সুন্দরবন ধ্বংসের প্রকল্প : রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

‘সুন্দরবন’ বাংলাদেশের প্রাণ এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন যাকে ইউনিসেফ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভাগ হয়ে যায় সুন্দরবনও। এই ভাগকৃত সুন্দরবনের ৪০ শতাংশ পড়ে ভারতের অংশে এবং বাকি ৬০ শতাংশ পড়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ অংশে। কিন্তু সরকারের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা এবং এ সুযোগে জলদস্যু, বনদস্যু, পশু শিকারী ইত্যাদি বিভিন্ন চক্রের খপ্পরে পড়ে সুন্দরবনের আয়তন ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তদ্রুপ কমছে পশু-পাখি সহ বিলুপ্ত প্রায় মাছের সংখ্যা।
কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের বদলে সরকার আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে সুন্দরবন ধ্বংসের প্রকল্প গ্রহণ করে তা এখন পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পথে। যা বাস্তবায়ন করছে ভারতের রাষ্ট্রয়াত্ত সংস্থা। এই প্রকল্পটি হচ্ছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যা ইআইএ-র রিপোর্ট অনুযায়ী সুন্দরবন থেকে ১৪ কি.মি. দূরে যদিও এটি আগে সুন্দরবনের অংশ ছিল। এই প্রকল্পের জন্য ১৮৩৪ এর কৃষি, মৎস্য চাষ ও আবাসিক এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে একই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৭৯২ একর এবং যার অধিকাংশই পতিত জমি।
যেহেতু এখানে আমি সুন্দরবনের ক্ষতির বিবরণ দিচ্ছি তাই অন্যান্য ক্ষতির বিবরণ দিয়ে লেখনি লম্বা করব না-যদিও তা ব্যাপক। এবার চোখ ফিরানো যাক সুন্দরবনের ক্ষতির দিকে। এই ক্ষতির সময়কালকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। (১) বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন সময়। (২) বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাধীন সময়।
১. বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন সময়
এটি ৪ থেকে ৫ বছর বিস্তৃত। এ সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদি সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নদী পথে নির্ধারিত স্থানে নেয়া হবে এবং এর প্রয়োজনে নদী ড্রেজিং এবং বিভিন্ন সংস্কার করতে হবে। আসুন এবার জেনে নিই এর ফল কি হবে।
সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে অতিরিক্ত নৌ চলাচলের ফলে অধিক তেল নিঃস্বরণ, শব্দদূষণ, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদরি ফলে ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। আবার নির্মাণ কাজ ও যানবাহন ব্যবহারের ফলে নিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে এবং তেল, গ্রীজ নি:সৃত হবে যা জলজ প্রাণির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আবার জেটি নির্মাণের জন্য নদীর ধারের সুন্দরবনের ঝোপ-ঝাড় কেটে ফেলতে হবে। এর ফলে বক, সারস সহ বিভিন্ন পাখি সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
২. বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাধীন সময়
এ সময় ২৫ বছর বিস্তৃত। এই ২৫ বছর ধরে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের পরিবেশের উপর নিম্নোক্ত প্রভাব ফেলবে :
ক্ষতিকর সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস : ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ১৩২০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড (ঝঙ২) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (ঘঙ২) এর ঘনত্ব ৮ মাইক্রোগ্রাম থেকে বেড়ে ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রাম এবং ঘঙ২ এর ঘনত্ব ১৬ মাইক্রোগ্রাম থেকে বেড়ে এর তিনগুণ হয়ে ৫১.২ মাইক্রোগ্রাম হবে যা সুন্দরবন ধ্বংসের বিষাক্ত রাসায়নিক উপকরণ। কারণ, বাতাসে ঝঙ২ ও ঘঙ২ এর সহনীয় মাত্রা ৩০ মাইক্রোগ্রাম মাত্র।
কার্বন ডাই অক্সাইড এর প্রভাব : কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি বছরে ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হবে যার ফলে শুধু সুন্দরবন নয় সমস্ত বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণ হার অনেক বৃদ্ধি পাবে যা পরিবেশের ধ্বংসের কারণ। অথচ সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে এতে কোনো ক্ষতিই হবে না।
পশুর নদী থেকে পানি প্রত্যাহার : ইআই-এ রিপোর্ট অনুযায়ী পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের পর ৫১৫০ ঘনমিটার ফিরিয়ে দেয়া হবে সুতরাং প্রতি ঘন্টায় ৪০০০ ঘন মিটার পানি প্রত্যাহার করা হবে যা পশুর নদীকে পঙ্গু করে দেবে এবং ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবন সহ এর প্রাণিকূল। কিন্তু সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে এতে নদীর হাইড্রোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন নাও হতে পারে যা জনগণের সাথে জঘণ্য প্রতারণা।
পানি দূষণ : কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত পানিতে বিভিন্ন মাত্রায় দূষণকারী পদার্থ থাকায় বিভিন্ন দেশে এ পানি নির্গমণ করা হয় না। বাংলাদেশে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানের ভারতে নির্মিত কেন্দ্রেও ‘শূন্য নির্গমণ’ নীতি মেনে চলে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় ১০০ ঘনমিটার হারে তরল বর্জ্য পশুর নদীতে ফেলা হবে যা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ রাতারাতি ধ্বংস করে ফেলবে।
বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি : ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনী থেকে নির্গত তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ঐ স্থানের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করবে যা সুন্দরবনের জীবজগত ধ্বংসের আরেকটি কারণ।
বিষাক্ত ছাই : কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন বিষাক্ত ছাই উৎপন্ন হবে। এই ছাই ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষিত করে। কারণ এতে আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাভিয়াম, ব্যারিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো এ বিষাক্ত ছাই দিয়ে প্রকল্প এলাকার ১৮৩৪ এর জমির ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে। যার ফলে বৃষ্টির পানির সাথে ছাইয়ের বিষাক্ত পদার্থগুলি নদীতে মিশবে এবং এর থেকে সমস্ত সুন্দরবন ছড়িয়ে পড়বে। আর এর আবশ্যক পরিণাম হচ্ছে সুন্দরবনের ধ্বংস।
শব্দ দূষণ : কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রোসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানো নামানোর যন্ত্রপাতি এবং যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হবে যা ৫০ ডেসিবলের বেশি যা সুন্দরবনের জীবদের ধ্বংসে যথেষ্ট, যা সরকারি রিপোর্টেও বলা হয়েছে। কিন্তু তারা নির্বাচনী প্রতারণামূলক আশ্বাসের মতো এটারও সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি এবং রোগব্যাধির সংক্রামণ ঘটবে। যেমন : নিউমোনিয়া ইত্যাদি। আবার তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও হতে পারে।
কাঁচামাল পরিবহনগত : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করতে হবে যার ফলে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বছরের ৫৯ দিন বড় জাহাজ এবং ২৩৬ দিন ছোট জাহাজ চলাচল করবে দিনে এবং রাতে। এর ফলে যেমনি হবে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ তেমনি সমস্যা হবে সমস্ত জীবকূলেরও।
সরকার প্রদত্ত ইআএ রিপোর্টে ভুল মানদণ্ড ব্যবহার, ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেখানো, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রার কোন পর্যালোচনাই না করা, শত শঠতা, প্রতারণা, ধোকার মাধ্যমে এই প্রকল্পকে জায়েজ করার চেষ্টা সত্ত্বেও যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে এটা নিশ্চিত সুন্দরবন তথা পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্প। বস্তুত, এর চেয়ে আরো সামান্য কারণে খোদ এনটিপিসিরই একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়নি ভারত। অথচ ভারতের স্বার্থের রক্ষা এবং মনরক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন তথা বাংলাদেশের প্রাণ ধ্বংসকারী প্রকল্প অনুমোদন দেয় যা অত্যন্ত ঘৃণিত এবং ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ।
আমাদের উচিত সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে এই আত্মবিধ্বংসী প্রকল্প বন্ধ করা। আমরা হারিকেরেন আলো চাই, সুন্দরবন ধ্বংসকারী বিদ্যুতের আলো চাই না’।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *