কর্মের ফল

সে যুগে সুলতান নাসির উদ্দিনের বেগম নাকি স্বহস্তে হাত পুুড়িয়ে রান্না করতেন। এ যুগের কেরানী-গিন্নিরাও ফুলবানুর বেটার হাফ। সাফ কথা- সে যুগ হয়েছে বাসি, এ যুগে নারীরা কখনও হবেনা দাসী। নবীদের যমানায় নবীদের স্ত্রীরা চার দেয়ালের আড়ালে থেকে স্বামীর যাবতীয় খেদমত আনজাম দিতেন। তাতেই তারা তুষ্ট থাকতেন। এ যামানায় নারীরা অনেক ফরোয়ার্ড হয়েছে। তাদের একটা সোস্যাল লাইফ থাকে। তারা ঘরকুনো হয়ে থাকতে পারেনা। আবেদ আলীকে অগত্যা বাসায় কাজের মেয়ে রাখতে হলো। খরচ বাড়লো। কিন্তু বেতন বাড়লো না। খরচ আরো আছে। নিত্য নতুন ডিজাইনের শাড়ী কেনা। দামি কসমেটিকস্ কেনা। আয়না-কাঁকই, ড্রেসিং টেবিল, দেওয়ালের জন্য অয়েল পেন্টিং। মাঝে মাঝে সিনেমার টিকেট। এমনি কতো কি। এইতো সবে শুরু। দৈনন্দিন আবদার বাড়ে। তাই আয় বাড়াতে হয়। নহিলে লাঞ্চনা-গঞ্জনার সীমা থাকে না। ‘রাজকোষের অর্থ আমার নয়। আমার জন্য যা বরাদ্দ তাই আমার প্রাপ্য। এই মাছলা এ যুগের কেরানী- বেগমেরা শুনতে নারাজ। তাদের কথা- ন্যায্যদাবী মানতে হবে, নইলে বেগমের উষ্ণসান্নিধ্য ছাড়তে হবে। অফিসের সহকর্মীরা অহরহ বলেন : মিয়া ভাই গিন্নীকে খুশী করার তাকদ নাই। : চিন্তার কোন কারণ নাই। নার্ভাস হচ্ছেন কেন? ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। : নারে ভাই ডাক্তারের কোন দরকার নাই। : তবে কি? : এ্যারোমেটিকের ট্যালকম পাউডার চাই। ল্যাটেস্ট মডেলের জর্জেট চাই। : কিনে ফেলুন। আওর কুছ? : সপ্তাহে তিনদিন সিনেমার টিকেট চাই। : এই পর্যন্ত ? : না, আরও আছে। মাসে অন্ততঃ চারদিন চাইনিজ খাওয়া চাই। : মুছিবতের ব্যাপার বটে। কুরআন পাকে বলা হয়েছে- অযথা খরচকারী শয়তানের ভাই। : কুরআন পাকের কথা শুনে কে? : এ জন্যইতো বলা হয়েছে- অধিক সংখ্যক পুরুষ নারীর কারণে দোজখে যাবে। : তাহলে তাই যান। এখন থেকে উপরি আয়ের পথ ধরুন। আর রেটটা একটু বাড়িয়ে দিন। তাহলেই পুষিয়ে যাবে। আবেদ আলীদের দিনকাল এ ভাবেই গড়াতে থাকে। এক সময়ে বেতনও বাড়ে, পদবর্ধনও আটকে থাকে না। কিন্ত অভাব এবং স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না। মানুষের চাহিদা অফুরন্ত। কড়া পেলে গণ্ডা চাই। পাউন্ড পেলে ডলার লাগে। মারুতি থাকলে মার্সিডিসের প্রয়োজন হয়। এভাবেই আবেদ আলীরা একদিন বিখ্যাত ঘুষখোরে পরিণত হন। আবেদ আলী এখন জাঁদরেল কাস্টম অফিসার। ঘুরেছেন বিভিন্ন ষ্টেশনে। টাকা কামিয়েছেন দেদার। আয়ের সংগে তাল মিলিয়ে ব্যয়ের বহরও বেড়েই চলেছে। অসন-আসন, বসন-বাসনে টাকা উড়িয়েছেন দু’ হাতে। আয়ও করেছেন ডান-বাম দু’ হাতেই। শহরে গাড়ী-বাড়ী সবই হয়েছে। শুধু বাড়ীতে নারীর সংখ্যা বাড়াতে পারেননি নূরবানুর দোর্দণ্ড প্রতাপে। তবে নাইট-ক্লাব আর বারে গিয়ে বারোয়ারী মহিলার স্বাদ গ্রহণে কোন বাঁধা হয়নি। তবে গিন্নিকেও কিছু বখ্রা না দিয়ে পারেননি। তার পার্টি-সিনেমায় মামাতো-খালাতো ভাইদের সাহচর্যে বাঁধা দিতে যাননি কখনও। এ্যাডজাস্টমেন্ট না থাকলে সংসার সুখের হয় না, এটা আবেদ আলীকে মানতে হয়েছে। ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’ এটারও এখন উল্টাপাল্টা ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। সবই মেনে নিতে হয়। বোতলেও কিছু কাজ দিয়েছে। সংগে অঢেল মাংস। তারপর মেদ-ভুঁড়ি, কি যে করি। এ পর্যন্তেও রেহাই মেলেনি। ডায়বেটিস, হাইপার টেনশন- ঘন ঘন মেডিকেল চেপআপ। কিছুতেই হয়না। ওদিকে গিন্নীটিও এমনি মুটিয়েছেন যেন নেপালী হাতি। ছত্রিশ দু’গুনে বাহাত্তর ইঞ্চি ছাতি। যতোই কমাতে চাওয়া, ততই বাড়ে। চিৎপাতের উৎপাতে পেয়ে যায়। প্রকৃতি সর্বদা প্রতিশোধ পরায়ণ। হারামে আরাম নাই- গায়ের জোর থাকা পর্যন্ত উপলব্ধি করা যায় না।
আবেদ আলী মিয়ার বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সপরিবারে চট্টগ্রামে থাকে। ছেলের বউ ফ্যামেলী প্লানিং অফিসার। ছোট ছেলে বিলেতে পড়াশুনা করছে। বড় মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে বি.এ. পাশের পর। জামাই যশোরের বিখ্যাত স্মাগলার। ছোট মেয়েটা স্কুলে পড়ে। খুলনার বাড়ীতে এখন তারা তিনজন। বাড়তি দু’জন কাজের লোক। আবেদ আলী মিয়া এক সময়ে অবসর নিলেন। কাজের ব্যস্ততা আর থাকল না। কিন্তু ব্যস্ততা বাড়লো শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে। কিছু কিছু ধর্মপ্রাণ বন্ধুরা বলেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। রোগ-ব্যধিও আল্লাহ দেয়। খালেছ দীলে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও, তওবা কর। চিকিৎসায় কাজ হবে না, যদি আল্লাহর মর্জি না হয়। যে ক’দিন বেঁচে আছো, দ্বীনের কাজে লেগে থাকো। ঘর-বাড়ী, ধন- দৌলত, স্ত্রী-পুত্র শেষকালে কেউ সঙ্গের সাথী হবে না। পাপ-পূণ্য যারটা যার, তারটা তার নিজের। তার কোনো ভাগী-শরীক নাই। শরীর দুর্বল হলে, মনও দুর্বল হয়ে পড়ে। আবেদ আলীও স্বাভাবিক অবস্থার শিকার হয়ে পড়লেন। একদিন তিনি মনস্থির করে ফেললেন- না, আর শহরে থাকা নয়। জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গিয়ে থাকবার ইচ্ছা হলো তার। দীর্ঘকাল পর তিনি প্রবাস জীবনের ইতি টানলেন।

তিন
শাহেদ আলীর পিতা জেন্নাত আলী মুন্সী গ্রামের ছোটখাটো হুজুর। লেখাপড়া তেমন একটা করেননি। তবে বাল্যকালে নোয়াখালীর এক হুজুরের বাড়ীতে ছিলেন কিছু দিন। সেখানে খারেজী ভাবে কিছু দ্বীনী এলেম হাসিল করতে পেরেছিলেন। অনেকের বেলায় দেখা যায় ইংরেজী বিদ্যার ২/১ খানা সার্টিফিকেট থাকলেও কোনো কাজ মেলেনা। মামু নাই, খালু নাই, তেল মালিশের টাকা নাই- চাকুরী হবে না। শেষে কারো হতে হয় ঘর জামাই। নইলে উকিল- মোক্তারে বৈঠক খানার মুহুরী। চুরির চাইতে তাও ভালো। কিন্ত দ্বীনী এলেমের মরতবা আছে। এই এলেম ঘাটে কিছু থাকলে আল্লাহর মর্জি হয়, না খেয়ে মরতে হয় না। মাদ্রাসার চাকুরী কিংবা ওয়াজ-মাহফিলের জন্য কেউ না ডাকলেও বসে থাকতে হয় না। গাঁয়ের মসজিদের খেদমত, কবর জিয়ারত, ছোটদের কোরআন শিক্ষা, বিয়ের কলমা পড়ানো, রমজানে তারাবীহ নামাজের ইমামতি, কোরআনে খতম, মিলাদশরীফ পড়া ইত্যাদি দ্বীনী কাজ আল্লাহর রহমতে জুটে যায়। রোজগার অল্প হলেও হালাল রুজির বরকতে জিন্দেগী একরূপ চলে যায়। রহমতপুর গ্রামের লোকজন খুব একটা শিক্ষিত নয়। আর্থিক স্বচ্ছল পরিবারও খুব কম। এখানে জেন্নাত আলী মুন্সির কদরও বেশ। তিনি আবার গ্রামের ছেলেমেয়েদের দ্বীনী এলেম শিক্ষার জন্য একটা কেরামতিয়া মাদ্রাসা চালাতেন। তার খুব একটা বাড়ীর ভাত খাবার ফুরসৎ থাকতো না। বছরভর একটা-না একটা দাওয়াত লেগেই থাকতো। গাঁয়ে তখন আলীয়া মাদ্রাসা না থাকায় বাধ্য হয়ে শাহেদ আলীকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করালেন। তিনি জানতেন, হাদিসে যে এলেমকে ফরজ বলা হয়েছে, তা দ্বীনী এলেম। তবে বাংলা-ইংরেজি ফরজ না হলেও পড়তে দোষ নেই। আসল কথা হলো, ইসলামে পুরাপোরি দাখেল থেকে, ঈমান-আকিদা ঠিক রেখে যে কোন বিদ্যা অর্জন করা যায়। যদি না তাতে আখেরাত বরবাদ করে না দেয়। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর অভিমত তাই। বলা যায় মুন্সী সাহেব ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দোষের কিছু করেননি।
শাহেদ আলী বাবার কাছে ছহি করে কুরআন শরীফ পড়া শিখেছেন। নামাজ- রোজা, অজু- গোসলের নিয়ম-কানুনও শিখেছেন। জেন্নাত আলী মুন্সি ছেলেকে বলতেন, ইসলাম পাঁচটি খুঁটির উপর টিকে আছে। কালেমা, নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ্ব এই কয়টি খুঁটি। একখানা ঘরও কয়টি খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তার একটি খুঁটি আল্গা হলে ঘরটি নড়বড়ে হয়ে যায়। ঝড়-ঝাপটায় ভেংগে পড়ে। ইসলামও সেরকম। ঈমান পোক্ত করতে না পারলে নামাজ রোজায় মন বসে না। আবার নামাজ রোজা ছেড়ে দিলে কালেমার মূল্য কি? কালেমাই ঈমান। মুখে পাঠ করতে হবে, মনে বিশ্বাস করতে হবে। তাহলেই ঈমান হবে তাজা। যার ঈমান তাজা সে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কিছুই তরক করে না। আর, নামাজই ইবাদতের মধ্যে উত্তম। নামাজের মধ্যে আল্লাহর দিদার লাভ হয়। হাদিসে আছে- ‘নামাজ বেহেস্তের চাবী। নামাজে গরীবের হজ্ব।’ তাই বলি- যাই করো না কেন, আল্লাহর ইবাদত ঠিক মতো করা চাই। তোমার ইংরেজি শিক্ষা যেন তোমাকে পথভ্রষ্ট না করে। তাই শাহেদ আলী নসিহত ভোলেননি। স্কুল-কলেজ বিভিন্ন মনোবৃত্তির সহপাঠীদের সংগে মিলেমিশে কিছু কিছু বেশরাহ কাজ করলেও নামাজ- রোজা কখনও ছাড়েননি। ছাত্র জীবনে সব সময় মাথায় টুপি রাখতেন না, তবে শার্ট-প্যান্ট কখনও পরেননি। কখনও দাড়ি কামাননি, তবে ছেঁটে খাটো করতেন। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কখনও-কখনও সিনেমা থিয়েটারেও যেতেন। কেননা, পরিবেশের প্রভাব এড়ানো বেশ কঠিন ব্যাপার। তবে ওসবের প্রতি কখনও নেশা ধরেননি। কথায় বলে- ‘সংসগচ দোষা গুণাহিভবন্তি- সংসর্গে দোষ-গুণ জন্মায়। কুসঙ্গ এড়িয়ে চলার চেষ্টা তিনি করতেন সবসময়। আধুনিক শিক্ষিত সভ্যযুগে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ প্রায় উঠে গেছে। ছেলেদের সংগে রং-তামাশায় মত্ত হয় মেয়েরা। ছেলেদের দেহ-মনে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এটা নাকি তাদের সমান অধিকারের ব্যাপার। আগুনে বাতাস লাগলে জ্বলে ওঠে। লোহার কাছাকাছি চুম্বক এলে আকর্ষণ করবেই। তবু মেয়েরা আজকাল পর্দা মেনে চলে না। বলে প্রগতির অন্তরায়। হতেও পারে। এতে দূর্গতি এড়ানো যায় না। শোনা যায় কলেজ-ভার্সিটির ছাত্ররা ছাত্রীদের উত্যক্ত করে। কেউ কেউ যৌন হয়রানীর শিকারও হয়। আসলে অবাধ বিচরণকারিণী মেয়েরাইতো ছেলেদেরকে অসুস্থ করে তোলে। ব্যাভিচার বাড়বে না তো কি? সীমা লঙ্ঘন, মানে গণ্ডির বাইরে চলে আসা। আর, বাইরে চলে আসলে আঁচড় কামড় খাওয়া আদৌ বিচিত্র নয়। ছেলের কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে, তা জেন্নাত আলী মুন্সির নজর এড়ায়না। কিন্তু কলেজ পড়–য়া ছেলেকে তো খুব একটা বকাÑঝকা যায় না। এখন বিদ্যা বুদ্ধি হয়েছে, নিজেই ভালো-মন্দ নিজের বুঝে চলুক-মুন্সী সাহেব এটাই ভাবেন এখন। তবে তিনি ছেলের প্রতি খুশি এ জন্য যে, ছেলে নামাজ- রোজা ঠিকমতোই করছে।
শাহেদ আলী বি.এ. তে সেকেন্ড ক্লাস পেলেন। হঠাৎ একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে দরখাস্ত টুকে দিলেন। সাব-রেজিস্টারের চাকুরী। ইন্টারভিউতে তিনি টিকে গেলেন। তার চাকুরী হলো। নিজের জেলাতেই তবে ভিন্ন থানায়। চাকুরীস্থলে যাবার পূর্বে জেন্নাত আলী মুন্সি ছেলেকে বললেন, বাবা শাহেদ, হালাল কামাই করে হালাল খানা খাবে। তাতেই আল্লাহ খুশি, তাতেই বরকত। হারামটার প্রতি লোভ করবেনা। লোভে পাপ, পাপের পরিণতি খারাপ। আমি তোমার কাছে জেয়াদা টাকা চাইনা। হাদিসে আছে- ‘হারাম কামাইর রোজগারে যে শরীর গড়া হয়, সেই শরীর দোজখের আগুনে জ্বলবে।’ আরেকটি হাদিসে আছে, ‘হারাম টাকার দান-ছদকা, হারামখোরের ইবাদত কবুল হবে না।’ সব সময় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল থাকবে। আল্লাহই রিযিকের মালিক। আসল কথা হলো, ঘুষ নিয়োনা। ঘুষ খাওয়া হারাম। ইহকাল ক্ষণিকের, আখেরাতের শেষ নাই। সাবধান, এসব কথা সব সময় মনে রেখো।

চার
ছেরাফত আলী বসে থাকার লোক নন। কোথায় কার বিবাহের কন্যা আছে, সে হিসেব তার জানা থাকে। তিনি শুধুই পেশাদার নন এখন, নেশাদারও। তাই পাত্রের খোঁজও তাকেই রাখতে হয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, বিয়াডা অইলো ফরজ কাম। এই কামডা গরজ কইরা ঘডাইয়া দিতে পারলে বহুৎ ছওয়াব। তয় টাকা কড়ি লইলে অয় প্যাডের তাকিদে। ঘোরা-ফেরাও একটা খরচ আছে? ছেরাফত আলী সবটাই যে ভালো করেন, তা নয়। (চলবে)

পরবর্তী অংশ

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *