আত্মহত্যার আত্মকথা

এতখানি ভালোবাসার পরেও কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে এটা মেনে নেওয়াটা বুবলির পক্ষে ভীষণ কষ্টকর। কি নেই বুবলির মাঝে? গ্রামের নামকরা বংশের মেয়ে বুবলি। যেমন সে দেখতে সুন্দরী তেমনই ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি ভালোই বলা চলে। গ্রামের পরিমণ্ডলে বড় হওয়া বুবলি এইচ এস সি পাশের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ঢাকায় থাকত একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে তিন বন্ধবীসহ। তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে সে। পর্দার ব্যাপারে তত যতœবান না হলেও একেবারে অশালীনভাবে চলাফেরা করত না বুবলি। প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পর থেকে এক বছরের সিনিয়র সাজ্জাদের দৃষ্টি পড়ে বুবলির উপরে। সে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বলল,
‘তোমাকে আমার প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে।
আমাদের লেখাপড়া সম্পন্ন হলেই আমরা বিয়ে করব। তোমার ইচ্ছা থাকলে জানিও।’
সাজ্জাদ দেখতে ছিল বেশ স্মার্ট আর লেখাপড়ায়ও ভালো সেই সাথে আবার বড়লোক বাবার ছেলে। তার মতোই পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করছে। সবদিক ভেবে বুবলি রাজি হয়ে গেল তার প্রস্তাবে। সে সাজ্জাদকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিল যে তার প্রতিটি কথা তার কাছে অমৃত মনে হতে লাগল ….জীবনটা মনে হতে থাকল তার কাছে স্বপ্নের মতো। পার্কে বসে গল্প করে দুজনে অনেকটা সময় অতিক্রম করত। সুযোগ বুঝে সাজ্জাদ তাকে নিয়ে যেত মাঝেমধ্যে হোটেলে। সেখানে রাত কাটিয়ে আসত। বুবলি প্রথম দিকটায় নিষেধ করলেও পরবর্তীতে তেমন একটা আপত্তি করত না। এভাবে বছর দুই অতিক্রম হয়েছে। সাজ্জাদ কেমন যেন এখন আর বুবলিকে পাত্তা দিতে চায় না। বুবলি জানতে পেরেছে সাজ্জাদ এখন অন্য এক মেয়ের পিছনে ঘুরে আর সেই মেয়ে বুবলির চেয়েও অনেক সুন্দরী আর স্মার্ট। একসঙ্গে দু’জন শপিং এ যায়, হোটেলে বসে খাওয়া দাওয়া করে আরও কত কি। বুবলি সামনে এলে সাজ্জাদ তাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে যায়। বুবলি এতটা অপমান সহ্য করবে কেমন করে? সে এই কলঙ্কিত জীবন নিয়ে আর বেঁচে থাকতে চায় না। তাই সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সামনে পুজোর বন্ধে বান্ধবীরা সবাই বাড়ি চলে গেলে সে থেকে যাবে আর আত্মহত্যা করবে বলে মনস্থির করে ।
যেই কথা সেই কাজ। পরিকল্পনা মাফিক সে পুজোর বন্ধে বাড়ি যায় না যদিও তার বান্ধবীরা তাকে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করে। সোমবার সকাল আটটা বাজে সে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়েছে এবার শুধু গলায় দিয়ে ঝুলে পড়ার পালা, ঠিক এমন সময় দরজায় কড়া নেড়ে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক বলতে থাকে,
‘মাগো! আমারে কিছু খাইতে দেবেন? কাল থেকে না খাইয়া আছি ।’
বুবলির মনে দয়ার উদ্রেগ হল। সে ভাবল, ‘আমি তো পৃথিবী ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। যাবার আগে একটা ভালো কাজ করেই না হয় যাই।’
সে দরজা খুলে বৃদ্ধ ভিক্ষুককে গতকালের রান্না করা এক প্লেট ভাত দিল মুরগির মাংস সমেত। আরেক হাতে তার ব্যবহৃত কাঁচের গ্লাসের এক গ্লাস পানি দিল। দরজায় একটি পিঁড়ি দিল বসে খাওয়ার জন্য। খুব মজা করে গোগ্রাসে ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকটি খেয়ে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করল, ‘হে আল্লাহ্! তুমি এই আম্মাজানরে অনেক হায়াত দান কইরো আর ভালো রাইখো।’
বুবলি নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল কিন্তু বৃদ্ধ ভিক্ষুককে নিজের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে দিল না। এরপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেই দরজা বন্ধ করবে সেই দেখতে পেল পাশ দিয়ে এক পত্রিকাওয়ালা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে যাচ্ছে সাইকেলে চড়ে। আনমনে তাকে থামতে বলল। একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ক্রয় করে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল আর মনে মনে ভাবল, ‘মরে তো যাবই। আধা ঘন্টা পরেই না হয় মরি। আজকের পত্রিকায় কি লেখা হয়েছে একটু চোখ বুলিয়ে নেই ।’
দরজাটা বন্ধ করে ভিতরে এসে পত্রিকার এই পেজ সেই পেজে কোন মতে চোখ বুলাচ্ছিল বুবলি। হঠাৎ একটি লেখায় তার চোখ আটকে গেল। লেখাটি ছিল আত্মহত্যা সম্পর্কে হাদিস এবং কোরআনের আলোকে আলোচনা। সেই লেখাটি পড়ে বুবলি রীতিমতো ঘামতে থাকে। সেই সাথে মহান আল্লাহ্ র ভয় জাগ্রত হয় তার অন্তরের মাঝে। পত্রিকাটিতে লেখা ছিল আত্মহত্যাকারী নিজেকে যে উপায়ে হত্যা করবে, তাকে সেভাবে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন-
‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামে লাফ দিতে থাকবে স্থায়ীভাবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে স্থায়ীভাবে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবে, জাহান্নামে সেই ছুরি তার হাতে থাকবে। তা দিয়ে সে তার পেটে আঘাত করবে, তাতে সে স্থায়ীভাবে থাকবে’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৭৮)।
পত্রিকার লেখাটি পড়ে তার মাঝে আমূল পরিবর্তন আসল। সে ভাবতে লাগল, ‘আমি কেন এক লম্পট, বিশ্বাসঘাতকের জন্য নিজের জন্য জাহান্নামকে বেছে নেব? কেনই বা আমার বাবা মাকে কষ্ট দেব? তারা আমার আত্মহত্যার সংবাদ সহ্য করবেন কি করে? আমার ছোট্ট ভাইটিও পথ চেয়ে আছে আমি কবে বাড়ি ফিরব সেই আশাতে। না না আমার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। আজই আমিও বাড়ি চলে যাব। ছুটি কাটিয়ে এসে আবার লেখাপড়ায় মন দিব। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দরিদ্রদের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেব।’
সিলিং ফ্যান থেকে ওড়না খুলে ফেলে কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে বুবলি রওনা দিল গ্রামের বাড়ির দিকে। পিছনে পড়ে রইল তার নষ্ট জীবনের কষ্টকর কিছু স্মৃতি আর সামনে থাকল সুন্দর জীবনের অপার সম্ভাবনা। বাড়ি থেকে সবার সাথে হাসি আনন্দে মেতে পুজোর ছুটি কাটিয়ে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এল কয়েকটি বোরখা আর ইসলামিক জ্ঞানের বই এবং আল-কোরআন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মহান আল্লাহ্ র কাছে পূর্বের ভুলের জন্য তওবা করতে থাকে সে। আর সকাল সন্ধ্যায় কোরআন পাঠ করে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে। তার মনটা এরপর থেকে অনেকটা প্রশান্ত থাকত। সাজ্জাদকে দেখলে এখন সে নিজেই এড়িয়ে অন্যপথে হাঁটে। কারণ তাকে দেখলে বুবলির অন্তরে এখন আর ভালোবাসা জাগ্রত হয় না। তার চোখে চোখ রেখে আর স্বপ্ন বুনতে মনে চায় না বরং তাকে দেখলে ঘৃণায় তার অন্তর পূর্ণ হয়ে যায় ….সেই সাথে মনে পড়ে নিজের বোকামির কথা ….অবিবাহিত হয়ে এতটাই নিকটে যাওয়া ,এতটাই ভালোবাসা পবিত্রতার বিপরীত যাতে ইসলামের সৌন্দর্য রক্ষা হয় না …..তাই একাজে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টিও থাকে না….থাকে না রহমত। বুবলির নিজের মাঝে যখনই অপরাধবোধ কাজ করে তখনই সে তওবা করে আর মনে মনে পাঠ করে সেই দোয়াটি যেটি রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়তেন :
‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ছাড়া ইবাদতের আর কোন যোগ্য উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। আমি তাঁর কাছে তওবা করছি।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যেই ব্যক্তি এই দোয়া পড়বে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলাতক আসামী হয় অর্থাৎ সে যদি বড় রকমের গুনাহগার হয়, তবুও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন (তিরমিযী ৪/৬৯) ।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *