বুনো বোন

তরুণী নাছোড়বান্দার মতো আমার ডান হাত চেপে ধরলো। বললো-‘এই বুনো বোনকে বিশ্বাস কর। যদি তোর উপকার না হয় আমি কিয়ামতের দিন দায়ী থাকবো।’ বিশ্বাস অবিশ্বাসের পারদ উঠা নামা করে আমার মস্তিষ্কে। এক হাত পায়জামার পকেটের উপর। বহু কষ্টে জমানো সামান্য টাকা আমার জন্য অনেক কিছু। শখ করেছি একটা স্মার্ট ফোন কিনবো। শখের ভরা যদি ডুবে যায়।
তার মুখে কিয়ামতের কথা শুনে মনে হলো সে মুসলমান উপজাতি হবে। বাংলাদেশে একমাত্র পাঙন উপজাতি মুসলমান জানি। অন্য কোনো উপজাতি কিয়ামতে বিশ্বাস করে কি না আমার জানা নেই।
হিসাব নিকাশের দিবস কিয়ামতের কসম শুনেও আমি তাকে এর চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতে অপারগ। সন্দেহ আশঙ্কা আমার সমস্ত মন জুড়ে । তারা যে কাউকে বশে আনার মন্ত্র হয়তো জানে। ব্যাংক থেকে একটু আগে তুলা পঁচিশ হাজার টাকা এবং একটা নতুন চেক বই আমাকে অস্বস্থির মধ্যে রেখেছে। তার সম্মুখে যখন বসেই পড়েছি তখন নিজেকে স্থির রাখতে আত্মবিশ্বাসে দোয়া কালাম জপ করতে থাকি। কাজ হয় বুঝতে পারি। যদিও নিশ্চিত নই, সে মন্ত্র পড়ে বশ করার ফন্দি করছিল কি না।
ছোট কালে দেখতাম তারা তিন চার জনের এক দল বাড়ি বাড়ি ঘোরে বেড়াতো। এখন তেমন দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বাড়িতে উচু প্রাচীর আর গেইটে লোহার মজবুত দরজা। গেইট পেরোনো তাই ভীষণ বিড়ম্বনার। বুনো বোনটি আমাকে বশ করতে চাচ্ছিলো কি না বুঝা দুষ্কর। তবে আমার কৌতুহলপূর্ণ সরলতাকে সে বশ করা বা আমাকে বোকার হদ্দ ভেবে বসেছিলো। তার এ মনোভাবে আমি চমৎকৃত হই। চার পাশে বসা অন্যান্যদের দিকে তাকালাম। দেখলাম বুনো বোনদের সাজগোজ, পোষাক পরিচ্ছদ, কথা বলার ধরণ ও আচরণ আমার অভিজ্ঞতাকে নতুন রূপে পরিপুষ্ট করছে। আর এটাই ছিল তাদের সমগোত্রীয় পেশার একজনের কাছে প্রায় নতজানু হয়ে বসে পড়ার পরোক্ষ রহস্য।
যতো সময় গড়াচ্ছিল, আমার বিরক্তি বাড়ছিল। কিন্তু যতো প্রহর সে দীর্ঘ করছিল ততো আত্মতৃপ্তিতে তার ফর্সা মুখ আরো উদ্ভাসিত হচ্ছিল। তার পাশে বসা আরেক বুনো বোন তাকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বললো আমি এর কিছুই শুনি নি। উত্তরে আমার হাত ধরা বোনটি শুধু বললো- ‘সবুরে মেওয়া ফলে।’ কথাটি শুনে যা বুঝার বুঝে ফেললাম এবং দেখলাম তার মুখাবয়বে আত্ম গৌরবের একটা বৃক্ষ শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি শিক্ষক মানুষ। ক্লাসের সময় ঘনিয়ে আসছে। রাজ্যের তাড়াহুড়া আমার ভেতর। ছটফট করছি, বুনো বোনটি মুক্তি দিক। কিন্তু সে ছাড়ছে না। মনে হচ্ছে, যেন সে প্রতীক্ষা করছে- সখাকে আজ দেবো না বিদায়। এতো দিন কোথায় ছিলে? হাত ফসকালেই আর পাবো না তোমায়। আমার প্রশংসায় সে পঞ্চমুখ হলো। বললো-‘এতো সুন্দর মানুষ তুই, আর পায়ের এই নখ থাকবে বিশ্রী- তা কী হয়রে! এই দেখ, আমার এই নখের মতো তোর এই নখটিও সুন্দর- আকর্ষণীয় করে দেবো।’ মনোযোগের সাথে দেখলাম তার পায়ের নখ গুলো বাস্তবেই খুব সুশ্রী। মেহেদীর কড়া লাল রঙের উপর রোদ পড়ে চক চক করছে। তার গায়ের রঙ যতোনা ফর্সা তার সাথে ততোই পরিপাটি পোশাক পরিচ্ছদ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বিউটি পার্লার থেকে এই মাত্র সেজে এসেছে এক নববধু। মাঝে মাঝে অনিচ্ছায় বুকের উপর থেকে শাড়ীর আচল সরে পড়লে বাম হাত দিয়ে তা ঠিক করে নেয়। তার ঘাড়ের উপর ছোট্ট তিলটিতে বার বার চোখ আটকে যায়। সে হয়তো বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। অথবা হতে পারে আমার নতজানু হয়ে বসাকে উপভোগ করে হাসছে। সহজে বুঝা যায়- সে আমাকে তার কাস্টমার পেয়ে খুব তৃপ্ত।
দু’তিন গোটা রসুন বা পিয়াজ, কিংবা ছোট্ট এক কৌটা চালের বিনিময়ে শিঙ্গা লাগাতো তারা। হাতে, পায়ে বা শরীরের যেখানে বাত- ব্যথা সে স্থানে শিঙ্গা লাগিয়ে কালো রক্ত বের করে কলা পাতায় রাখা ছাইয়ের উপর ফেলতো। পায়ের নখের পোকা, দাঁতের পোকা সব কিছু রসুন, পিয়াজ বা চালের দ্বারা তারা কাজ করতো। এখন নগদ টাকা দাবী করে। ১০০ বা ২০০টাকার কমে তারা কাজেই হাত দেয় না।
আমার বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখে সমস্যা। ছোট বেলা অত্যধিক ফুটবল খেলার সময় নখের কোণে কাদা ঢুকে আটকে থাকতো। রাতে ব্যথায় খুব যন্ত্রণা করতো। দিনে সুঁই দিয়ে খুচিয়ে কাদা বের করতাম। আঙ্গুলটি ফোলে কলা গাছ হতো। পুঁজের কবল থেকে বাঁচতে ছেঁড়া লুঙ্গির টুকরা দিয়ে বেঁধে রাখতাম। এক বার বড় আকারের বন্যা হলো । পথ ঘাট ডুবলো। ভারত থেকে আসা পচা দুর্গন্ধময় পানিতে। এই পানি শরীরের যেখানে লাগে চুলকানি শুরু করে। বড়দের বারণ সত্ত্বেও সেই পানিতে ডুবা পথে হাঁটতে গিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলির ক্ষত স্থানে খোঁচা লাগে। সে দিন থেকে রক্ত ও পুঁজ পড়া বাড়তে থাকে। এক সময় আঙ্গুলের নখ মরে যায়।
ফুলকে ঘিরে যেমন মৌমাছিরা ঘুরঘুর করে ঠিক তেমনি কয়েক ছোকরা বুনো বোনের চার পাশে পাক দিচ্ছে। সম্ভবত আমাকে দেখে কাছে আসছে না। দুই ছোকরা কী ভেবে হঠাৎ কাছে এসে গেলো। আমি তাদের মুখের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম। চোখাচোখি হলে দেখলাম তাদের মুখে লজ্জা, জড়তা ও জোরপূর্বক সাহস রাখার এক কৃত্রিম কৌশল। তাদের একজন বললো-‘ দেশি আমাদের বাড়িতে যাবে? গেলে দাঁতের পোকা খোলাতাম।’ মুখে হাসির পশলা আর হাতের তুলো দিয়ে আমার বুড়ো আঙ্গুল ঘষে ঘষে বুনো বোন বললো- ‘ বাড়িতে আমরা যাই না। দরকার হলে এখানেই বস।’ ছোকরা দু’টি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তাদের কথায় নির্লজ্জতা দেখে আমি বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম-‘ আমার সময় কম। তাড়াতাড়ি হলে পোকা তোলার কাজে লেগে যাও। না পারলে আমাকে বিদেয় দাও।’
বুনো বোন অনেক কথা বলে আমার আস্থাকে ঠিক রেখে দাম কষাকষিতে লাগলো। যত সময় যাচ্ছে আমার তাড়াহুড়া বাড়ছে। তাই একটু বেশি দামেই আমি রাজি হলাম। কাজে আসুক বা না আসুক স্বীয় অঙ্গ থেকে পোকা খসানোর অভিজ্ঞতার লালসায় জীবনে এই প্রথম ফুক ঝাড়–র বুনো বোনের কাছে নিজেকে সপে দিল্মা।
কথার ছলে সহকর্মী সামাজিক বিজ্ঞানের স্যারকে বললাম ঘটনাটা। তিনি খুব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন -‘এদের কাছ ঘেঁষেন কেন। এরা খুবই ছেচড়া। খুবই খারাপ।’ একই দেশের আলো ছায়া ও বাতাসে বেঁচে থাকা অভিন্ন রক্ত মাংসে গড়া কোন মানব গোষ্ঠীকে কেবল পেশাদারিত্বের বিচারে কেমন হেয় করে দেখা হয় তা অবগত ছিলাম। কিন্তু এমন ঘৃণ্য দৃষ্টিতেও যে কাউকে দেখা হয় তাও আবার একজন সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাছ থেকে এটা আমার কল্পনায়ও ছিল না। শুনে মনে হল একটি যাযাবর সংখ্যালঘু মানব গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীর ঘৃণার পাত্র হয়েই জন্মগ্রহণ করে এটাই বাস্তবতা। তবে তা নিয়তি নাকি অভিজাত মানব গোষ্ঠীর জন্য খোদা প্রদত্ত কোনো পরীক্ষা তা আমাকে ভাবায়।
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরীজীবী কারো মাসিক বেতন লক্ষ টাকা। অসদোপায়ে অনেকের উপার্জন চিন্তার অতীত। একই সরকারের অধীনস্থ সাধারণ জনগণ অনেকের পেটে দুবেলা ঠিকমত ভাত জোটে না। যাযাবর গোষ্ঠী, যাদের মাথা গোজার ঠাঁই নেই। মাসিক আয় শত চেষ্টা ও কষ্টে সর্বোচ্চ তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের ভেতর তাদেরও জীবন চলে স্বার্থপর দুনিয়ায়। তাদের জীবন নিয়ে সরকার যেমন নির্বিকার তেমনই চোখ বাঁধা সামাজিক মানবকুল। বাংলাদেশে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিভাবকত্বের ধ্বজাধারী গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক এবং অন্যান্য এনজিও গুলোও যেন এসব দেখে না- বুঝে না।
তারা নদীর কিনারে একটু উঁচু জায়গায় তাবু গেড়ে আছে কয়েক বছর থেকে। আসা যাওয়ার পথে তাদের তাবু ও কাজ কর্ম এমনিতেই চোখ পড়তো। কখনো গভীর ভাবে তাকানোর প্রয়োজন বোধ হয় নি। এখন যাওয়া আসার সময় গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকি তাদের তাবু, কাজ- কর্ম ও অলিতে গলিতে, তখন চোখ আটকে থাকে তাদের জীবন প্রণালীর পরতে পরতে। জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত সেই মানব সম্প্রদায়ের সুখ- দুঃখ, আনন্দ- গ্লাণীতে নিজেকেও একাকার দেখতে পাই। মনের অগোচরে সেই বুনো বোনকে দৃষ্টি ও মন খুঁজে বেড়ায়। কেন জানি তার জন্য একটু সমবেদনা একটু ভালোবাসা অনুভব হয়। রিক্সায় বসে দুই চোখের দৃষ্টি সব তাবুর আশ পাশ তন্ন তন্ন করেও বুনো বোনের সাক্ষাৎ ঘটেনা। দিন যায় মাস যায়। বছর গড়াতে শুরু করেছে কিন্তু তার দেখা আজও মিলে নি। বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ অনেকটা সুস্থ হয়েছে আজ। পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। তাতে আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ শুধু একটাই, সেই বোন আজ কোথায় হারিয়ে গেলো। এক ঘন্টার এক পশলা স্মৃতি আমাকে মাঝে মাঝে হাসায়, ভাবায়। এটা কেন হয় বুঝতেই পারি না।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *