দুষ্ট স্বপন

দুষ্ট ছেলের দল বোঝাতে যা বোঝায় তার সবগুলো বৈশিষ্ট্যই আছে স্বপন, রাহাত আর খোকনের মধ্যে। গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়ানো ছাড়া ওদের তেমন কাজ নেই বললেই চলে। আর থাকবে কীভাবে। স্কুল নেই, লেখাপড়াও নেই তাই কোনো চিন্তাও নেই ওদের। তিনজনের স্বভাব কীভাবে যে একই রকম হলো কেউ ভেবে মিলাতে পারে না। কে সেরা দুষ্ট তার হিসেব অবশ্য কেউ করেনি। আর করবেই বা কীভাবে? ওদের ভোর হয় দুষ্টুমি করে রাতে ঘুমাতে যায় দুষ্টুমি করে। খুব ভোরে যখন ওদের ঘুম ভাঙ্গে তখন দাঁত মাজতে মাজতে অর্ধেক গ্রাম বেড়ান হয় সেই সাথে চলে নানা দুষ্টুমি। কম করে হলেও কারো সাথে অযথা কথা বলে সময় নষ্ট করে ঘরে ফিরবে। এরপর সকালের খাবার। সকালে কখনো গরম থাকলে বড্ড খুশি ঠাণ্ডা হলেও মন খারাপ করে না। কারণ দিনে যে কাজ করে ওরা দিন পার করে তাতে প্রতিবেলায় খাবার থাকার কথা নয়। কিন্তু ভালোয় ভালোয় বাবার হোটেলে বিনা পয়সায় তিনবেলাই পেট পুরে খেতে পারছে। স্বপন, রাহাত আর খোকনের লেখাপড়া ক্লাস ফোর পর্যন্ত। তিনজন একই ক্লাস থেকে স্কুল পালিযে়ছে। কী অসাধারণ মিল ওদের ভেতর। ওরা যখন এক সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলে তখন ওদের ভেতর এক রকম হতাশা কাজ করে। কেনইবা ওরা স্কুল ছাড়ল। কেনইবা এমনটি করে দিন পার করা। স্বপন কখনো অন্যদের মতামত জানতে চায়। অন্যরাও বুদ্ধিমানের মতো করে উত্তর দেয়—
‘দোস্ত আমাদের স্কুল ছাড়াটা ঠিক হয়নি।’
স্বপন ওদের কথা শুনে বলে—
‘চল আমরা আবার স্কুলে ভর্তি হই।’
‘কোন ক্লাসে ভর্তি হব?’ আগ্রহের সাথে জানতে চায় দুজন।
‘কেন সিক্সে। আমরা বড় হযে়ছি না?’ স্বপনের যুক্তি।
‘ধুর আমাদের কী সিক্সে ভর্তি করাবে?’ খোকন আস্তে করে বলে।
এভাবে যে দিনে কতবার ওরা স্কুলে ভর্তি হয় আবার ফিরে আসে তার হিসেব নেই। সবই ওদের ভাবনা। সকালে যা ভেবে ভেবে ঘর থেকে বের হয় দুপুরে সেটার কথা আর মনে পড়ে না। মনে থাকার উপায়ও থাকে না দুষ্টুমির ভিড়ে। কোনো পুকুরে মাছ ধরা দেখলে ওরা সহযোগিতার ছলে মাছের অংশে ভাগ বসায়। মাছ নিয়ে যখন বাড়ি ফেরে তখন ওদের বাবা মাও কিছু বলেন না। গ্রামের ভেতর কে কোন বিপদে বা কাজে ব্যস্ত আছেন তার সংবাদ আর কারো কাছে না পৌঁছালেও ওদের তিনজনের কানে পৌঁছায়। আর তিনজনই একত্রে অকুস্থলে ছোটে কিছু পাবার আশায়।
বাবা মায়েরা যে ওদের খেয়াল নেন না তাও ঠিক নয়। কারণ হাজারো চেষ্টা করেও ওদের স্কুলমুখী করা যায়নি। কখনো স্কুলের বারান্দায় গেলেও ক্লাস রুমে ঢোকেনি। ঢুকবে কীভাবে ওদের শেখার আগ্রহ না থাকুক লাজ শরম বলতে কিছুটা হলেও আছে।
গ্রামের ভেতর এই তিনজনের নাম জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বড় কষ্টের। কেউ কখনো বিরক্ত হলেও যখন ওদের ভালো কাজ কিংবা উপকার করতে দেখেন তখন বিরক্তের পরিবর্তে সন্তুষ্ট হন। মনে মনে বলেন—‘আর যাই হোক তোদের দরকার আছে।’
নিত্যদিন ওদের দুষ্টুমির ধরন বদলায়। আজ মাছ ধরার প্ল্যান থাকলে কাল ফসল কাটা। ফসল কাটার পর ওর ক্ষেতের আগাছাও পরিষ্কার করে দেয়। পারিশ্রমিকও পায়। দুপুরের খাবারই ওদের পারিশ্রমিক। কী অদ্ভুদ ওদের জীবনাচরণ। ওদের নিয়ে কেউ কী ভাবার নেই। হাজারো মানুষের বসবাস যেখানে সেখানে অন্তত একজন লোক নিশ্চয়ই আছেন যিনি ওদের নিয়ে ভাবেন। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান তার নিজের মত করে ওদের নিয়ে ভাবেন। কীভাবে ওদের স্কুলমুখী করাবেন তার ছক এঁকে গ্রামের মান্যগণ্যদের সাথে আলাপও করেছেন।
আজ তিনজনই সামনের ডান দিকের রাস্তায় বসে গল্প করছে। স্বপনের ইচ্ছে স্কুলের পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে গল্প করার। দুপুরের টিফিনের সময় ওর পুরনো বন্ধুরা এসে গল্প করবে। বিকেলে মাঠে খেলতে পারবে। রাহাত আর খোকনের বিরোধিতায় সম্ভব হল না। হবেই বা কীভাবে। ওদের ভেতর আর যা-ই থাকুক গণতন্ত্রের চর্চা আছে। ক্লাস ফোর এর সমাজ বইটায় ওরা গণতান্ত্রিক মনোভাবের কথা পড়েছে। তার বাস্তব রূপ ওরা প্রতিদিনই মেনে চলছে। তিনজনের ভেতর দুজন যেদিকে থাকবে সেদিকেই বাকিজনের থাকতে হবে। স্বপন হেরে যায় এখানে। বাকি দুজনের পরামর্শে গ্রামের শেষ প্রান্তে সবার পরিচিত চৌধুরী বাডি়র সামনে থাকা বড়ই গাছের নিচে যাবে। গাছে উঠে না হোক অন্তত নিচে যা পাবে তা-ই তিনজনেই খেতে পারবে। ওদের প্ল্যান এর ছক আঁকতে দেরি বাস্তবায়নে দেরি হয় না। গাছের নিচে যখন আসল তখন কেউ নেই। বড়ই গাছটির বয়স কত হবে এ নিযে় কারো ভাবনা না আসলেও স্বপনের ঠিকই জানতে ইচ্ছে করে। এ গাছের বড়ই খুব মিষ্টি না হলেও খেতে একদম মন্দ লাগে না। স্বপন গাছের দিকে তাকাল। ওমা হাজার হাজার বড়ই পাতার সাথে ঝুলে আছে। অনেক পেঁকে গেছে। মাঝারি সাইজের মাটির ঢিল স্বপন ডান হাত দিয়ে ছুড়ল গাছের মধ্যখানে।
‘এই বড়ই গাছে কেরে?’ চৌধুরী বাডি়র বুডি়র চেঁচামেচির আওয়াজ।
যে যেভাবে পেরেছে ভোঁ দৌঁড় দিয়ে আত্মরক্ষা করল ওরা। স্বপন বসল নিরাপদ দূরত্বে এসে। বাকিরাও বসল।
‘না দোস্ত বুড়িয়ে না দেখে এভাবে ঢিল ছোঁড়া ঠিক হয়নি।’ হাপাতে হাপাতে বলে রাহাত।
‘আরে বোকা আমি বুডি়কে দেখেছি নাকি?’ দ্রুত বলে স্বপন।
‘শোন দোস্ত গাছের সব বরই আমাদের নিযে় যেতে হবে। প্রতিশোধ নিতে হবে।’ ধীরে ধীরে বলে খোকন।
খোকনের হাতের উপর বাকি দুজন হাত রাখে।
স্বপনও বুড়ির ওপর মনে মনে ক্ষেপেছে। প্রতিশোধের একমাত্র মাধ্যম সব বরই শেষ করে। বুডি় বুঝতেই পারবে না কারা বরই পেড়েছে। যেমন ভাবনা তেমনি প্ল্যান এর ছক আঁকা হল। মধ্য দুপুরে বুডি় ঘরের ভেতর থাকে। রাহাত অনেক দিন দেখেছে। দুপুরের পর থেকে বুডি় গাছের ধারে কাছেও আসে না।
‘তাহলেই কাল বুড়িকে বুঝিয়ে দিব আমরা কী করতে পারি।’ স্বপন চোখ দুটো বড় করে বলে ওদের।
তিনজনের রাত কাটে নির্ঘুমে। নানা চিন্তা ওদের ছোট মাথাগুলোকে ভাবিযে় তোলে। গ্রামের ভেতর ওদের কাজে বাধা। তাও ওই বৃদ্ধা বুড়ি! তিনজনের মাথায় একই প্রশ্ন ঘুরপাক করে। অনেক কষ্টে রাত পার করে ওরা।
সকাল হল। সকালের খাবার খেযে়ই স্বপনের বাড়িরর পেছনে বাঁশ বাগানে। বাঁশ বাগান ওদের সিদ্ধান্ত নেয়ার অন্যতম জায়গা। প্রস্তাব যখন ভোটে দেয়ার প্রয়োজন তখন নিজেরা প্রস্তাব উত্থাপন করে নিজেরাই পাশ করে। আবার তিনজনই বাস্তবায়নে অংশ নেয়। কারো সহযোগিতার প্রযে়াজন হয় না। ওদের ভেতর থাকা গণতন্ত্রের এই চর্চা সত্যিই আলাদা।
স্বপন ওদের সাথে শলা পরামর্শ করে নেয়। বরই গাছ অভিযানের নেতা স্বপন। সিদ্ধান্তানুযায়ী স্বপনই গাছে উঠবে। কারণ গতকাল ওর ঢিল মারার কারণই বুড়ি তেড়ে এসেছিল। তাই আজ নিজ হাতে ইচ্ছে মতো বরই পাড়বে। বুডি় যখন দেখবে গাছ ফাঁকা হয়ে গেছে তখন বুঝবে আমাদের তাড়ানোর কত শাস্তি। ওরা মনে মনে ভাবে।
মাথার উপর থাকা সূর্যটা ক্রমশ পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে। গ্রামের রাস্তা জনমানব শূন্য। তীব্র রোদে এই রাস্তায় থাকে না এটাও ওদের জন্য সহায়ক।
স্বপন চুপে চুপে গাছে ওঠে। রাহাত আর খোকন গাছের দুপাশে চোখ খোলা রেখে সতর্ক পাহারা। বুডি় আসা মাত্রই সংকেত দিবে যাতে স্বপন নিরাপদে নিচে নেমে আসতে পারে। স্বপন ব্যাগ নিযে় উঠল। পাঁকা বরইগুলো ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। মিনিট বিশেক স্বপন ইচ্ছে মতো বরই ব্যাগে ভরেছে। মোটা ডাল শেষ করে চিকন আর সরু একটা ডালের দিকে গেল। একটু নড়াচড়া করলেই সরু ডালটা নেড়ে ওঠে। স্বপন কৌশলে বরই পেডে়ই যাচ্ছে। আর মনের ভেতর বুড়ির প্রতি যে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছাটা পূরণ হচ্ছে। মনের ভেতর প্রশান্তির ছাপ। ডানে বামে আর নিচে তাকানোর কোনো ফুসরৎ যেন স্বপনের নেই। সম্ভব হলে গাছের সব বরই আজ ওরা নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বুড়ির গলার আওয়াজ—‘কে কোথায় আছিস আমার সাথে আয়। বরই গাছে কোন পাজিটা।’
বুডি়র গলার খেক খেকানি আর ডাক শুনে যে যেভাবে পেরেছে ছুটে আত্ম রক্ষা করল। স্বপন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙ্গে ওর মাথায় পড়ল। দ্রুত নামার চেষ্টা করতে গিয়ে সরু ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়ল। দুহাতসহ শরীরের নানা স্থানে কাঁটা ঢুকল। অনেক কষ্ট করে কাঁটার ভেতর থেকে বের হল। বুড়ি স্বপনের অবস্থা দেখে মুখ চেপে কিছুক্ষণ হাসল। কাছে এসে স্বপনকে ধরল। স্বপন তো ভযে় কম্পমান। লজ্জায় স্বপনের নাকটা লাল হয়ে যায়। বুড়ি স্বপনকে নিয়ে তার ঘরের দিকে হাঁটল। বুড়ি স্বপনের শরীরের ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দিল। বুড়ির ব্যবহারে স্বপন আনন্দ পেল। মনে মনে ভাবে ‘ইস্ বুড়ি কতই না ভালো একজন মানুষ। আমরা অযথাই তার সাথে লেগেছি।’ রাহাত আর খোকনের সাথে দূরত্ব বাড়ল স্বপনের। বন্ধুত্বে ছেদ হল।
স্বপন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সংকল্প করল সব দুষ্টুমি ছেড়ে লেখাপড়ায় মন দিবে। ঠিকই একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্বপন স্কুলে ভর্তি হল। স্বপনের দুচোখে ভিড়ল এবার হাজারো রঙিন স্বপ্ন।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *