বগলের পকেট

ফেসবুকের জ্বর উঠেছে সরলা খাতুনের। ফেসবুকের জ্বর কমাতে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে গ্রহণ করেছে অভিনব পদ্ধতি। এটা যেন ঔষধ সেবনের মতো জরুরী। মোবাইলটি তার বগলেই থাকে সব সময়। মাঝে মাঝে মোবাইলটি হারিয়ে যায়। আসলে ঠিক হারানো নয়, আত্মভোলা। সেটি এক স্থানে রেখে সমস্ত রোম খুঁজতে হয় তখন। নিজের রোমে না পেলে বাসার সব রোম তন্ন তন্ন করে খুঁজে নেয় সরলা। বগলে দা রেখে সমস্ত বাডি় মাথায় তুলার মতো ঘটনা ঘটে। সব শেষে সরলা ঠিকই তার হারানো জিনিসটি পেয়ে যায়। আর পায় তার বগলেই, তার প্রতিটি কামিজের বগলে সেলাই করা একটি ছোট্ট থলে বা পকেট আছে। এটা খুবই গোপনীয় স্থান। কারো সামনে সেখানে হাত দিতে নেই। ভুলেও সে দেয় না। সেদিন কামিজ বদলের সময় মোবাইলটি বগলের পকেটেই ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়া থাকায় সেটার পকেট পরিবর্তন করা হয়নি। সরলাখাতুন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার বড় ভাই ঝন্টু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত। ঝন্টুর চেয়ে সরলারই লেখা পড়ার চাপ বেশি। তবু প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ফেসবুকে বিচরণ করা চাই। ঝন্টু বাসায় থাকলে তার ভীষণ ব্যত্যয় ঘটে। এর সহজ একটা সমাধানও সে করে নিয়েছে। যার নাম ‘বাথরুম থিওরি’। ঝন্টু বাসায় থাকলে সরলা বাথরুমেই কাটিয়ে দেয় অর্ধ বা পৌনে এক ঘণ্টার মতো। বাথরুমে ঢুকলে সময় যে কখন ফুরোয় সরলা তা টেরও পায় না। সে ভাবে এইতো আট-দশ মিনিট কাটলো বোধহয়। এভাবে কিছু দিন পর ঝন্টুর চোখে ধরা পড়ে বাথরুম কাণ্ডটি। ঝন্টু প্রথমে ব্যাপারটি বুঝার চেষ্টা করলো। এতো লংটাইম বাথরুম জার্নিতে সরলা থাকবে কেন? তার পেটে আমাশয় টামাশয় কিছু হয়নি তো? গোসল করতেও তার এতো সময় লাগে না কোনো দিন। সর্বোচ্চ আট থেকে দশ মিনিটে তার গোসল শেষ হতে বাধ্য। আর বাথরুমে কমেটের ঐ কাজটি করে আরও কম সময়ে। তাহলে রহস্য কি? একদিন সরলা বাথরুমে ঢুকলো। ঝন্টু আড়ি পেতে বসলো বাথরুমের দরজায়। তার হাতে স্টপওয়াচ। সময় নীরিক্ষার জন্য উত্তম যন্ত্র। যেহেতু তার মোবাইলে ‘স্টপ ওয়াচ’ নামক বস্তুটি রযে়ছে তাই সেটা ব্যবহার করতে অসুবিধা নেই। সময়ের ডিজিটাল সংখ্যাটি দ্রুতই বাড়ছে। পুরো ত্রিশ মিনিটের সংখ্যা ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে। সরলা তবু বাথরুম থেকে বেরুনোর নড়চড় নেই। এতো সময় ধরে কী করে ছোট্ট বোনটি? টেপের পানি পড়ার শব্দ, কমেটের শব্দ, নড়াচড়ার শব্দ কিংবা কুঁথুনির শব্দ কোনো শব্দই আসে না বাথরুম থেকে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে ঠিক সরলাখাতুন বাথরুমের দরজা খুলে বেরোয়। সামনেই ভাইয়াকে দেখে একটু থতমত খেলো। পরে স্বাভাবিক গতিতে তার রোমের দিকে এগুতে চাইলো। ঝন্টু তাকে আটকালো। বললো দাঁড়া। -কেন? সাতচল্লিশ। -এই সাতচল্লিশ মিনিট বাথরুমে কি করেছিলে? সরলা বুঝে ফেললো আজ ধরা খেযে় গেছে। প্রসঙ্গ পাল্টে নিতে বললো- কেন ভাইয়া, তুমি দরজায় আড়ি পাতছিলে নাকি? ছি: ছি: ভাইয়া তুমি না…।
– শুন, শুন। শুধু আজ নয়। কযে়ক দিন ধরে লক্ষ্য করছি তুই বাথরুমে বেশী সময় নিচ্ছিস। কিন্তু কেন? পেটে অসুখ টসুখ হয়নি তো? – না ভাইয়া। তা কিছু নয়। বাথরুমে নিউজ পেপার পড়ছিলাম। – কই, কই। নিজউ পেপার কোথায়? তোর হাতে তো কিছুই দেখছি না। – কাগজের পত্রিকা নয়। মোবাইলে পত্রিকা পড়ছিলাম। এই তো আমার কোমরের গিটটুতে মোবাইল রাখা। – আরে কি বলছিস, বাথরুমে বসে কেউ পত্রিকা পড়ে? তোর মাথা ঠিক আছে তো?- কি যে বলো না ভাইয়া। তুমি হুমায়ুন আর সুনীল বাবুর বই পড়নি? সেখানে বেচারা বাথরুমে বসে বসে দিব্যি কাগজ পড়ছে। কাগজের পত্রিকা ছাড়া তার বাথরুম হয় না। একদিন বেচারার বাথরুমে ঢুকার সময় হযে়ছে কিন্তু হকার আসছে না। এ দিকে অফিসের বেলা ঘনিয়ে আসছে অথচ পত্রিকা পাচ্ছেন না। দেখোতো কী কাণ্ড। বেচারার বাথরুমই হলো না। ঝন্টু সরলার কথা শুনে হাসি থামাতে পারলো না। হাসাটা একটু স্লো করে বললো- তাই বলে তুইও বাথরুমে বসে পত্রিকা পড়বি? ছি: ছি:, এতো নোংরা অপবিত্র স্থানে মিনিটের পর মিনিট বসে থাকতে ঘৃণা লাগে না?
কি যে বলো না তুমি? সামনে পরীক্ষা। রোমে বসে ক্লাসের পড়া ফাঁকি দিযে় পত্রিকা নিয়ে সময় নষ্ট করতে যাবো এমন মেয়ে আমি না ভাইয়া। তার চেযে় এই ভালো। এক সাথে দুটি কাজ হয়ে গেল। তোমার এই ছোট্ট বোনটিকে জিনিয়াস বলতে পার তুমি। – জিনিয়াস না ছাই, হুমায়ুন আর সুনীল বাবু তোকে বোকা বানিযে় দিয়েছেন। তোর মতো বোকা পাঠক আর দু’এক জন আছে কি না আমার সন্দেহ। – জানো ভাইয়া, আমার একটা জিজ্ঞাসা কিছু দিন থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হুমায়ুন বা সুনীল বাবু বেঁচে থাকলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতাম। উত্তরটা যে কিরূপ হতো তা ভাবতেও আমার গা শিরশির করে। জিজ্ঞাসাটা হলো- যে চরিত্রটি বাথরোমে বসে বসে কাগজের পত্রিকা পড়তে অভ্যস্ত। পত্রিকা ছাড়া তার বাথরুমই হয় না। ধরা যাক, সে কমেডে বসেই পত্রিকা পড়ছে। বিদ্যুৎ চলে গেল। ঠিক তখন বেচারার অবস্থা কেমন হতো? সে কি অর্ধেক কাজ রেখেই চলে আসতো নাকি অন্ধকারেই বাথরুমে বসে থাকতো? কিন্তু নিষ্ফল কামনা। উনারা বেঁচে নেই। এ প্রশ্নের উত্তর অন্য কেউ দিলে হবে না। উনাদের নিজস্ব একটা উত্তর নিশ্চয় আছে। কিন্তু তা প্রকাশ না করে ধাঁধাঁয় ফেলে রেখেছেন। তাই কারো ভিন্ন উত্তর পেলেও আমার মনপূত হবে না। তোমার কি মনে হয় ভাইয়া? এমন প্রশ্ন তৈরী করা কি অবান্তর? ঝন্টু নিধিরাম সর্দারের মতো ছোট বোন সরলার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে- বোনটির নাম যেমন সরলা, তেমনি তার কাজ ও কথা সরল। ঠিক তখন সরলা খাতুন ভাইকে কথার তোড়ে ভাসিয়ে দিতে পেরে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। এর ফাঁকে তার বগলে কামিজের পকেটে রাখা মোবাইলে আলতো ছুঁয়ে দেখে নিলো সেটা যথাস্থানে আছে কি না। ফেসবুক জ্বরের ঔষধ যে তার বগলেই রাখা।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *