শেষ বিকেলের রোদ

শীতের শেষ বিকেলে কালো রংয়ের শাল গায়ে জড়িয়ে একজন বৃদ্ধা বসে আছে পুরাতন একটা দুতলা বিলডিংয়ের ছাদে। বৃদ্ধার নাম আশা। বাড়িটা এখন পুরোনো হলেও একসময় ছিলো বেশ রাজকীয়। পুরোনো দিনগুলির কথা মনে হতেই বিষণœতায় ভরে আসে আশার মন। কষ্টের স্মৃতিগুলো ডানা মেলে উড়তে থাকে তার চারপাশে।
মা বেঁচে ছিলেন না বিধায় বাবা আর বড় দুভাই ছিলেন তার সুখের পৃথিবী। অভাবের সংসার হলেও সব আবদার পুরন করার চেষ্টা করতেন তারা। বাবা খুব শখ করে বিয়ে দিয়েছিলেন এ বাড়ির বড়ছেলে রমিজের সঙ্গে। ভালোই কাটছিলো তাদের দিনকাল। বিয়ের দুবছর পর তার কোলজুড়ে এলো মেয়ে শিমু। কিছুদিন পর দেবরও বিয়ে করে মোটা অংকের যৌতুক নিয়ে।
একদিন সকালবেলা আশার ঘুম ভাঙ্গলো শাশুড়ির ডাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘তোমার বাবাকে বলো ৫০ হাজার টাকা দিতে।’
কথাটা শুনে আশার বুকের ভেতরটায় সজোরে একটা ধাক্কা লাগলো। অভাবের সংসারে বাবা কোথায় পাবে এতো টাকা! কথাটা শাশুড়িকে বলতেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলতে লাগলেন, ‘দেখো বড় বউমা, বিয়ের সময়ই আমি টাকার কথা বলেছি। বড় ছেলেটার জন্য বলতে পারিনি এতোদিন। আজ না বলেও পারলাম না। ছোট বউয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের দুদিন পরেই টাকা দিয়ে দিয়েছে। আর তোমার বাবা এখনো দিতে পারলো না!’
ছিঃ ছিঃ বলতে বলতে চলে গেলেন শাশুড়ি। এঘটনার আকস্মিকতায় আশার মনটা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। বাবাকে এসব কথা বলা যাবে না। আশা জানে, এখন বাবাকে যৌতুকের টাকার কথা বললে চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এদিকে শাশুড়ির কড়া নির্দেশ, টাকা না দিতে পারলে এ বাড়িতে চাকরানীর মতো থাকতে হবে। এরপর শুরু হলো শাশুড়ি আর দেবর-ঝায়ের অমানবিক অত্যাচার। শিমুর বাবা কিছু বলতে পারতো না মায়ের সামনে। কেবল শান্ত্বনা দিয়ে রাখতো। বলতো, একদিন তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এ বাড়িতে বউয়ের মার্যাদা আবার ফিরে পাবে।
কিছুদিন পর আশার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বলটাও আর রইলো না। এক মেঘভাসা বিকেলে খবর এলো শিমুর বাবা আর নেই। রোড এক্সিডেন্ট হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ওপারে। এ খবর শুনে আশার শাশুড়িও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
এ বাড়িতে চাকরানীর কাজ করে আশা কাটিয়ে দিলো ১৫ টা বসন্ত। শিমুর কাকা বললো, শিমুর খুব বড় বাড়িতে বিয়ে ঠিক করেছ। দুদিন বাদেই নাকি বিয়ে। কিচ্ছুটি বলতে পারলো না আশা। কারণ সে এ বাড়ির চাকরানী। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো নিজের মেয়ের বিয়ে। বিয়ের ১৫ দিন পরে খবর এলো ওর বরকে দু লাখ টাকা দিতে হবে। মায়ের মতো মেয়েরও বুঝি কপালটা পুড়লো।
পাগলের মতো আশা ছুটে গেলো দেবরের কাছে। বললো, ভাই তুমিই শিমুকে বিয়েটা দিয়েছো। এখন তারা দু লাখ টাকা যৌতুক চাচ্ছে। তুমিই এখন ব্যবস্থা করে দাও যৌতুকের টাকা। এ কথা বলতেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো আশার দেবর।
এক সন্ধ্যায় আশা দেখে কে যেনো পাগলের মতো ছুটে আসছে এদিকে। মাথার চুল উস্কুখোস্কো। কাছে আসতেই চিনে ফেললো প্রিয় মুখখানা। একি! এতো শিমু! দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো আশা। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে মা তোর?’
কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘মা, ৭ দিন ধরে বেধম প্রহার ছাড়া আর কিছুই জোটেনি এই কপালে। এক ফোঁটা পানিও না।’
সেদিনকার এটাই ছিলো শিমুর শেষ কথা। গলায় ফাঁস দিয়ে চলে গলো অভাগী মাকে ফাঁকি দিয়ে। কদিন পর দেবর সংসার নিয়ে কোথায় যেনো চলে গেলো। এ বিশাল বাড়িতে আশা এখন একা। নিঃসঙ্গতা তার নিত্য সঙ্গী।
পেছন থেকে আয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো আশা। আয়া বললো, ‘দিদি, সন্ধ্যা হয়েছে। চলো ভেতরে চলো।’
গভীর রাত। আশা তার দুঃখময় স্মৃতি, নিঃসঙ্গতা আর শব্দহীন বুক নিংড়ানো কান্না নিয়ে আরো একটি অর্থহীন বিবর্ণ সকালের প্রতিক্ষায় ধীরে ধীরে চোখ দুটি বন্ধ করলো।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *