নিঃশব্দ কান্না

পুব আকাশে সূর্যটা ওঠার আগেই রহিমা বেগম ফজরের সালাত আদায় করে ঘরের আঙিনায় পায়চারি করছে। ছয়বছরের একমাত্র ছেলে নয়নকে নিয়ে আছেন বহু কষ্টে। বছর তিনেক আগে স্বামী আজগর আলী মারা যান। স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের সংসারটা। স্বামী মারা যাবার পর আর্থিক অনটন শুরু হয়। নয়নকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে আর্থিক অনটনটা বেড়েছে। দুমুঠো খাবারের জন্য এখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। মাঝে মাঝে রহিমা বেগমের খুব কষ্ট হয়। বেশি কষ্ট হলে নিজের কাছে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর খুঁজেন। কেনই বা এমন অভাবী সংসারটা রেখে তার স্বামী চলে গেল? কেনইবা তার মৃত্যু হল না। কিছুক্ষণ পর আবার এসব প্রশ্ন ভুলে গিয়ে কাজে নেমে পড়েন। শহরের কোল ঘেঁষে একটি উপশহর গড়ে উঠেছে। এখানেই অন্যের জমির ওপর অস্থায়ী একটা ঘর তৈরি করে বসবাস করছে তারা।
রহিমা বেগমের দিন কাটে অন্যের বাসায় কাজ করে। কাজ করার পর মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসে। কেউ আবার খাবার না দিয়ে টাকা দিয়ে থাকে। রহিমা বেগমের কিছু বলার থাকে না। যে যেটা দিয়ে খুশি রহিমা বেগমও খুশি মনে গ্রহণ করে।
রহিমা বেগম যে ঘরটায় থাকে সেটা খুব একটা ভালোমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি না । ফলে বর্ষাকালে কষ্টের সীমা থাকে না। চালে ফাঁক দিয়ে অনবরত বৃষ্টির পানি বিছানার উপর পড়ে। মা ছেলে দুজনই সমান কষ্ট করে রাত কাটায়। মাঝে মাঝে রহিমা বেগম ছেলে নয়নকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করে। নয়ন নিরাপদে থাকলেও রহিমা বেগম বৃষ্টিতে ভিজে যান।
বর্ষা এলেই রহিমা বেগমের কষ্টের অন্ত থাকে না। অন্যের বাসায় কাজে ডাকে না। অভাব অনটন তখন নিত্যসঙ্গী হিসেবে থাকে। নয়নের মুখে খাবার দেয়ার জন্য নিজের ছোট ঘরে পপকর্ন ভেজে রা¯তায় বিক্রি করে। সন্ধ্যার পরেই নিজের ভাজা পপকর্ন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাত গভীর পর্যšত চলে রহিমা বেগমের পপকর্ন বিক্রি।
নয়নের স্কুলে বই খাতার প্রয়োজন। নয়ন স্কুল থেকে ফিরে মাকে জানায়। রহিমা বেগম কিনে দিবেন বলে বারবার আশ্ব¯ত করেন। নয়নও মায়ের কথা অনুযায়ী অপেক্ষায় থাকে। রহিমা বেগমের হাতে বই খাতার টাকা জমানো হয়না। জমাবে কীভাবে। রাতের বেলা পপকর্ন বিক্রি করে যে টাকা পায় সেটা দিয়ে তিনবেলা খাবার কিনতে হিমশিম খেতে হয়। সেখানে বইখাতার টাকা যোগানো সম্ভব হয় না।
স্কুলে গিয়ে রহিমা বেগম তার দুরবস্থার কথা জানায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নয়নের প্রয়োজনীয় উপকরণ দেয়ার কথা বলে। নয়ন পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ায় অন্যান্য শিক্ষকরাও সমর্থন জানায়। রহিমা বেগম নামাজ আদায় করে মহান রবের কাছে মুনাজাত করে। মুনাজাত শেষে নিজের চোখের পানি শাড়ির আচল দিয়ে মুছেন। নয়ন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেÑ
‘মা তুমি কাঁদো কেন? আমাদের কষ্টের জন্য?’
রহিমা বেগম নয়নের মুখের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন।
‘মা তুমি এমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আমি তোমার কষ্ট বুঝি মা।’
রহিমা বেগম এবারও নিরুত্তর থেকে নিঃশব্দে কেঁদে উঠেন।
নয়ন এবার মায়ের কোলে গিয়ে বসে। রহিমা বেগম নয়নের কপালে, গালে চুমো খান।
ধীরে ধীরে বলতে লাগলেনÑ
‘নারে খোকা। আমাদের আর কী কষ্ট। দুনিয়ায় এমন অনেক মানুষ আছে যারা দুমুঠো খাবার খেতে পারে না। আমরাতো খেতে পারছি।’
ছোট্ট নয়নের চোখে এবার জল এসে চোখ দুটি ভিজে যায়।
‘মা আমি বড় হয়ে তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। আমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। তোমাকে অন্যের বাসায় কাজ করতে হবে না।’
নয়ন কথাগুলো বলে নিশ্চুপ থাকে।
সন্ধ্যার পর হেরিক্যানের আলোয় নয়ন পড়তে বসে। রহিমা বেগম চুলার আগুনে পপকর্ন ভাজে। নয়ন পড়া শেষে চুলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পপকর্ন ভাজার শব্দ শোনে। কখনো কখনো মাকে সাহায্য করে। প্যাকেট ভরে দেয়। নয়নের কচি হাতে গরম তাপ না লাগতে পারে তার জন্য রহিমা বেগম নিষেধ করেন। নয়ন নিষেধ উপেক্ষা করে মায়ের কাজে সাহায্য করে।
রহিমা বেগম বর্ষা রাতেই পপকর্ন বিক্রি করে ঘরে ফিরেন। ভিজা কাপড় পরিবর্তন করে নয়নের পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়েন। নয়ন দরজার শব্দ শুনেই বুঝতে পারেন মা ঘরে ফিরেছে।
ঠিক কয়েকদিন পরে রহিমা বেগম যাদের জমির ওপর ঘর তৈরি করেছিলেন তারা এসেছে। সব কথা শেষ করে জানাল তারা এখানে বিল্ডিং তৈরি করবেন। একমাস পরেই তাদের কাজ শুরু হবে। রহিমা বেগম বুঝতে পারেন এখান থেকে তাদের চলে যেতে হবে। রহিমা বেগমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নিজের হাতের তৈরি ঘরটা কীভাবে ভেঙ্গে অন্যত্র চলে যাবেন? অন্য কোথায় আবার ঘর তৈরি করে বাস করবেন। এমন নানা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলেও এইটুকু জানেন এখান থেকে চলে যেতে হবে।
নয়ন এসে সবার কথা শোনে। ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দুশ্চিšতাগ্রস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নয়ন কোনো কথা বলার ভাষা খুঁজে পায় না। ওর স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে করে, শিক্ষকদের কথা মনে করে। চকির ওপর রাখা বইগুলোর কথা ভাববার চেষ্টা করে। নয়নের দুচোখে এখন হাজারো স্মৃতি এসে জমা হয়েছে।
চারদিকে অন্ধকার হয়ে রাত নেমে আসে। রহিমা বেগমের জীবনেও অন্ধকার নেমে এসেছে। অনাগত জীবনের ভাবনায় তার ঘুম আসে না। নয়নের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু এইটুকু বলতে পেরেছেন-‘নয়ন আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। তিনি আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।’
সপ্তাহ দুয়েক পর রহিমা বেগম তার জিনিসপত্র বিক্রি করে গ্রামের ফিরে যাবার মনস্থির করলেন। নয়ন স্কুলের সবাইকে বিদায় জানানোর চেষ্টা করল না। কারণ নয়ন আর স্কুলে যায়নি। নয়নের রাগ আর ক্ষোভ ওর বাবার জন্য। কেনইবা ওর বাবা ওদের রেখে চলে গেলেন? বাবা কেন ফিরে এলেন না? নয়ন আর ওর মা গ্রামের দিকে ছুটলেন নতুন আবাসের খোঁজে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *