মুসলিম অনৈক্য : ফায়েদা নিচ্ছে কাফেররা

বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের পরাজয়ের গ্লানি চেপে উঠছে। সবচেয়ে যে বিষয়টা প্রকট আকার ধারণ করে ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে- সেটা হলো- অনৈক্য। মুসলমান-মুসলমানদের মাঝে বিভেদ-মতভেদ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মুসলমানদেরকেই পরাজয়বরণ করতে বাধ্য করেছে। যতদিন একতা ছিলো, ততদিন বিধর্মীরা ভয়ে নিশ্চুপ থেকেছে। যেদিন থেকে মুসলমানদের এ দড়ি ছিঁড়ে গেছে, সেদিন থেকেই বিধর্মীরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ফণা তুলে ছোবল মেরেছে। বিষ-দাঁত দিয়ে দংশন করেছে। মুসলমান নিরুপায় হয়ে সে ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছে। মাথা হেট করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। দংশনে দংশিত হচ্ছে। মাথা যেন আর তুলতেই পারছেনা। বিশে^র সুউচ্চ শৃঙ্গে উঠে শার্দুলী হুংকার আর সিংহ-গর্জন দিতে পারছেনা।
এখন কথা হলো, মুসলমানদের মধ্যে এ রোগ কিভাবে ছড়াচ্ছে? কিভাবেই বা তাদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি হচ্ছে? বিধর্মীদের প্রথম চক্রান্ত ছিলো এটাই, মুসলমান-মুসলমানদের মাঝে ফাটল ধরাতে হবে। এজন্য তারা নানা ধরণের কৌশল প্রসেস করেছে। তাতে তারা সাকসেসও হয়েছে। তাদের যে কৌশল সবচে বেশী ক্ষতি করেছে সেটা হলো, নারীকে বেপর্দা ও খোলামেলা ব্যবহার আর অর্থের বিনিময় প্রদানের লোভ। তারা নারীর মাধ্যমে মুসলমানদের মগজকে ধোলাই করেছে। অবাধে মেলামেশার প্রতি তাদেরকে প্রলুব্ধ করেছে। প্রচুর অর্থ পাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে- মুসলমান মুসলমান হয়েই বিধর্মীদের আদর্শ গ্রহণ করে, তা আবার প্রচারও করছে মুসলিম পরিবারে। এই সবের মাধ্যমে মুসলমান ভুলে যাচ্ছে আপন ধর্মের সকল বিধান। ক্রমে ক্রমেই ঝুকে পড়ছে বিধর্মীদের নীতি-আদর্শের প্রতি। যেমন, দাড়ি ছাটা, গোসল ফরজ হলে গোসল না করা, শার্ট-প্যান্ট পরা, আলেমদের অবজ্ঞা করা। নামাজকে বাদ দেওয়া, হাত তালি দেওয়া, গান শোনা বা গাওয়া ইত্যাদি।
অর্থাৎ সে যেন ইহুদী-নাসারাদের বন্ধু হয়ে গেলো। অথচ মুসলমানের বন্ধু তো এক আল্লাহ তাআলা এবং তিনিই অভিভাবক। দেখুন, স্বয়ং রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহান আল্লাহ পাকের কত কঠিন হুশিয়ারী করে তার বান্দাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন-
ইহুদী নাসারা কিছুতেই খুশী হবেনা, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম অনুসরণ করবে। বলে দাও, প্রকৃত হেদায়াত তো আল্লাহর হেদায়াতই। তোমার কাছে যে জ্ঞান (ওহী) এসেছে, তারপরও যদি তুমি তাদের খেয়াল খুশী মতো অনুসরণ করো, তবে আল্লাহর থেকে রক্ষা করার জন্য তোমার কোন অভিভাবক থাকবেনা এবং সাহায্যকারীও না।’ (সুরা বাকারা-১২০)
আল্লাহ তাআলা মুলত উম্মতের ভালোদেরকে উম্মতেরই খারাপদের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। ঠিক অনুরুপ এই উম্মাতের মুমিনদেরকে ফাজের বা প্রতারকদের দ্বারা, আলেমদেরকে এই উম্মাতেরই জাহেল বা মূর্খদের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। যার কারণে আল্লাহ পাক আলোচ্য আয়াতে জানিয়ে দিচ্ছেন উম্মাতদেরকে এভাবে পরীক্ষা করবেন, কারা মুসলমান হয়ে অন্য ধর্মের আসক্ত হয়, অত:পর তার পরিণতি সম্পর্কে।
তাহলে কি আমাদের উচিত হচ্ছে না যে, আমরা মুসলমানরা ইসলামি-নীতি আকড়ে ধরবো। এবং একতাবদ্ধ হয়ে থাকবো। বিধর্মী কালচার অনুসরণ করবো না!!
আল্লাহ পাক কুরআন পাকে আরো ঘোষণা করেছেন,
‘এবং তোমরা সেই সকল লোকের মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। ও আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিলো। এরুপ লোকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা আলে ইমরান-১০৫)
আলোচ্য আয়াত গুলোতে আল্লাহ পাক বারবার একথা বান্দাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছেন- তোমরা মুসলমান মুমিনের মতোই থাকো, ওদের অনুসরণ করো না। তাহলে তো এটাই বুঝা গেলো, ইহুদী-নাসারা বা বিধর্মীদের থেকে মুসলমান-মুমিনগণ আলাদা থাকবে। মিশবেনা। আর মুসলমান-মুমিনগণ এক হয়ে থাকবে, মিলে মিশে থাকবে। ঐক্যের দূর্ভেদ্য জালে জড়িয়ে থাকবে। এ কারণেই তো আল্লাহ পাক আবার ঘোষণা করেছেন-‘হে মুমিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেইভাবে ভয় করো, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত। সাবধান, অন্য কোনও অবস্থায় যেন তোমাদের মৃত্যু না আসে, বরং এই অবস্থায় আসে তখন যেন তোমরা মুসলমান। আল্লাহর রশ্মিকে তোমরা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পরে বিভেদ করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, তা তোমরা স্মরণ রাখো। একটা সময় ছিলো, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে, অত:পর আল্লাহ তোমাদের অন্তরকে জুড়ে দিলেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০২-১০৩)
এই আয়াতদ্বয় হালকা পর্যালোচনা করলেই যে বিষয়গুলো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে-
১.মুমিন মুসলমানরাই আল্লাহকে ভয় করবে এবং মরতে হলে মুসলমান হয়েই মরা উচিত।
২.মুমিন মুসলমানরাই আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরবে। কোন ইহুদী-নাসারারা নয়।
৩.আল্লাহর পক্ষ থেকেই বরং আদেশ, মুমিন মুসলমানরাই এক হয়ে থাকবে। নিজেদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করবে না।
৪.বিভেদ যদি সৃষ্টি করতেই হয়, সেটা হতে হবে মুসলমান-বিধর্মীদের মাঝে। ঐক্যের ফাটলও হবে শুধু তাদের সাথেই।
৫.মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, আগের কালে তোমরা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ছিলো, ঐক্যে ফাটল ছিলো। এখন আর তা নয়। এখন থেকে তোমরা ঐক্যের সুতোয় আবদ্ধ থাকবে।
অর্থাৎ আল্লাহ পাক তোমাদেরকে এক করে দিলেন। অন্তরে অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিলেন।
কিন্তু মুমিন মুসলমানদের মাঝে যদি ঐক্যের ফাটল ধরে যায়, তাহলে মুলত যাদের সাথে ফাটলের নির্দেশ এসেছে (বিধর্মী বা ইহুদী-নাসারাদের সাথে), তারা বড় খুশী হয়ে যাবে। বড় লাভবান হবে। ফায়েদা পাবে। আর যদি ফাটল না ধরাতে পারে, তবে ভয়ংকর বিষাক্ত প্রলোভনের মাধ্যমে সে কাজে তারা রত হবে এবং নিজেদের মাঝে তাদেরকে মিলিয়ে নেবে। Ñএতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বরং আমরা তো তার বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।
মুসলমান ফেরকাবাজী হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যাবে বিভেদ। অনৈক্য। দলাদলি আর ভয়াবহ সংঘাত। মুসলমান যদি দীন ইসলামের মধ্যে ব্যক্তিগত বা দলীয় মতামতকে প্রাধান্য দেয়, তখন কাফেরদের পক্ষ থেকে সে দীনের কাঠামো গুড়িয়ে দিতে কিছুই লাগে না। শুধু একটু টাচ। তারপর শুরু হবে দলাদলি, বাড়াবাড়ি, মারামারি আর গালাগালি। বাড়তে বাড়তে তা শুধুই বাড়তেই থাকবে। তখন তাদের অধিকার বা ক্ষমতা কমতে কমতে শুধু কমতেই থাকবে। এজন্য দীনের মৌলিক বিষয়ে দলাদলি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এ নিষেধ এসেছে কুরআন থেকেও, হাদীস থেকেও। আর তাই হক্কানী উলামায়ে কেরামের ইজমাও হয়েছে, দীন যার ঠিক থাকবে না, ঠিক থাকবে না তার কিছুই। সে কথাই আল্লাহ পাক খুব স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে বলে দিয়েছেন-
‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেই পন্থাই স্থির করেছেন, যার হুকুম তিনি দিয়েছিলেন নূহকে, এবং হে রাসুল, আর যা আপনার কাছে ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি, এমনকি যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মুসা ও ঈসাকেও যে, তোমরা দীন কায়েম করো, এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি করো না।’
আবার হাদীস পাকেও নবীজীর ফরমান আছে। মুক্তি পেতে হলে আগে আমল নয়, সবচে বেশী যেটা দরকার সেটা হলো, তোমার জীবনে তোমার দীন খাঁটি থাকতেই হবে। নবীজী বলেছেন- তুমি তোমার দীনকে খাঁটি করো। অল্প আমলই তোমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট।
অর্থাৎ, মুসলমানদের ঐক্য ভাঙ্গলে বা মারামারি হলে তা হয় দ্বীনের মধ্যেই। অন্য পার্থিব ক্ষেত্রে এসব সংঘঠিত হয় শুধু হিংসার কারণে বা ক্ষমতার জোর দেখানোর জন্য। তাই কাফেরদের যত চিন্তা এখানেই। যদি মুসলমানদের জিন্দেগীতে দীনের বাড়াবাড়ি তুলে ধরা যায়, তাহলে তারা আদর্শের উপর একতাবদ্ধ হতে পারবে না। চলবে শুধু একে অপরের গীবত বর্ণনা ও ঘায়েল করার ব্যাপারটি। অতএব হে মুসলমান! আমাদের মাঝে একতা থাকতেই হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলতেই হবে। দ্বীনে ইলাহীর আহকামের মাঝে কোন ধরণের যোগ সাজোশ বা বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ফলে কাফেররাই নিরস্ত হবে। তাদের পার্থিব স্বার্থের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মুসলমানদের থেকে ফায়েদা হাসিলের সকল পথই হয়ে যাবে রুদ্ধ। মুসলমানদের এ সকল ভূমিকাই করে দেবে তাদের সকলের মুখবন্ধ। কিন্তু কথা হলো, যে সমস্ত ক্ষেত্রে মুসলমানরা ক্রমেই অনৈক্যের দিকে ধাবমান হচ্ছে ও মুসলমান-মুসলমানে দলাদলি হচ্ছে
ফেরকা তৈরীর ক্ষেত্রে : বর্তমানে যত ফেরকা বা দল তৈরী হয়েছে, সকলেই দাবী করেন- আমরা মুসলমান। সকলের মুখে কালিমা এক। সকলেই নামাজ পড়েন। যাকাত দেন। রোজা রাখেন। হজ্জ করেন। দান করেন। কিন্তু সাধারণের কাছে বুঝবার উপায় নেই, কোন ফেরকা হক। কি তাদের ভুল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে সবাই মুসলমান। সকলের আমলও তো এক। কিন্তু যে সমস্ত হক উলামায়ে কেরাম ভুলগুলো ধরতে পারেন, তারা সংশোধনের নিমিত্তে যেই কথা বলেন, তখনই শুরু হয় বাদানুবাদ। শুরু হয় গালাগালি বা ভেদ-বিভেদ। বর্তমান বাংলাদেশের বুকে যে ফেরকাগুলো বিষ হয়ে ঘুরছে- আহলে হাদীস, লা মাযহাবী, মওদুদীয়াত, আহলে কুরআন, আহলে শিয়া, ওহাবীয়াত এরকম আরো কত কি! তাছাওউফের ক্ষেত্রে তো মাথাঘুরা অবস্থা। ভ্রান্ত দল তৈরী হতে হতে বাংলাদেশময় এক বিশৃঙ্খলপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে মানুষ শুধু ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছে। এতো বিভেদ তৈরী হওয়ার কারণে মুসলমান দিশেহারা। এ জাতির মাঝে পরস্পরের সরল বিশ^াসের মতো একটা ভালো স্বভাব ছিলো, এখন মুসলমানেরই কেউ কাউকে বিশ^াস করছে না। অপরদিকে এ বিভেদ যেন আরো বেশী ছড়াতেই থাকে, তাই পিছন থেকে যোগান দিয়ে যাচ্ছে কাফেররা।
আকিদার ক্ষেত্রে: আজকাল আকিদার ক্ষেত্রেও হাত পড়েছে। আল্লাহর পাকের তাওহীদ নিয়ে, প্রিয় নবীজীর শান নিয়ে, কিয়ামত দিবস নিয়ে, তাকদীর নিয়ে, গায়েব জানা নিয়ে কত কি বিষয়! এসবে নতুন নতুন কথা তারা জোড়া দিচ্ছে- যার কারণে তাদের সে দীন আর দীন হিসেবে অবশিষ্ট থাকছে না। অথচ এ বিষয়ে কুরআন হাদীস ইজমা কিয়াসের সমাধান রয়েছে। আর যারা এমনটি করছেন, তারা সকলেই মুসলমান দাবীকারী! এ ক্ষেত্রেও মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। বরং বেড়েই চলছে।
ফুরুয়ী বিষয়ের ক্ষেত্রে: এই মুসলমানদের আলেমদের মধ্য থেকেই সাধারণ বা ফুরুয়ী অর্থ্যাৎ দীনের মৌলিক বিষয় না; শাখা মাসআলার ক্ষেত্রেও উদ্ভট কথা প্রকাশ পাচ্ছে। ওসীলা, মিলাদ-কিয়াম, ঈসালে ছওয়াব, মুনাজাতে হাত তোলা, মাজার জিয়ারত, কদমবুসি, তবারুক, তাবিজ ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক বিষয়। অথচ এগুলোর সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে। কিন্তু প্রভাব খাটানোর জন্য কিংবা অবুঝ আকলের কারণে শুধু শুধু ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে।
ভারত উপমহাদেশে বাতিলের বিরুদ্ধে এক মঞ্চ হয়ে কাজ করেছিলো তৎকালীন দুটি হক দল- সিলসিলায়ে ফুরফুরা শরীফ ও দেওবন্দ শরীফ। যদিও তাদের মাঝে ফুরুয়ী ইখতেলাফ ছিলো। কিন্তু তাদের মাঝে দীনের মৌলিক বিষয়ে এক হওয়ার কারণে এ মতভেদগুলি একতার ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি। আর ফুরুয়ী ইখতেলাফ তো থাকবেই। থাকতেই পারে। যেমন মানুষের চেহারার ভিন্নতা, কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা, চলার ভিন্নতা, বুদ্ধির ভিন্নতা। কিন্তু সবারই হাত, পা, বুক, মুখ, চোখ, কান, নাক ইত্যাদি আছে বা সমান সমান এক। যদি কারো হাত দুটো, কারো হাত চারটি হতো, তাহলেই হয়তো কথা উঠতো।
জামিয়া শারয়িয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসার মরহুম মুহতামিম প্রখ্যাত হক্কানী আলেম উস্তাজুল আসাতিজা, শাইখুল হাদীস আল্লামা কাজী মু’তাছিম বিল্লাহ রহ. মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে বলেছেন- শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহ. ও তাঁর খান্দান এবং সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী রহ. এর উত্তরসুরীগণের চিন্তা-দর্শন তথা আহলে সুন্নত অল জামাাআত এর আকাইদ, দর্শন, তাসাউফ-তরীকত ও রুহানিয়াত দ্বারা লালিত পালিত এ প্রতিষ্ঠান মুসলিম জাগরণ ও মর্দে মুজাহিদ মুহাক্কিক আলেম তৈরীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের হক মাশরাব ও সিলসিলাগুলোর মধ্যকার খুটি-নাটি ফুরুয়ী ইখতিলাফ নিয়ে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়নি। সেই বিদআত, যে বিদআত সকল হক্কানী উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে বিদআত, এ মাদরাসা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। কিন্তু যে বিদআত বিষয়টি নিয়ে দুই দল হক্কানী উলামায়ে কেরামের মধ্যে ইজতেহাদী মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, সে বিষয়টি ইখতেলাফী মাসআলার অন্তর্ভূক্ত যা প্রকারন্তে ফুরুয়ী ইখতিলাফ। এমন বিষয় নিয়ে বিভেদের বীজ ছড়ানো আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের নীতি বিরুদ্ধ।
হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. আগেই হুংকার দিয়ে রেখেছেন, “ফুরুয়ী ইখতিলাফী মাসআলা একে অপরের সাথে শত্রুতা করা, ফাসেক ও গোমরাহ ফতওয়া দেওয়া কাজটিই হলো বিদআত, গোনাহের এবং সলফে সালেহীনের নীতির বিরোধিতার নামান্তর।”
আমলের ক্ষেত্রে: আমলের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের মাঝে চরম থেকে চরমতম বিবাদ, বিভেদ সবই বিদ্যমান। একদল বলে, এ আমল করা যাবেনা। আল্লাহর নবীজী এটা করেননি। করলেও আমাদের করতে হবে- এমন জোর আদেশ দেননি। এ আমলের বর্ণনা সরাসরি কুরআন-হাদীসে নেই। অন্যদল বলে, এটা করতেই হবে। সব ভালো কাজই, যেটার প্রতি কুরআন-হাদীসের কোন না কোন দিক সুক্ষ্ম হলেও ইঙ্গিত রয়েছে- সেটা নফল বা মুস্তাহাব মেনে আমল করতে হবে। আওয়াবিন নামাজ নিয়ে উলামাদের মাঝে কি যে দ্বন্দ্ব! মুনাজাতে হাত তোলা নিয়ে কি যে বিতর্ক! ঈসালে ছওয়াব নিয়ে কি যে জঘন্য অপবাদ! যেন বিরাট একটা পাপ করে ফেললাম। আসলে এগুলো কি খারাপ কাজ! কুরআন-হাদীসে কি ইঙ্গিত নেই! কোন কাজ নব্যসৃষ্ট মন্দ বিদআত বিবেচিত হয়ে পরিতাজ্য হবে আর কোনটা নব্যসৃষ্ট ভালো বিদআত বিবেচিত হয়ে পালন যোগ্য হবে- এসব কথা কি কুরআন-হাদীসে নেই! শুধু দ্বন্দ্ব! শুধু ইখতেলাফ! গালাগালি! বিতর্ক-কথা কাটাকাটি!
উভয় হকওয়ালার ক্ষেত্রে: বর্তমানের পরিচিত চিত্র- হক মানুষগুলির মধ্যেও দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। শুধু অহংকার আর কম জ্ঞানের কারণে। এক পীর আরেক পীরকে, এক আলেম আরেক আলেমকে, এক দল আরেক দলকে গালাগালি করছেই। যদিও সবাই হকওয়ালা বা হকের পতাকাবাহী। অহংকার আলেমকে, পীরকে, সত্যে প্রতিষ্ঠিত দলকে নি:শেষ করে দিচ্ছে। তো এই হকওয়ালাদের মাঝেই যদি এমন দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে কিভাবে একতার পতাকাতলে শামিল হওয়া সম্ভব! কাফেররা তো ফায়েদা লুটবেই!
মুজাদ্দিদে জামান আবুবকর সিদ্দীকি ফুরফুরাভী রহ. কি দারুণ সমাধান দিয়ে গেছেন- “আপনাদের মধ্যে যদি কোন মাসআলা লইয়া ইখতেলাফ বা মতভেদ হয়, তবে একত্রে বসিয়া কেতাব সমূহ লইয়া মতভেদ মীমাংসা করিয়া সর্বসাধারণের নিকট মত প্রকাশ করিবেন। যাবৎ পর্যন্ত ঐরুপ আলেম সাহেবদের একতা না হইবে, তাবৎ পর্যন্ত আলেম সমাজে দলাদলি থাকিবে, অচিরেই সমাজ বিনষ্ট হইবার আশংকা আছে।”
অতএব, এভাবেই মুসলমানদের মাঝে ইখতেলাফ জঘন্যতর রুপ ধারণ করছে। ফলে এক হওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। একক শক্তির অধিকারীও আর হয়ে দিয়ে উঠছে না। যার কারণে কাফেররা মাথাচাড়া উঠছে, এতে লাভবান হচ্ছে তারাই। তাদের পার্থিব মিশনকে উঁচিয়ে করতে ধরতে আর মুসলমানদের দীনি মিশনকে ধুলিস্মাৎ করতে তারা নানা ফন্দি এটেঁছে, এটেঁই যাচ্ছে- যা আগেই বলেছি। এভাবে কিন্তু দীনের মিশনকে এগিয়ে নেয়া যায়না। কোনভাবেই সম্ভব না।
এজন্য কথা একটাই, মুসলমানদের অনৈক্যে ফায়েদা পাচ্ছে কাফেররা। ঠিক বিপরীত হলে হবে- মুসলমানদের ঐক্যে কাফেরদের গোষ্ঠির কেউ ময়দানে আসতে পারবেনা। ইতিহাসও যার সাক্ষী। অতএব, ফুরুয়ী ইখতেলাফ থাকে থাকুক, দীনের মৌলিক বিষয়ে সকল মুসলমান এক হয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে আগে কাটা হতে হবে। তাদেরকে পরাস্ত করে দীনের দাওয়াত দিতে হবে। সকল হিংসা, অহংকার দূরে ঠেলে ফুরুয়ী ইখতেলাফকে নিচে রেখে দীনের মৌলিক বিষয়ে একমত হয়ে একতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই সম্ভব, বাতিলের বিরুদ্ধে এক হওয়া। ইসলাম ব্যতীত সকল ভ্রান্তদলকে আগুনে পুড়ায়ে মারা। ইহুদী-নাসারাদের সকল পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র ধুলিস্মাৎ করা। আল্লাহ আমাদেরকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *