমাকে বিশ্রামে থাকতে হবে, বাবর।’
‘এতো সময়!’
‘সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরই তুমি স্বাধীন। মুক্ত।’
‘স্বাধীন!’
‘তোমার সুস্থ জীবনের জন্য এটা।’
‘অবশ্যই মানবো, ডাক্তার সাহেব।’
‘আমরা যাচ্ছি কি করে? ডাক্তার সাহেব!’ জুনেদ জিজ্ঞেস করলো।
‘তোমাদের স্যার হাসান সাহেবের সাথে ফোনে আলাপ হযে়ছিল। তিনি জানালেন দশদিন পর তিনি নিজেই তোমাদেরকে দেশে নিযে় যাবার জন্য পরিবারসহ কলকাতা আসছেন। উনার সাথে তোমাদের যাওয়া হবে।’
‘তাই!’ আমি বিষ্মিত সুরে উচ্চারণ করলাম। ‘স্যার আসবেন?’
‘একদম সত্যি তাই।’
‘আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব। অসংখ্যা ধন্যবাদ।’
‘হুঁহুঁহুঁ।’
হেসে তিনি চলে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলাম, ‘ডাক্তার সাহেব।’
আমার দিকে আবার ফিরে বললেন, ‘কিছু বলবে?
‘হাসপাতালের বাগানে জুনেদকে নিযে় একটু হাঁটতে পারি?’
‘যেতে পারবে। তবে সাবধানে।’
বলে ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। জুনেদ কাছে এসে আমার ডান হাত ধরে বললো ‘চল তাহলে, বাগানে হাঁটবো।’
তখন আমি কোন কথা বললাম না। শুধু দাঁত বের না করে মুচকি হাসলাম। বিনিমযে় বন্ধু জুনেদও হাসলো।
এরপর আমার সুস্থ হযে় উঠতে উঠতেই শেষ হযে় গেলো এক বছর। কলকাতা থেকে আমরা এলাম জুনেদের বাডি়তে। এখানে সবার সাথেই মধুর সম্পর্ক হযে় উঠে। আমাকে আপন করে নিযে়ছিল সবাই। মনে হয়নি আমি তাদের পরিবারের কেউ নই। তাদেরই একজন করে নিযে়ছিল আমাকে। এমনই একটা প্রীতির সম্পর্ক গডে় উঠেছিল বলে তাদের ওখানেই আমাকে থাকতে হযে়ছে কযে়ক মাস। তা না হলে সেই কবে যে চলে আসতাম! সেদিন আর পারছিলাম না। শরীর ভাল হযে় আসায় প্রতিদিনই বাডি় ফেরার কথা বলছিলাম। সে দিন মাযে়র দোহাই দিযে় চলে এসেছি। তবে বিনা শর্তে ওরা আমাকে আসতে দেয়নি। আমার যাব বলে এসেছি।’
এই পর্যন্ত বলে বাবর থামলো। সম্ভবত শেষ করে ফেলেছে তার মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বলা। ভাল করে তাকালো। উপস্থিত সবার দিকে। দেখলো সবাই তখন তার দিকে হা করে তাকিযে় আছে অপলক চোখে। ওদের সবার চেহারার অবস্থা দেখে মনে হল, এখনও তারা সবাই যুদ্ধের ময়দানে। বাবরের যুদ্ধ কাহিনী শুনে তারাও সবাই একবছর পেছনে রণাঙ্গনে চলে গেছে। উপস্থিত সবাই যেন স্বপ্ন দেখছে। সবার এই অবস্থা দেখে বাবর একটু মজাই পেল।
‘আমার কথা শেষ।’ বলে তাদের জাগিযে় তুলতে চাইলো। ফিরিযে় আনতে চাইলো যেন যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদের উঠোনে। ‘শেষ হযে় গেছে আমার যুদ্ধে সময় কাটানোর কাহিনী বলা।’
এবার একজন একজন করে নডে় উঠলো। বোঝা গেল তারা আস্তে আস্তে সম্বিৎ ফিরে পাচ্ছে। এক সাথে সবাই বললো, ‘ইযে় শেষ।’
‘হেঁ, শেষ। আমার যুদ্ধের দিনগুলো ওই পর্যন্তই। তারপর তো এখন এখানে।’
আবার তাকালো একে অন্যের দিকে।
‘আচ্ছা, সবাই একবার নিজের ঘডি়র দিকে তাকান তো। দেখুন না, রাত কয়টা হলো।’ বলে মুচকি হাসলো বাবর।
সবাই ঘডি় দেখে এক সাথে বলে উঠলো, ওমা! এরই মাঝে রাত বারটা বিশ মিনিট।

আসর ভাঙার পর পরিবারের সবাই খেতে বসেছে বাবরকে নিযে়। মা তাড়াতাডি় করে এশার নামাজ আদায় করে খাবার টেবিলে এলেন। সবাই তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। মা তার পাশেই বসেছেন। সামনে অনেক খাবার। ভাত নেয়ার পর বাবরের প্লেটে একটা বড় মাছের মাথা তুলে দিলেন তার মা।
‘না না, এটা খেতে পারবো না। এতো বড়…’
‘নে, খেতে পারবি। এটা পুকুরের।’
ভাবীর দিকে তাকালাম। ‘খেতে পারবে।’ ভাবী বলে মুচকি একটা হাসি দিলেন। ভাইর দিকে এক পলকের জন্য তাকিযে় আর বাধা দিলাম না।
মাছের মাথা ভাঙতে ভাঙতে মার কাছে জানতে চাইলাম, এটা কোন পুকুরের মা?’
‘খালি বাডি়র।’
‘মা, মনে আছে, বাবা মারা যাবার কয়দিন আগে সেই পুকুরের মাছ ধরেছিলেন।’
মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ‘হে।’
‘আমি সেদিন মাছের মাথাটা খেযে়ছিলাম। বাবাই আমার প্লেটে মাছের মাথাটা তুলে দিযে়ছিলেন। মনে আছে মা তোমার?’ মা চোখ মুছলেন। কথা বললেন না। নিচের দিকে চোখ। প্লেটে। মা আগের মতো খেতে পারেন না দেখলাম। অল্প খেযে়ই উঠে যান। মাযে়র শরীরটাও এখন আগের মতো নেই। যুদ্ধে কত বড় ধকল গেছে তার, সে তিনিই জানেন। ‘মা, বাবার কবরটায় দেখলাম গাছ আর লতাপাতায় ছেযে় গেছে। আমি ওখানে ফুল গাছ লাগাবো। আর পাকা করবো। সেখানে খোদাই করে লিখা থাকবে শহীদ…’
‘আচ্ছা লিখিস। এখন ভাত খা…’
বোঝতে পারলাম মা খুব বেশি বাবার মৃত্যুর কথা শুনতে চান না। হয়তো কষ্টে। আর কিছু বললাম না। খেযে় উঠে মাযে়র বিছানায় গিযে় শুলাম। মা পান-সুপারী মুখে দিযে় আমার পাশে এসে শুলেন। আমার মাথায় হাত বুলিযে় দিচ্ছেন। চুল টানলেন। আদর করলেন। আমার ঘুমই চলে আসছিল প্রায়। ‘কি ঘুমিযে় গেলি?’
চোখ মেলে তাকালাম। অনেক রাত হযে় গেছে। তাই সহজে ঘুম চলে এসেছে। ‘বল মা।’
‘এতো দিন মাকে ছাড়া থাকলে কেমনে? কষ্ট হয়নি?’
মাকে ঝডি়যে় ধরলাম। ‘কি কষ্ট হযে়ছে সে আমি জানি মা। কত যে মনে পড়ছে। এজন্যই তো ছুটে এসেছি। আমার আশ্রয় তো তুমি মা।’
‘তাই? তাহলে আমাকে ছেডে় যুদ্ধে গেলি কিভাবে বল তো?’
চোখ মেলে তাকালাম মাযে়র দিকে। ‘মা আমি যদি যুদ্ধে না যেতাম সেদিন। আমার মতো মুক্তিযোদ্ধারা যদি যুদ্ধে না গিযে় ঘরে বসে থাকতো তাহলে তো আজ বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এই দেশ হযে়ছে মা আমরা যুদ্ধে গেছি বলেই। তুমি দেশ পেযে় খুশি হওনি?’
‘হাঁ, আমার মতো এতো খুশি আর কে বল? আমার ছোট্ট বাবুটাও যে যুদ্ধে গেছে দেশটার জন্য। রক্ত দিযে়ছে। তার বাবা জীবন দিযে়ছে। কে বল আমার চেযে় খুশি হবে আর?’ বলে মা চোখ মুছলেন। আমি মাযে়র কোলে মুখ লুকালাম আবার। মা তখন গাযে় খাতা জডি়যে় দিলেন। নিজেও শুযে় পড়লেন। বুঝতে পারলাম আজ মাযে়র কাছেই ঘুমাবো। মাযে়র বুকের মতো আরাম আর নিরাপদ কোন জায়গা নেই। চোখ বন্ধ হযে় এলো স্বর্গীয় সুখে। আজ আমি দুইটা মাযে়র কোলেই ঘুমাবো। দেশ মাতা আর জন্মদাত্রী মাযে়র কোলে।
সমাপ্ত

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *